আশাবাড়িয়ার শিক্ষার্থীদের জন্য আশার আলো হয়ে এল যে সেতু

সেতুটি চালু হওয়ার পর অনেক শিশুর স্কুলে যাওয়ার আগ্রহ বেড়েছেছবি: সংগৃহীত

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যত ধরনের কষ্ট হয় মানুষের, তার অনেকগুলোই আছে পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার ‘আশাবাড়িয়া চরের’ মানুষের জীবনে। মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন গ্রাম এই ‘আশাবাড়িয়া চর’। আশাবাড়িয়ায় নেই কোনো ভালো রাস্তাঘাট, সাইক্লোন শেল্টার ও হাটবাজার। তাই এখানকার লোকজনের ভরসা হচ্ছে মূল ভূখণ্ডের ওপর। নদীর খুব কাছে হওয়ায় এখানে প্রতিবছর আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা ও নদীভাঙন। ঘূর্ণিঝড়ের সময় সাইক্লোন সেন্টারে যেতে পারতেন না অনেকে। কারণ, ঝড়ে নৌকাও ডুবে যেত। তাই ঘূর্ণিঝড়ের সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় খাল পার হয়ে যেতে হতো আশ্রয়কেন্দ্রে।

শিক্ষা অর্জনের জন্য নেই কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যা আছে তা আশাবাড়িয়া খালের ওপারে। যেখানে যেতে একমাত্র মাধ্যম ছিল নৌকা বা সাঁতার কাটা। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে প্রতিদিন স্কুলে যেতে পারত না। আর নৌকাও সবার সামর্থ্যে কুলায় না।। তাই স্কুলে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও যাতায়াতের পথ না থাকায় স্কুলে যেতে পারত না আশাবাড়িয়া চরের ছেলেমেয়েরা। তাদের জন্য যেন অনেকটাই আশার আলো নিয়ে এসেছে আশাবাড়িয়া সেতুটি।

গত বছর লোকাল গভর্নমেন্ট ইনিশিয়েটিভ অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (লজিক) প্রকল্পের অর্থায়নে নির্মাণ করা হয় আশাবাড়িয়া সেতুটি। এর পর থেকে দ্রুত শিক্ষার আলো ছড়িয়ে পড়ে চরটিতে। এখানকার মৌডুবি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নূর আছমা বলে, ‘বর্ষাকাল এলেই আমাদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হতো। কারণ, স্কুলে যেতে নৌকা লাগত আর নৌকাঘাটও নেই এখানে। অন্য রুটের নৌকার কাছে সাহায্য নিতে হতো। কিন্তু নৌকা আসতে আসতে স্কুল ছুটি হয়ে যেত। তাই স্কুলে যেতে পারতাম না। কিন্তু সেতুটি চালু হওয়ার পর আমার মতো অনেকের স্কুলে যাওয়ার আগ্রহ বেড়েছে। আমরা এখন দলবেঁধে হেঁটে স্কুলে যেতে পারি। আমাদের খুব আনন্দ লাগে, যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।’

সেতু দিয়ে দলবেঁধে স্কুলে যাচ্ছে শিশুরা
ছবি: সংগৃহীত

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ঘূর্ণিঝড়ের সময় ঢেউ এখন অনেক বেশি উচ্চতার হয়ে থাকে। সেই সময় পানির স্তর বেড়ে যাওয়ায় ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে মানুষের অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হতো। এ ছাড়া জোয়ারেও এ এলাকা প্লাবিত হতো। আশাবাড়িয়ার চরের বাসিন্দা আমেনা বেগম বলেন, ‘আশাবাড়িয়া সেতু আমাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। এখন আমরা দ্রুতই সেতুটির মাধ্যমে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে পারি। সেতুটি শুধু আমাদের যোগাযোগ সহজ করেনি, আমাদের ঘূর্ণিঝড় ও বন্যা থেকেও রক্ষা করছে।’

সেতুটি সম্পর্কে শুধু একজনের মতামত নয় এটি, প্রায় সবাই বলেন এটি তাঁদের জীবন বদলে দিয়েছে। আশাবাড়িয়ার চরে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা নিয়ে এসেছে সেতুটি। চরে উৎপাদিত জিনিসপত্র এখন অন্য হাটবাজারে নিয়ে বিক্রি করে লাভ করতে পারেন কৃষকেরা। ন্যায্য মূল্য পেয়ে কৃষক যেমন নিজে লাভবান হচ্ছেন, তেমনি তাঁর পরিবারের সব সদস্যকে নিয়ে হাসিমুখে থাকতে পারছেন।

আশাবাড়িয়া চরের আরেক বাসিন্দা বিলকিস খাতুন বলেন, ‘এখন গর্ভবতী মায়েরা চিকিৎসার জন্য সহজেই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যেতে পারেন সেতু দিয়ে। এখন আমাদের ঘূর্ণিঝড়ের সময় মৃত্যুভয় নেই। কারণ, আমরা সেতু দিয়ে খুব দ্রুত আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে পারি। এ ছাড়া এখানকার উৎপাদিত পণ্য সরাসরি বাজারে বিক্রি করার সুযোগ পেয়ে আমাদের হাতে টাকা এসেছে। যা দিয়ে নিজের ও পরিবারের জন্য কিছু কিনতে পারি।’

লোকাল গভর্নমেন্ট ইনিশিয়েটিভ অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (লজিক) প্রকল্পটি মূলত ইউএনডিপি বাংলাদেশ, ইউএনসিডিএফ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, সুইডেন এবং ডেনমার্ক সমর্থিত একটি যৌথ উদ্যোগ। এটির লক্ষ্য হলো নির্বাচিত জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজনে ক্ষতিগ্রস্ত কমিউনিটি, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান এবং সুশীল সমাজ সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।