‘বাবা দেখে যেতে পারলেন না’, জিপিএ–৫ পেয়েও মন খারাপ করে বসে ছিলেন নামিরা

অনেক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সন্তানের ভালো ফল পেয়ে খুশি নামিরার মা। গতকাল বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর ২০২৫ ) দুপুরে তোলাছবি: দীপু মালাকার

নামিরা আজম এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ–৫ পেয়েছেন। এইচএসসির দুই বছর তিনি নানা কারণে পড়ালেখা করতে পারেনি। টেস্ট ও প্রিটেস্টের ফলাফলও ভালো ছিল না। কিন্তু পরীক্ষা শুরুর আগে দুই মাস তিনি খুব মনোযোগ দিয়ে পড়েছেন বলে জানান। আর তাতেই ফল এমন হয়েছে। নামিরা বলেন, ‘ঘণ্টা হিসাবে নয়, নিজের দুর্বলতা বুঝে পড়েছি।’

ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে এবার বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ–৫ পেয়েছেন ৭৯৭ জন। নামিরা আজম তাঁদেরই একজন। তবে ফলাফল প্রকাশের দিনে শত শত শিক্ষার্থীর উচ্ছ্বাস আর প্রাণের উল্লাসের মধ্যে তাঁকে বিশেষভাবে চোখে পড়ার কারণ তাঁর ম্লান মুখ।

আরও পড়ুন

বৃহস্পতিবার দুপুরে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের মাঠে সহপাঠীদের সাহচর্য ছাড়া, গণমাধ্যমের ক্যামেরা এড়িয়ে মায়ের হাত ধরে একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন সদ্য এইচএসসি পাস করা নামিরা আজম। ম্রিয়মাণ দেখে সন্দেহ হয়েছিল, হয়তো অকৃতকার্য হয়েছেন। কিন্তু ফলাফল জানতে চাইলে বললেন, ‘আমি জিপিএ–৫ পেয়েছি। এসএসসিতেও জিপিএ–৫ ছিল।’ তাহলে এত মন খারাপের কারণ কী—জিজ্ঞেস করলে নামিরা বলেন, ‘আমার বাবা আমার এইচএসসি পাস করা দেখে যেতে পারলেন না।’

নামিরার বাবা মোহাম্মদ রফিকুল আজম চার বছর ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে মারা গেছেন ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে। নামিরার একমাত্র বড় ভাই মুশফিকুল আজম ডাউন সিনড্রোমের রোগী। রাজধানীর শাহজাহানপুরে ভাড়া বাসার খরচসহ মেয়ের পড়ালেখা চালিয়ে নিতে রীতিমতো সংগ্রাম চলছে নামিরার মা সালমা আক্তারের। বৃহস্পতিবার দুপুরে মেয়েকে নিয়ে তিনি উপস্থিত ছিলেন কলেজ মাঠে।

সালমা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘নামিরাকে নিয়ে কলেজে বা কোচিংয়ে যাওয়ার সময় বাসায় ২৫ বছরের ছেলেকে দরজায় তালাবদ্ধ করে বের হতে হয়। এই শহরে তিনজন মানুষের টিকে থাকার লড়াইটা অনেক কষ্টের। মেয়ে যে জিপিএ–৫ পেয়েছে, আমার কাছে তা–ই অনেক। ও শেষের দিকে খুব সিরিয়াস হয়েছে পড়ালেখায়।’

নামিরা ফলাফল নিয়ে মায়ের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিলেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাঠে
ছবি: প্রথম আলো

নামিরা আজম বলেন, বাবার মৃত্যুর পর তাঁর বড় ভাই আরও অসুস্থ হয়ে যান। এ সময় নামিরার মাকে ব্যস্ত হয়ে যেতে হয় ছেলেকে নিয়ে। এসব ঘটনায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন নামিরা। পড়ালেখা করা সম্ভব হয়নি। তাঁর নিজেরও শরীর খারাপ ছিল। নামিরার রেজাল্ট খারাপ হয়েছে সারা বছর ধরে। কিন্তু একেবারে শিরে সংক্রান্তির মতো পরীক্ষা দোরগোড়ায় যখন, তখন সচেতন হয়েছেন নামিরা।

সেই যাত্রাটা কেমন ছিল জানতে চাইলে নামিরা প্রথম আলোকে বলেন, ‘তখন খুব অল্প সময় আছে পরীক্ষার। বুঝতে পারলাম, আমার প্রস্তুতি খুবই খারাপ। তখন নিজেই নিজেকে বোঝালাম, যা হারিয়েছি এবং যেসব ঘটছে, এ ব্যাপারগুলোতে আমার হাত নেই। কিন্তু রেজাল্ট খারাপ হলে সেটা আর আমি বদলাতে পারব না। তখন শুরু করলাম পড়ালেখা।’

এই পড়ালেখাটা কেমন ছিল সে বিষয়ে নামিরা বলেন, ‘আমি প্রতিদিন ১০–১২ ঘণ্টা পড়তে হবে, এ রকম কখনো মনে করিনি। সায়েন্সের বিষয়গুলোতে বেশি গুরুত্ব দিয়ে আগে বোঝার চেষ্টা করেছি, কোন কোন বিষয়ে আমার দুর্বলতা কোথায়। সে জায়গাগুলো ভালো করে পড়া শুরু করলাম। যেটা বুঝতাম না, সেটা বাদ না দিয়ে বরং সেটাকেই ভালোভাবে বুঝতে চেষ্টা করেছি। বারবার সেটাই পড়েছি।’

আরও পড়ুন

নামিরার প্রয়াত বাবা মোহাম্মদ রফিকুল আজম কাকরাইলে রিকন্ডিশন্ড গাড়ির ব্যবসা করতেন। ক্যানসারে চার বছর ধরে চিকিৎসার পর তাঁর মৃত্যুতে আর্থিক বিপর্যয়ের মুখেও পড়ে পরিবারটি। সেই পরিস্থিতিও নামিরার ওপর ছাপ ফেলেছে। নামিরা জানান, তাঁর রেজিস্ট্রেশন ফি ২০ হাজার টাকা দেওয়ার মতো অবস্থা ছিল না। তখন ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ কর্তৃপক্ষ এই রেজিস্ট্রেশনের অর্ধেক মওকুফ করে দিয়েছে।

এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের এমন বিপদে সব সময় পাশে থাকতে চেষ্টা করে। সব সময় হয়তো পুরোটা মওকুফ করা সম্ভব হয় না। আমরা শিক্ষকেরা বড়জোর রেকমেন্ড করতে পারি। নামিরা যে ফল করেছে, তা ওর নিজের চেষ্টারই ফল। সে একটা স্ট্রাগলের মধ্য দিয়েও জিপিএ–৫ পেয়েছে। শিক্ষক হিসেবে এটা আমাদের গর্ব।’

বাবা বেঁচে থাকতে নামিরার পরিবার। বাঁ থেকে বড় ভাই, মা ও বাবার সঙ্গে নামিরা আজম
ছবি: সুলতানা আক্তারের কাছ থেকে পাওয়া।

নামিরা জানান, তিনি নটর ডেম কলেজের তিনজন শিক্ষকের কাছে কোচিং করতেন। কেমেস্ট্রি, ফিজিক্স আর বায়োলজির শিক্ষকেরা তাঁর জন্য মাসে ৫০০ টাকা করে কমিয়ে রাখতেন। উচ্চতর গণিত অনলাইনে ফ্রি ক্লাস করে পড়েছেন। এর বেশি টিউশন পড়ার সংগতি নেই তাঁর পরিবারের।

নামিরা সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন মতিঝিল সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট স্কুলে। অষ্টম শ্রেণি থেকে ভর্তি হয়েছেন ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে। নামিরার মা সালমা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার মেয়েটার জন্ম ২০০৫ সালে। জন্ম থেকে দেখছে একমাত্র বড় ভাই অসুস্থ। নামিরার ১৬ বছর বয়সের সময় ওর বাবার ক্যানসার ধরা পড়ল। মেয়ের ফলাফল আমাকে সাহস দিচ্ছে।’

কলেজ মাঠ থেকে বাড়ি ফিরে যাওয়ার পর আবার যোগাযোগ করা হলে নামিরা জানান, তিনি কেক খেতে পছন্দ করেন বলে আজ তাঁর মা একটা কেক কিনেছেন। সেই কেকটা নিয়ে বাসায় ফিরেছেন। এটা তাঁর ভালো ফলাফলের উপহার। সামনে মেডিকেলের জন্য প্রস্তুতি শুরু করবেন নামিরা।

আরও পড়ুন