এ যেন ইউজিসিকে ‘বুড়ো আঙুল’ দেখানোর প্রতিযোগিতা

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে (ইউজিসি) ‘বুড়ো আঙুল’ দেখানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ইউজিসির সিদ্ধান্তকে অমান্য করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তি পরীক্ষার আবেদন ফি বাড়িয়েই চলছে। সর্বশেষ গতকাল সোমবার ২২টি সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন্ন শিক্ষাবর্ষে (২০২১-২২) স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে গুচ্ছ ভিত্তিতে ভর্তি পরীক্ষার আবেদন ফি একলাফে ৩০০ টাকা বাড়িয়েছে।

শুধু ভর্তি পরীক্ষার আবেদন ফির ক্ষেত্রেই নয়, নিয়োগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রেই ইউজিসির আদেশ-নির্দেশকে উপেক্ষা করে চলছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ইউজিসিও অসহায়। কার্যকর ক্ষমতা না থাকায় তারাও কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। এ কারণে দেশের উচ্চশিক্ষা দেখভালের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানটি কার্যত একটি ‘নখদন্তহীন বাঘে’ পরিণত হয়েছে।

ইউজিসির চেয়ারম্যানের রুটিন দায়িত্বে থাকা সদস্য দিল আফরোজা বেগমের কথাতেও অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ইউজিসি বড়জোর বাজেট বন্ধ করে দিতে পারে। এখন ভর্তি পরীক্ষার অতিরিক্ত ফি নেওয়ার কারণে ইউজিসি যেটি করবে, সেটি হলো ফি কমিয়ে যৌক্তিক করার শর্তে ভর্তি ফি বাবদ আয়ের ৪০ শতাংশ টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটে জমা না দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, তা পরিবর্তন করা হবে।

এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট দেওয়ার সময় এই ৪০ শতাংশ টাকা কেটে রাখা হবে। নিয়োগের ক্ষেত্রেও বাজেট দেওয়া বন্ধ করা হয়। গত ৭ এপ্রিল উপাচার্যদের সঙ্গে ইউজিসির এক সভায় দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষার ফি আনুপাতিক হারে কমিয়ে ‘যৌক্তিক’ করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তখন ঠিক হয়েছিল, ফি কমিয়ে যৌক্তিক করলে আগে যেভাবে ভর্তি ফি বাবদ আয়ের ৪০ শতাংশ টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটে জমা দিতে হতো, সেটি দিতে হবে না।

কিন্তু ইতিমধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এ বছরের জন্যই ভর্তি পরীক্ষার আবেদন ফি বাড়িয়েছে। আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় না কমিয়ে আগের ফি বহাল রেখেছে। এর মধ্যে এখন সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছ ভিত্তিতে ভর্তি পরীক্ষার আবেদন ফিও বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হলো। গতবার এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার আবেদন ফি ছিল ১ হাজার ২০০ টাকা। এবার এই ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার ৫০০ টাকা।

অথচ গত ৭ এপ্রিল ইউজিসির ওই সভায় এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরাও উপস্থিত ছিলেন। সেদিন তাঁরা ভর্তি পরীক্ষার ফি আনুপাতিক হারে কমিয়ে ‘যৌক্তিক’ করার সিদ্ধান্তে দ্বিমতও করেননি। এবার ভর্তি পরীক্ষার আবেদন ফি বাড়ানোর কারণ জানতে চাইলে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, সবদিক বিবেচনা করে উপাচার্যরা একমত হয়ে ফি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

এ বছর ২২টি সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছভুক্ত হয়ে স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে ভর্তি পরীক্ষা নেবে। আগের ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন প্রতিষ্ঠিত কিশোরগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় এবং চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

আরও পড়ুন

আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল আগামী সেপ্টেম্বর মাসে। কিন্তু এখন পরীক্ষার সময় এগিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। গুচ্ছে থাকা বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সাদেকুল আরেফিন প্রথম আলোকে বলেন, নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৩০ জুলাই, ১৩ আগস্ট এবং ২০ আগস্ট তিন ইউনিটের তিনটি ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। কবে থেকে ফরম বিতরণ শুরু হবে, জানতে চাইলে সাদেকুল আরেফিন বলেন, আগামী ৫ জুন পরবর্তী সভায় এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।

চেয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই ইউজিসির

দেশের উচ্চশিক্ষাকে যুগোপযোগী করার পাশাপাশি দেখভালের জন্য ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ইউজিসি। পরের বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউজিসি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিধিবদ্ধ হয়। মাত্র ৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ইউজিসির যাত্রা শুরু হয়েছিল। বর্তমানে দেশে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে মোট বিশ্ববিদ্যালয় ১৬০টি।
কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা নামকাওয়াস্তে।

এ জন্য সংস্থাটি সরকারের কাছে বিভিন্ন সময় নানা রকম সুপারিশ করে বাস্তবায়নের জন্য চেয়ে থাকে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেখা যাচ্ছে, ইউজিসির অধিকাংশ সুপারিশই বাস্তবায়িত হয় না। বার্ষিক প্রতিবেদনের পাশাপাশি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়মের অভিযোগ তদন্ত করে বিভিন্ন সুপারিশ দিয়ে প্রতিবেদন দিলে সেগুলোও খুব একটা আলোর মুখ দেখে না। উপরন্তু, ইউজিসিকে আইনগতভাবে আরও কার্যকর ও শক্তিশালী করার উদ্যোগও থামিয়ে রাখা হয়েছে।

ক্ষমতাহীন প্রতিষ্ঠান হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও আর ইউজিসির আদেশ-নির্দেশ মানতে চায় না। সর্বশেষ ইউজিসির নির্দেশনা অমান্য করে আবারও দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। এবার কোনো ধরনের বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই কর্মকর্তাদের আত্মীয়সহ ২০ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। চলতি মে মাসে তাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এসব পদে নিয়োগ দিতে ইউজিসির অনুমোদন নেওয়া হয়নি। অথচ দৈনিক ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে ইউজিসির নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

এর আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ নিয়ে ‘কেলেঙ্কারি’ হয়েছে। কিন্তু কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা হয়নি।

আদেশ-নির্দেশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপেক্ষা করার বিষয়ে ইউজিসির শীর্ষস্থানীয় এক কর্মকর্তা আজ মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের পক্ষে করার কী আছে?’ অর্থাৎ ইউজিসির এই কর্মকর্তার এক লাইনের এ বক্তব্যেই বোঝা যায়, ইউজিসি দেশের উচ্চশিক্ষায় কতটা ভূমিকা রাখতে পারে।