রাষ্ট্র কি শুধু শিক্ষকদের বেলায় এসে দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে

ছবি: ফ্রিপিকডটকম

‎সময়ের আবর্তে প্রতিবছর বিশ্ব শিক্ষক দিবস আসে। দিনটি যেন অন্তরে অদৃশ্য ঘণ্টাধ্বনি বাজিয়ে স্মরণ করিয়ে দেয়—জাতি গঠনের মূল কারিগর শিক্ষক। মানুষের ভেতর মানুষ গড়ে তোলার যে পবিত্র সাধনা, তার অনন্য বাহক হলেন শিক্ষক। তাই বলা হয়, একজন শিক্ষক হাজার সৈন্যের চেয়েও শক্তিশালী; কারণ, তিনি জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাণ করেন। অথচ আজ, বিশ্ব শিক্ষক দিবসে, এ প্রশ্নটিই বারবার কানে বাজে—রাষ্ট্র কি সত্যিই দরিদ্র? অন্য পেশার তুলনায় শিক্ষকদের বেতন, সুযোগ-সুবিধা, সম্মান—সবকিছুতেই বৈষম্যের ভারী ছায়া। রাষ্ট্রের নানা খাতে প্রাচুর্যের প্রদর্শনী থাকলেও শিক্ষকদের প্রসঙ্গ এলেই যেন রাষ্ট্র হঠাৎ ‘গরিব’ হয়ে পড়ে।

গত নির্বাচনের সময় জনপ্রশাসন সচিব ২৬১টি নতুন এসইউভি মডেলের (মিতসুবিশি পাজেরো স্পোর্টস কিউ এক্স) গাড়ি কেনার প্রস্তাব করেছিলেন, জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের জন্য। প্রস্তাবিত গাড়িগুলোর প্রতিটির দাম অন্তত অর্ধকোটি টাকার কাছাকাছি। একই প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে এবারের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। অথচ অতীতের ন্যায় দেশে ডলার-সংকট, মূল্যস্ফীতি চরমে, সরকার বিদ্যুৎ ও সারের জন্য নগদ অর্থ দিতে না পেরে বন্ড ছাড়তে হচ্ছে। গ্যাস ও বিদ্যুৎ আমদানির অর্থও বকেয়া থাকছে।

ছবি: ফ্রিপিকডটকম

রাষ্ট্র যখন মন্ত্রী-সচিবদের জন্য বিলাসবহুল গাড়ি বরাদ্দ করে, কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন ভবন নির্মাণ করে, তখন কোনো বাজেট সমস্যা হয় না। যখন প্রজাতন্ত্রের অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তা একাধিক পদোন্নতি পান, বাড়তি বেতন-ভাতা কিংবা বিদেশ সফরের সুযোগ পান, তখন রাষ্ট্র থাকে উদার। কিন্তু রাষ্ট্র যেন হঠাৎ নিঃস্ব হয়ে পড়ে শুধু শিক্ষকদের জন্য—পদোন্নতির বাজেট থাকে না, শিখন উপকরণের জোগান নেই, গৃহঋণের বরাদ্দ অপ্রতুল, প্রশিক্ষণের পর্যাপ্ত সুযোগ থাকে না, উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের সীমিত সুযোগও কেড়ে নেওয়া হয়, মর্যাদার ন্যূনতম স্বীকৃতিও নীতিবাক্যে সীমাবদ্ধ!

এবার ব্যাংক খাতের দিকে তাকাই। সোনালী ব্যাংকে প্রায় ১৮ হাজার ১৬৭ কর্মকর্তা-কর্মচারী, জনতায় ১৪ হাজার ৩২৩ এবং অগ্রণী ব্যাংকে ১০ হাজার ৬৭৭ জন। এসব ব্যাংকে বছরে ৫টি বোনাস (৩টি ইনসেনটিভ এবং ২টি উৎসবভাতা), প্রতিদিন দুপুরে ৪০০ টাকা লাঞ্চ ভাতা, গৃহঋণ, গাড়ি ক্রয় সুবিধা এবং অন্য নানা আর্থিক সুযোগ-সুবিধা পান। প্রশ্ন হলো, এই ব্যয় যদি ব্যাংকগুলো বহন করতে পারে তবে সেই একই রাষ্ট্র স্নাতকোত্তর থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য কেন ব্যয় করতে পারে না? শিক্ষক-কর্মকর্তাদের সময়মতো পদোন্নতি, গ্রেড ও মর্যাদা দিতে পারে না কেন?

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

রাষ্ট্র কি কেবল শিক্ষকদের বেলায় এসে দরিদ্র হয়ে যায়? অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি খাতে কাজ করেও শিক্ষকদের অবস্থান যেন দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের মতো। পদোন্নতি নেই, প্রণোদনা নেই, যাতায়াতের জন্য যানবাহন নেই, লাঞ্চ ভাতা নেই, স্বীকৃতি নেই—আছে শুধু দায়িত্ব আর অবহেলা।

ছবি: ফ্রিপিকডটকম

কেন এই বৈষম্য? যেন রাষ্ট্রের চোখে শিক্ষক শুধু দায়সারা কাজ করা এক শ্রেণির মানুষ, যাঁদের কোনো চাওয়া-পাওয়া, উন্নয়ন কিংবা মর্যাদার অধিকার থাকতে নেই। রাষ্ট্র কি ভুলে যাচ্ছে—এই শিক্ষকই বিচারপতির ন্যায়বোধ গড়েন, সেনা কর্মকর্তার শৃঙ্খলাবোধ তৈরি করেন, একজন সচিবের বিবেচনাবোধ গড়ে দেন, এমনকি একজন মন্ত্রীর ভাষার কাঠামো তৈরি করেন?

আরও পড়ুন

‎তবু শিক্ষক থাকেন অবহেলিত, নীরবে কর্তব্যরত। অতএব হ্যাঁ, প্রশ্নটা আজ অনিবার্য হয়ে উঠেছে—রাষ্ট্র কি কেবল শিক্ষকের বেলায় এসে দরিদ্র হয়ে যায়? না হলে কেন যে প্রাথমিক শিক্ষক শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ জীবনের মূল ভিত নির্মাণ করেন, তাঁরা এখনো রাষ্ট্রের তৃতীয় শ্রেণির চাকুরে? দীর্ঘদিন ১৪তম ও ১৩তম গ্রেডে চাকরির পর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এখনো ১২তম গ্রেডে চাকরি করছেন, ১১তম গ্রেড নির্ধারণের জন্য আন্দোলন করতে হচ্ছে তাঁদের। প্রধান শিক্ষকদের দশম গ্রেড পেতে শেষ পর্যন্ত আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়েছে, তাও শতভাগ প্রধান শিক্ষকের দশম গ্রেড প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়নি এখনো।

এত অপ্রাপ্তির সঙ্গে আছে পদোন্নতি না পাওয়া। বেশির ভাগ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ২৫ থেকে ৩০ বছর চাকরি করেও কোনো পদোন্নতি পান না। অল্প কিছু সংখ্যক প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি পেলেও সেটা পুরো চাকরিজীবনে একটা মাত্র পদোন্নতি! যেখানে রাষ্ট্রের অন্যান্য কর্মচারী পুরো চাকরিজীবনে ৩/৪/৫টি পদোন্নতি পান, সেখানে জাতি গড়ার প্রধান কারিগরেরা ১টি বা পদোন্নতিশূন্যতা নিয়ে অবসরে যান! গত সেপ্টেম্বরেও ১৪তম গ্রেডের সাঁট-মুদ্রাক্ষরিক কাম-কম্পিউটার অপারেটর পদ থেকে সরাসরি নবম গ্রেডের উপজেলা/থানা নির্বাচন অফিসার পদে পিএসসি পদোন্নতির সুপারিশ করেছে। উচ্চমান সহকারী প্রমোশন পেয়ে হন দ্বিতীয় সচিব (নবম গ্রেড), ড্রাইভার প্রমোশন পেয়ে হন উপসহকারী প্রকৌশলী—কিন্তু জনমদুঃখী প্রাথমিকের শিক্ষকেরা গ্রেড-৯–এ গিয়ে চাকরি শেষ করতে পারেন না, তাঁদের প্রথম শ্রেণির চাকুরে বানিয়ে অবসরে পাঠানোর উদারতাটুকুও রাষ্ট্রের কাছে দেখা যায় না!

মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকেরা দশম গ্রেডে চাকরি শুরু করে নবম গ্রেডে পদোন্নতি পেতে যুগ পার করতে হয়। অল্প সংখ্যক সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সহকারী প্রধান বা প্রধান শিক্ষক হতে পারেন! তাঁদের মধ্যে যাঁরা খুব সৌভাগ্যবান, তাঁরা হয়তো চতুর্থ গ্রেড পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেন ৩০ থেকে ৩২ বছর চাকরি করেও! শহরের অধিকাংশ এমপিওভুক্ত কলেজের শিক্ষকেরা বিশেষ করে বিভিন্ন বাহিনী পরিচালিত কলেজের শিক্ষকেরা (৪০ থেকে ৫৫) শতাংশ বাড়ি ভাড়া ভাতার সঙ্গে অতিরিক্ত (১০ থেকে ৩০) শতাংশ সিটি অ্যালাউন্স বা অন্য ভাতা পেলেও জেলা-উপজেলা পর্যায়ের সরকারি বা এমপিওভুক্ত কলেজের শিক্ষকেরা অনেকটাই বঞ্চিত। এখনো তাঁরা মূল বেতনের মাত্র ২০ শতাংশ বাড়ি ভাতার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করে যাচ্ছেন, আশ্বাস ও দীর্ঘসূত্রতার ঘেরাটোপে যা আজও বন্দী। বর্তমানে তাঁরা মাত্র ১০০০ টাকা বাড়ি ভাড়া ভাতা ও ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা পান!

বিসিএস ক্যাডারের শিক্ষক ও অন্য ক্যাডারের তুলনা—

সরকারি কলেজ শিক্ষক তথা বিসিএস সাধারণ ক্যাডারের শিক্ষকেরাও অন্য ক্যাডারের তুলনায় পাহাড়সম বঞ্চনার শিকার। পদোন্নতি যোগ্য প্রভাষকদের এক যুগের বেশি সময় ধরে প্রভাষক, পদোন্নতির দাবিতে ব্যানার হাতে নিয়মিত রাজপথে দাঁড়াতে হচ্ছে। ৩৭ ব্যাচ পর্যন্ত সকলেই পদোন্নতির যোগ্যতা অর্জন করে কর্মজীবনের সপ্তম বছরে পদার্পণ করেছেন, অথচ অন্যান্য ক্যাডারের ৩৭তম ব্যাচের কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়েছেন ২০২৪ সালেই। বিপ্লবের পরে কোনো কোনো ক্যাডারে একই টায়ারে একাধিকবার পদোন্নতি হয়েছে, কারও এপিটাফে লেখা হয়েছে গ্রেড ওয়ান, আর শিক্ষা ক্যাডারের প্রভাষকদের ৭ থেকে ১২ বছর পদোন্নতিশূন্যতায় জীবন জেরবার।

একই চিত্র সহকারী অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপকের ক্ষেত্রেও। অন্তত ৪০০০ সহকারী অধ্যাপক পদোন্নতিযোগ্য হলেও ১২ থেকে ১৭ বছরে তাঁরা একটিমাত্র পদোন্নতি নিয়ে অপেক্ষায় আছেন সহযোগী অধ্যাপক হওয়ার। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ১২ বছরে অধ্যাপক হলেও শিক্ষা ক্যাডারের ২১-২৫ ব্যাচ ২০ থেকে ২২ বছর চাকরি করেও অধ্যাপক হতে পারেননি। আর শিক্ষা ক্যাডারের শিক্ষকদের বেতন স্কেলের প্রথম গ্রেডে পৌঁছানো যেন স্বপ্ন! ২০০৯ সালের বেতন স্কেলে যা–ও অধ্যাপকদের ৫০ শতাংশ তৃতীয় গ্রেড পাওয়ার সুযোগ ছিল, ২০১৫ সালের বেতন স্কেলে সে পথও রুদ্ধ হয়। অথচ অভিন্ন সিলেবাস, অভিন্ন প্রশ্নপত্র ও জাতীয় ভিত্তিক তীব্র প্রতিযোগিতামূলক অভিন্ন পরীক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে নিয়োগ পেলেও বিশেষ কয়েকটি ক্যাডারের জন্য গ্রেড-১ সুবিধা অবারিত। দেশের ৫৩টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৬ হাজার ৮০৫ জন শিক্ষকের প্রত্যেকের কর্মজীবনে গ্রেড-১–এ যাওয়ার সুযোগ থাকলেও শিক্ষা ক্যাডারের শিক্ষকসহ সিভিল এডুকেশনের শিক্ষকেরা গ্রেড-১, ২, ৩ পাওয়ার সুযোগবঞ্চিত।

শিক্ষকদের মধ্যে পদোন্নতির দিক দিয়ে সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও নানা বৈষম্য আর সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা এখনো গাড়ি সুবিধাবঞ্চিত, অথচ তাঁদের চেয়ে নিম্ন বেতন গ্রেডের পঞ্চম থেকে প্রথম গ্রেডের উপসচিব ও তদূর্ধ্বরা গাড়ি সুবিধা থেকে বাবুর্চি সুবিধা পর্যন্ত পান! এমনকি ব্যাংকের কর্মকর্তারাও গাড়ির সুবিধা উপভোগ করছেন। শিক্ষকেরা ক্লাসে পড়ান, লেখাপড়া করে যে, গাড়ি-ঘোড়ায় চড়ে সে। অথচ যিনি লেখাপড়া করান, তাঁর ভাগ্যে গাড়ি-ঘোড়া জোটে না!

ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে কী অবস্থা

রাষ্ট্র যে শিক্ষকদের বেতন বা আর্থিক সুবিধার ক্ষেত্রে কার্পণ্য করছে তা নয়, দায়িত্ব ও মর্যাদার প্রশ্নেও রাষ্ট্র শিক্ষকদের নিম্নতর অবস্থানে রেখে যেন স্বস্তি পায়। বর্তমানে রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রম বা ‘ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স’-এর ১৯তম অবস্থানে জাতীয় অধ্যাপক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র অধ্যাপকেরা। অথচ একই বেতন গ্রেডভুক্ত সরকারের সচিবদের অবস্থান ১৬তম।

ছবি: ফ্রিপিকডটকম

শিক্ষা প্রশাসন ও শিক্ষা ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন দপ্তরে শিক্ষকদের নিয়োগ-পদায়ন সুবিধাও সীমীত করে ফেলা হচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের পদগুলো বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের পদ হলেও সেসব দপ্তরের পদগুলোয় অশিক্ষকদের নিয়োগ-পদায়ন হচ্ছে। মাঠপর্যায়ে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা শিক্ষার প্রশাসনিক দপ্তরগুলোয় অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করে শিক্ষার মানোন্নয়ন করা সহজ হতো। শিক্ষাসংক্রান্ত দপ্তরগুলোয় শিক্ষা সার্ভিসবহির্ভূতদের পদায়নের ফলে শিক্ষার মানেরও অবনমন হয়েছে সর্বক্ষেত্রে।

উপানুষ্ঠানিক ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরগুলো শিক্ষকদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে নেওয়ার পর থেকেই এ ক্ষেত্রগুলোর মান ক্রমাগত অবনমন শুরু হয়েছে। জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, যে প্রতিষ্ঠানগুলো একসময় স্বাক্ষরতার হার বৃদ্ধির প্রধান ভরসা ছিল, আজ আর তারা আগের মতো শিক্ষার প্রসারে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা তার পূর্বের গৌরব হারিয়েছে, আর প্রাথমিক শিক্ষকদের হাতছাড়া হওয়ার পর প্রাথমিক শিক্ষার মানও দৃশ্যমানভাবে কমে গেছে। তবু বিসিএস সাধারণ শিক্ষার স্বার্থ উপেক্ষা করে এ খাতকে শিক্ষকশূন্য করার নানা উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে। বাস্তবতার নিরিখে বলতে হয়—‘বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। শিক্ষাও কেবল তখনই পূর্ণতা পায়, যখন তা শিক্ষকের হাতেই থাকে।’

রাষ্ট্র অফিসারদের মুঠোফোন-ইন্টারনেট ভাতা দিয়ে আসছে সেই ২০১৮ সাল থেকে, কিন্তু শিখন-শেখানো কার্যক্রমে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার থাকলেও শিক্ষকদের বেলায় সেখানেও রাষ্ট্রের কার্পণ্য! শিক্ষক শুধু পাঠদান করেন না; তিনি কীভাবে শিখনকে আরও আকর্ষণীয়, জীবন্ত ও জীবনঘনিষ্ঠ করবেন—সেই কৌশল খুঁজে বের করেন। এ জন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষণ, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, গবেষণা ও নতুন পদ্ধতির অনুশীলন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় বাজেটে শিক্ষকদের এই শিখন-শেখানো কৌশল উন্নয়নে বরাদ্দ প্রায় নেই বললেই চলে। পাঠ্যবই মুদ্রণের জন্য অর্থ আছে, ভবন নির্মাণের জন্য অর্থ আছে, কিন্তু শিক্ষকের দক্ষতা উন্নয়ন ও শ্রেণিকক্ষকে প্রাণবন্ত করার জন্য অর্থ নেই।

দেখা যায়, Strengthening প্রকল্পের অধিকাংশ বৃত্তিই প্রশাসন ক্যাডারের জন্য বরাদ্দ থাকে; বাকি ২৫টি ক্যাডারের জন্য বরাদ্দ থাকে অতি সামান্য অংশ, যদিও উচ্চশিক্ষার বৃত্তি শিক্ষক সমাজের জন্য অধিক প্রয়োজনীয়। অন্যদিকে কমনওয়েলথ স্কলারশিপের ক্ষেত্রেও উচ্চ মাধ্যমিক থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা উপেক্ষিত। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণা বাজেটের চিত্রও অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। বাংলাদেশের বেশির ভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বাজেট মোট বাজেটের ২-৩ শতাংশের বেশি নয়। বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে জ্ঞান দান ও নতুন জ্ঞান সৃষ্টির আলয়। অথচ নতুন জ্ঞান সৃষ্টি তথা গবেষণা খাত বিনিয়োগ ছাড়া আশানুরূপ গতি লাভ করে না।

আজকের শিক্ষা বিশ্ব আর কেবল ব্ল্যাকবোর্ড-খাতায় সীমাবদ্ধ নয়। এখন ব্লেন্ডেড টিচিং মেথড, অর্থাৎ অনলাইন ও অফলাইন শিক্ষার সমন্বিত যুগ। এজন্য দরকার পর্যাপ্ত ডিজিটাল টুলস: ডেস্কটপ, ল্যাপটপ, প্রজেক্টর, উচ্চগতির ইন্টারনেট। অথচ বাস্তবতা হলো—আমাদের অধিকাংশ শিক্ষক এখনো নিজের অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল কিংবা একটি সাধারণ ট্যাব পর্যন্ত পাননি। নেই ইন্টারনেট খরচের জন্য ভাতা, নেই ডিজিটাল টুলস ব্যবহারের জন্য সহায়তা। রাষ্ট্রের বরাদ্দ যায় দপ্তরের আরামকেদারায় বসা কর্মচারীদের জন্য; অথচ যিনি শ্রেণিকক্ষে দাঁড়িয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ছেন, তিনি থেকে যান ডিজিটাল অন্ধকারে। বিপরীতে ডিজিটাল সুবিধা বরাদ্দ হয় কর্মকর্তাদের জন্য, ২০২১ সালে উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের জন্য বিতরণ করা হয় ৪৯,০০০ ট্যাব!

কিন্তু এভাবে কি চলতে পারে? একটি দেশ তখনই এগিয়ে যায় যখন তার শিক্ষাব্যবস্থা শক্তিশালী হয়। আর শক্তিশালী শিক্ষাব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি হলেন একজন যোগ্য, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ও আর্থিকভাবে সচ্ছল শিক্ষক। শিক্ষক যদি নিজের জীবন নিয়েই এতটা ব্যস্ত থাকেন যে শিক্ষাদানে তাঁর পুরো শক্তি ও মনন নিবেশ করতে পারেন না, তাহলে জাতির ভিত কীভাবে শক্ত হবে?

অতএব, বিশ্ব শিক্ষক দিবসে শুধু শ্রদ্ধা জানানোই নয়, আমাদের সচেতন হতে হবে শিক্ষকদের অধিকার ও সম্মানের প্রশ্নে। রাষ্ট্রকে এ প্রশ্নটি জোর গলায় করতে হবে—শিক্ষকদের বেতন-ভাতা কি জাতীয় বেতন কাঠামোর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ? শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে কি না, এবং তার সঠিক বণ্টন নিশ্চিত করা হচ্ছে কি না? শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়ন ও কর্মপরিবেশের উন্নয়নের জন্য কী কী পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে?

রাষ্ট্রের কোষাগার শিক্ষকদের জন্য কখনোই অপ্রতুল হওয়ার কথা নয়। বরং, শিক্ষকদের জন্য বিনিয়োগই হলো দেশের ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে লাভজনক বিনিয়োগ। শিক্ষকেরা যদি সচ্ছল ও সম্মানিত হন, তাহলে তাঁরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে তুলবেন একটি জ্ঞানভিত্তিক, নৈতিকতাসম্পন্ন ও উন্নত জাতি। সেদিনই শিক্ষক দিবসের প্রকৃত শ্রদ্ধা ও অঙ্গীকার পূরণ হবে।

লেখক: অরিয়ন তালুকদার, সৌরভ জাকারিয়া ও সচিব তালুকদার, শিক্ষক ও সদস্য, The Edvisors: Think Tank of Civil Education