শিক্ষা ও নৈতিকতা প্রসারে সম্মাননা পেলেন ১০ গুণী শিক্ষক

এথিকস ক্লাবের নৈতিকতা দিবস উপলক্ষে একটি বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। এখানে ১০ জন শিক্ষককে আদর্শ শিক্ষক সম্মাননা দেওয়া হয়

তাঁদের মেধা, মনন, শ্রম ও ভালোবাসায় সমাজ আলোকিত হয়। বিনির্মিত হয় সমৃদ্ধ জাতিসত্তা। তাঁদের দীক্ষায় বেড়ে ওঠে মননশীল প্রজন্ম। মেধা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিকতা কিংবা আদর্শিক জীবনের বীজটিও বুনে দেন তাঁরা। আর এমন ১০ গুণী শিক্ষককে শিক্ষা ও নৈতিকতা প্রসারে অসামান্য অবদান রাখায় প্রদান করা হলো ‘আদর্শ শিক্ষক’ সম্মাননা।

এ তালিকায় রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় কিংবা সংগীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে চারুকলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একঝাঁক গুণী ও আদর্শ শিক্ষাগুরু। গত বুধবার বিকেলে রাজধানীর ইন্টারকনটিনেন্টাল হোটেলের ক্রিস্টাল বলরুমে এথিকস ক্লাব আয়োজিত দুই দিনব্যাপী নৈতিকতা দিবস উৎসবের প্রথম দিনে এ সম্মাননা প্রদান করা হয়। সংগীত পরিবেশনা ও কবিতা আবৃত্তি আয়োজনে যুক্ত করে ভিন্নমাত্রা।

সম্মাননাপ্রাপ্ত শিক্ষকেরা হলেন ছায়ানটের সভাপতি ও সংগীতজ্ঞ অধ্যাপক ড. সন্‌জীদা খাতুন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ইমেরিটাস অধ্যাপক রফিকুন নবী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. সৈয়দ আকরম হোসেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. অনুপম সেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক কায়সার হামিদুল হক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া, রাঙামাটির নারায়ণ গিরি সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক মু. নুরল মোস্তফা চৌধুরী, দিনাজপুর সংগীত কলেজের শিক্ষক গণেশ সরেন, সিরাজগঞ্জের রামকান্তপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক চমন আরাস্তা শিউলী ও বান্দরবানের মেঘলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মুহাম্মদ জসিম উদ্দিন। সন্‌জীদা খাতুন অসুস্থ থাকায় অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারেননি। অধ্যাপক অনুপম সেনের পক্ষে সম্মাননা গ্রহণ করেন পিএসসির সদস্য ড. সৈয়দ গোলাম ফারুক।

নৈতিকতা উৎসবের উদ্বোধন করেন বরেণ্য চিত্রশিল্পী রফিকুন নবী। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল মেডিসিন বিভাগের শিক্ষক জিয়াউদ্দিন আহমেদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক ফকরুল আলম। সভাপতিত্ব করেন এথিকস ক্লাব বাংলাদেশের সভাপতি এম ই চৌধুরী শামীম।

ক্লাবের ঘোষণাপত্র পাঠ করেন ক্লাবের প্রধান নির্বাহী দিলারা আফরোজ খান। শিক্ষকদের হাতে ‘আদর্শ শিক্ষক’ সম্মাননা স্মারক তুলে দেন ডা. দীপু মনি। স্মারকের পাশাপাশি প্রদান করা হয় তাঁদের বর্ণিল জীবনাশ্রিত শংসাবচন। উদ্বোধনী সংগীত ও জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়। এরপর এথিকস ক্লাবের প্রয়াত ১৭ উপদেষ্টাকে স্মরণ করা হয়।

সম্মাননাপ্রাপ্তির অনুভূতি প্রকাশে ইমেরিটাস অধ্যাপক রফিকুন নবী বলেন, ‘কথা ছিল আমি শুধু ছবি আঁকব ও চারুকলাবিষয়ক শিক্ষকতা করব। কিন্তু সময়টা এমন ছিল, নীতি বা নৈতিকতার কথা বলতে গিয়ে আমাকে কার্টুন আঁকতে হয়েছিল। তখন টোকাই চরিত্রের মাধ্যমে সমাজের অবক্ষয়কে তুলে ধরেছি। প্রতীকী কার্টুনের মধ্য দিয়ে নীতি-নৈতিকতার কথা বলতে হয়েছে। এই সম্মাননায় আমি একই সঙ্গে মুগ্ধ ও বিস্মিত। কারণ, এই সম্মাননার সঙ্গে নীতি ও নৈতিকতার বিষয়টি সম্পৃক্ত রয়েছে।’

অধ্যাপক সৈয়দ আকরম হোসেন বলেন, ‘আমি ৫৪ বছরে কোনো দিন ১ মিনিটও দেরি করে ক্লাসে যাইনি। আমি অনেক কিছু না হয়ে শিক্ষক হয়েছি। আমার শিক্ষকতা জীবনে অনেক পুরষ্কার পেয়েছি সেগুলো আনন্দ দিয়েছে, মুগ্ধ করেনি। আজকের এই পুরষ্কার পেয়েছি শিক্ষক হিসেবে। এটি আমাকে মুগ্ধ করেছে। আপনারাই প্রথম শিক্ষক হিসেবে আমাকে এই সম্মাননা দিয়েছেন।’

অধ্যাপক কনক কান্তি বড়ুয়া বলেন, একজন শিক্ষক প্রাইমারি স্কুল থেকে পোস্টডক্টরেট পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের নানাভাবে অনুপ্রেরণা দিয়ে তাঁদের জীবনকে প্রভাবিত করতে পারেন।

ফকরুল আলম বলেন, আজকে স্কুল-কলেজে ছাত্ররা ভালো ফলের লক্ষ্যে গাইড বই মুখস্থ করছে। তরুণেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন বিসিএস অফিসার হওয়ার জন্য। নীতি–নৈতিকতা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। তাই আজ নীতি–নৈতিকতার প্রসঙ্গ ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে দীপু মনি বলেছেন, ‘স্মার্ট নাগরিক হতে হলে সৎ, মানবিক ও নৈতিকতাবোধসম্পন্ন মানুষ হতে হবে। ২৫ জানুয়ারি জাতীয়ভাবে নৈতিকতা দিবস পালনের যে দাবি জানিয়েছে এথিকস ক্লাব, সেটি আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছে দেব। নিজের কাজটুকু ভালোভাবে করতে পারলে আমরা আরও উন্নত মানুষ হব। এথিকস ক্লাব বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে নৈতিকতা দিবস পালন করে আসছে এবং আদর্শ শিক্ষকদের সম্মাননা দিচ্ছে। এর মাধ্যমে আমরা প্রত্যন্ত অঞ্চলের আদর্শ শিক্ষকদের সম্পর্কে জানার সুযোগ পাই। শিক্ষকদের আদর্শ দেখে আমরা অনুপ্রাণিত হই।’

এম ই চৌধুরী শামীম বলেন, ‘বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অংশগ্রহণে সমাজে নৈতিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নানামুখী কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি নৈতিকতা দিবস পালন করে আসছে। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে নৈতিকতা দিবসের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য হয়ে পড়ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে গত এক যুগ আমরা ২৫ জানুয়ারি বাংলাদেশে নৈতিকতা দিবস পালন, আদর্শ শিক্ষক সম্মাননা এবং প্রয়াত উপদেষ্টাদের স্মরণ অনুষ্ঠান আয়োজন করে আসছি।’

সোনার বাংলাদেশ গড়তে সর্বত্র নীতি ও নৈতিকতা ছড়িয়ে দিতে হবে

সোনার বাংলাদেশ গড়তে সর্বত্র নীতি ও নৈতিকতা ছড়িয়ে দিতে হবে। এমন একটি প্রজন্ম দরকার, যারা নৈতিকতা বোধসম্পন্ন মানুষ, যারা যুক্তি দিয়ে চিন্তা করে। দেশের জন্য ভালো কিছু করতে দেশকে ভালোবাসতে হবে, দেশকে ভালো রাখতে হবে। গত বৃহস্পতিবার ২৫ জানুয়ারি বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এথিকস ক্লাব বাংলাদেশ সোসাইটির পক্ষ থেকে ১৩তম নৈতিকতা দিবসের আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন। এতে জাতীয়ভাবে নৈতিকতা দিবস ঘোষণার দাবি জানিয়েছে এথিকস ক্লাব বাংলাদেশ।

এ ছাড়া জাতীয় নৈতিকতা দিবসের দাবি উত্থাপন এবং আন্তবিশ্ববিদ্যালয় বিজয় বিতর্ক উৎসবের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়েছে। অনুষ্ঠানে রাজধানীর প্রায় ৫০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় ১ হাজার শিক্ষার্থী অংশ নেয়। অনলাইনে যুক্ত হয়ে শপথ পাঠ করান অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি অর্থনীতিবিদ, উন্নয়ন চিন্তাবিদ ও পরিবেশকর্মী কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ। তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ গড়তে শিশুদের প্রতি আহ্বান জানান।

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক পরিচালক জামালউদ্দিন আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. এম এম আকাশ এবং ঢাকা মেডিকেলের উপাধ্যক্ষ শিশুবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আব্দুল হানিফ। এথিকস ক্লাব বাংলাদেশের সভাপতি এম ই চৌধুরী শামীমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন এথিকস ক্লাব বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী দিলারা আফরোজ খান রূপা। কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা আবৃত্তি করেন শিল্পী টিটু মুনশি। অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে ফিলিস্তিনে নিহত মানুষদের স্মরণ করা হয় ও এ নিয়ে খালি গলায় গান পরিবেশন করেন দিলারা আফরোজ খান। গানের সঙ্গে সঙ্গে বেলুন উড়িয়ে নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করে শিশুরা। অনুষ্ঠান শেষে চাঁপাইনবাবগঞ্জের একটি দল গম্ভীরা গান পরিবেশন করে।

অনলাইনে যুক্ত হয়ে এথিকস ক্লাবের শপথ পাঠ করান অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ। তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ গড়তে শিশুদের প্রতি আহ্বান জানান।

অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, এমন একটি প্রজন্ম দরকার, যারা নৈতিকতা বোধসম্পন্ন মানুষ, যারা যুক্তি দিয়ে চিন্তা করে। সমাজকে বদলাতে হলে নিজেকে বদলাতে হবে। অন্যায় করা যাবে না, আবার অন্যায় সহ্য করাও যাবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক পরিচালক জামালউদ্দিন আহমেদ বলেন, ভালো মানুষ হওয়া জরুরি। শিশুকাল থেকে ভালো কাজের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। ঢাকা মেডিকেলের উপাধ্যক্ষ শিশুবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আব্দুল হানিফ বলেন, দেশকে ভালোবাসতে হবে, দেশকে ভালো রাখতে হবে। একজন মানুষ যা চায়, তা করতে পারে, সে জন্য আত্মবিশ্বাসী হতে হবে।

এথিকস ক্লাব বাংলাদেশের সভাপতি ও প্রতিষ্ঠাতা এম ই চৌধুরী শামীম বলেন, ‘আমরা ১৩ বছর ধরে নিজেদের উদ্যোগে নৈতিকতা দিবস পালন করে আসছি। সারা দেশে ২০০টির বেশি এথিকস ক্লাব রয়েছে। আমরা ২৫ জানুয়ারি দিনটিকে জাতীয় নৈতিকতা দিবসের দাবি জানিয়ে আসছি দীর্ঘদিন ধরে। আজ আবারও সেই দাবি জানাচ্ছি। জাতীয় নৈতিকতা দিবস পালন করতে সরকারের কোনো অতিরিক্ত বাজেট লাগবে না, শুধু একটি প্রজ্ঞাপন দরকার। সারা দেশে জাতীয়ভাবে নৈতিকতা দিবস পালিত হলে শিশুরা প্রথম শ্রেণি থেকে নৈতিকতা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের সুযোগ পাবে। এর মাধ্যমে তারা নৈতিক মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে।’

অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে ফিলিস্তিনে নিহত মানুষদের স্মরণ করা হয় ও এ নিয়ে খালি গলায় গান পরিবেশন করেন দিলারা আফরোজ খান।

২০০৮ সালে এথিকস ক্লাব বাংলাদেশ সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এথিকস ক্লাব বাংলাদেশ সোসাইটি বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অংশগ্রহণে সমাজে নৈতিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নানামুখী কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি ‘নৈতিকতা দিবস’ পালন করে আসছে। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে নৈতিকতা দিবসের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য হয়ে পড়ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে গত এক যুগ বাংলাদেশ নৈতিকতা দিবস পালন, আদর্শ শিক্ষক সম্মাননা এবং প্রয়াত উপদেষ্টাদের স্মরণ অনুষ্ঠান আয়োজন করে আসছে।

প্রতিষ্ঠাতাদের কথা

বিশ্বায়নের অভিঘাতে কিছু পুরোনো সংকটের সমাধান হলেও নতুন নতুন সংকট সামনে আসছে। তাতে নৈতিকতাসম্পর্কিত আলোচনা আবার নতুন মাত্রা নিয়ে শুরু হয়েছে। নৈতিকতা কী, এর আবশ্যক ভিত্তি, ব্যক্তি ও সমাজজীবনে নৈতিকতা কতটা অপরিহার্য, এসব প্রশ্ন সামনে আসছে। দেখা যাচ্ছে, সংকটের তীব্রতা বৃদ্ধির সঙ্গে নৈতিক বিচ্যুতির একটি যোগসূত্র আছে। তাই নৈতিকতার সংকট থেকে উত্তরণের জন্য মানুষের নৈতিক জাগরণ অপরিহার্য।

বাঙালি জীবনের বিভিন্ন সংকট-মুহূর্তেও চিন্তাশীল মানুষেরা নৈতিকতা নিয়ে আলোচনায় অবতীর্ণ হয়েছেন। এখন প্রায় সবার কাছেই, সব ক্ষেত্রে নৈতিকতা চর্চার প্রয়োজন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ আজ বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই নানা সংকটে জর্জরিত। রাজনৈতিক অবিশ্বাস, অর্থনৈতিক বৈষম্য, পরিবেশ বিপর্যয়, আর্থিক সন্ত্রাস, সাংস্কৃতিক ও মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে। এতে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও বাংলাদেশের অবস্থা নাজুক হয়ে যেতে পারে। ফলে সরকারি উচ্চ পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত জাতীয়ভাবে নৈতিকতার পুনরুজ্জীবন নিয়ে ভাববার সময় এসেছে।

এথিকস ক্লাব বাংলাদেশের সভাপতি ও প্রতিষ্ঠাতা এম ই চৌধুরী শামীম

স্বাধীন বাংলাদেশের গর্বিত মানুষেরা অগ্রসর হতে চেয়েছে। লক্ষ্য ছিল সুখী-সুন্দর বাংলাদেশ। যেখানে সৎ ও যোগ্য মানুষ পাবেন তাঁর প্রাপ্য স্থান। দারিদ্র্যমুক্ত ও মানবিক সমাজ নির্মিত হবে। মানুষ ভেদাভেদ ভুলে সুশাসনে প্রীত হবে। অথচ প্রত্যাশার প্রাপ্তি ঘটেনি। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিস্তৃত হয়েছে দুর্নীতি। জাতি প্রত্যাশিত গন্তব্য থেকে এখন অনেক দূরে। মানবিকতাশূন্য নেতিবাচক ধ্যান-ধারণা দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে সম্ভাবনাময় তরুণসমাজ। নেশায় আসক্তি, লাভ ও লোভের সীমাহীন স্বার্থান্ধ হিসাব, দেশপ্রেমহীন জীবনাচরণ এবং দেশমাতৃকাকে অবহেলা ও উপেক্ষা করে সমৃদ্ধির প্রত্যাশায় দেশত্যাগের প্রবণতাও প্রবল হয়েছে। মানুষের প্রতি মানুষের যে দায়িত্ব বা কর্তব্য, তা পালন করা হচ্ছে না। কিন্তু কেনো আমরা এমন ভাঙনের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালাম? উত্তর, আমরা নৈতিকভাবে কাম্য সুদৃঢ় অবস্থানে নেই। আমরা কল্যাণ ও সুন্দরের সাধনায় নিবেদিত নই। আমরা শ্রেয়র ভাবনায় যথার্থ মনোযোগী হইনি। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ প্রয়োজন।

আমরা মনে করি কেবল পাঠ্যপুস্তক ও মুখস্থনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থায় কোনোভাবেই সৎ, দেশপ্রেমিক ও উন্নত মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন মানুষ নির্মাণ সম্ভব নয়। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় সনদনির্ভর চাকরিপ্রত্যাশী মানুষ সৃষ্টি সম্ভব হলেও তা দিয়ে জাতিকে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।

অপর দিকে সর্বস্তরে দুর্নীতির কারণে দেশের সম্পদ নিঃশেষ হচ্ছে। দুর্নীতিতে নিমজ্জিত দেশপ্রেমহীন কিছু ব্যক্তির প্রভাবে দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের পথ ধরে এখন তার সামাজিকীকরণ ঘটছে। হতাশাগ্রস্ত তারুণ্য ধাবিত হচ্ছে বিভ্রান্তির পথে। সামাজিক ও সামষ্টিক ভাবনার পরিবর্তে ব্যক্তির মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবোধ তৈরি হচ্ছে। এ অবস্থায় প্রয়োজন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন, সৎ, দেশপ্রেমিক, নৈতিকতাসম্পন্ন মানবিক মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা, যা অধোগতিকে রোধ করতে পারে। এজন্য একটি সার্বিক ও দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন। এ আন্দোলন দেশকে উপহার দেবে একটি সৎ, দেশপ্রেমিক, নৈতিকতাবোধসম্পন্ন, মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন, অসাম্প্রদায়িক, নৈতিক ও মানবিক নতুন প্রজন্ম।

এথিকস ক্লাব বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী দিলারা আফরোজ খান রূপা

পূর্বোক্ত সত্য স্বীকার করে নিয়ে বলতে চাই, আমরা হতাশ নই। আমরা সুস্থ ও সুন্দরভাবে বাঁচতে চাই। মূল্যবোধের অভাবহেতু মুমূর্ষু মানবিকতা রক্ষা করার জন্য আমরা সংগ্রাম করতে চাই। আমরা নীতি, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, মানবিকতা ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে চাই। আমরা একটি প্রজন্ম নির্মাণ করতে চাই, যারা শ্রেয় মূল্যবোধসম্পন্ন হবে এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আমরা একটি মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন, সচেতন, সৎ, দেশপ্রেমিক ও মানবিক দৃষ্টিসম্পন্ন নতুন প্রজন্ম গড়ে তুলতে চাই।

জাতীয় রাজনীতি ও প্রশাসনে নেতৃত্বের সংকট দেখা দিয়েছে। ভবিষ্যতে এ সংকট আরও প্রকট হতে পারে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তোলা প্রয়োজন। এ কাজ সহজসাধ্য নয়। কঠিন, বিশাল ও দীর্ঘ সাধনালব্ধ এ কাজ করার মানসে আমরা গঠন করেছি এথিকস ক্লাব বাংলাদেশ। দেশের সর্বস্তরে নৈতিকবোধসম্পন্ন, মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন ও অসাম্প্রদায়িক উচ্চ মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন জাতীয় সংস্কৃতি গড়ে তুলতে এবং সমাজের সর্বত্র গণতান্ত্রিক চর্চা শক্তিশালী করার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা গ্রহণ করবে এথিক্‌স ক্লাব বাংলাদেশ।

বিস্তারিত জানতে: www.ethicsclub.org

সৌজন্য