মানবিক বিভাগ থেকে পড়েও সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, শাহীন আক্তারের গল্প যেন অনুপ্রেরণার

শাহীন আক্তার নিজ অফিসেছবি: সংগৃহীত

সাতক্ষীরার প্রত্যন্ত গ্রামে শৈশব কাটানো শাহীন আক্তারের প্রথম কম্পিউটারে হাতেখড়ি ২০০৫ সালে, স্কুলে সরকারের দেওয়া কম্পিউটারে গেম খেলার মাধ্যমে। সেই সময় থেকেই মনে জন্ম নেয় এক স্বপ্ন—একদিন কম্পিউটার নিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করবেন। তবে প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুলে পড়ার কারণে তিনি জানতেন না, কম্পিউটার বিষয়ে পড়তে হলে এসএসসি ও এইচএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগে থাকতে হয়। ফলে তিনি মানবিক বিভাগ থেকেই এসএসসি ও এইচএসসি সম্পন্ন করেন এবং কম্পিউটার বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ না থাকার কারণে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তবু প্রযুক্তির প্রতি তাঁর আগ্রহ ও আকর্ষণ কখনই কমেনি।

একদিন হঠাৎ ফেসবুকে ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক-বাংলাদেশ ইসলামিক সলিডারিটি এডুকেশন ওয়াক্‌ফ (আইডিবি-বিআইএসইডব্লিউ) আইটি স্কলারশিপ প্রোগ্রাম সম্পর্কে জানতে পারেন। এরপর আবেদন করেন। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে রাউন্ড ৪২-এ ‘এন্টারপ্রাইজ সিস্টেমস অ্যানালাইসিস অ্যান্ড ডিজাইন-সি#.নেট (Enterprise Systems Analysis & Design-C#) কোর্সে ভর্তির জন্য নির্বাচিত হন। ১৪ মাসের কোর্স শেষে প্রোগ্রামের প্লেসমেন্ট সেলের সহায়তায় একজন সফটওয়্যার ডেভেলপার হিসেবে নেক্সটেল কমিউনিকেশনে পেশাগত জীবন শুরু করেন। এখানে চাকরিরত থেকে ইউনির্ভাসিটি অব সাউথ এশিয়া থেকে কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশনে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। নিজের দক্ষতাকে আরও উচ্চতায় নেওয়ার জন্য তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যাপ্লাইড পরিসংখ্যান অ্যান্ড ডেটা সায়েন্স বিষয়ে আরও একটি মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি স্বাধীন মিউজিক লিমিটেড নামের একিট প্রতিষ্ঠানে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দেন।

তরুণদের শাহীন আক্তার বলেন, প্রতিদিন একটু একটু করে শেখার চেষ্টা করুন। সুযোগ কখন, কোথা থেকে আসবে, কেউ জানেন না; কিন্তু প্রস্তুত থাকলে সেটিই আপনার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে।

মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই শাহীন আক্তার একজন প্রতিভাবান সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং একটি প্রতিযোগিতামূলক বেতনে স্বাধীন মিউজিক লিমিটেডে কাজ শুরু করেন। তবে উদ্যোক্তা হওয়ার আকাঙ্ক্ষা সব সময়ই তাঁর মধ্যে ছিল।

নিজ অফিসে কাজ করছেন শাহীন আক্তার
ছবি: সংগৃহীত

ব্যবসায়ী মো. আকরাম হুসাইনের সঙ্গে পরিচয়ের পর বদলে যেতে থাকে তাঁর জীবনের গতি। তিনি ওই প্রতিষ্ঠানে খণ্ডকালীন সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের কাজে যুক্ত ছিলেন। শাহীন আক্তারের মেধা ও নিষ্ঠা দেখে তাঁকে নেভরোনাস সিস্টেমসের সহপ্রতিষ্ঠাতা হিসেবে যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। তাঁর নেতৃত্বে নেভরোনাস সিস্টেমস তৈরি করেছে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য প্রযুক্তিপণ্য—

• Lunera—এআই-ভিত্তিক মোবাইল অ্যাপ, যা ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি ও গ্লুকোমা শনাক্তে ব্যবহৃত হয়।

• EduBee—অনলাইন লার্নিং অ্যাপ (বর্তমানে গুগল প্লে স্টোরে সবার জন্য উন্মুক্ত)

• InsideI—ডেটা অ্যানালিটিকস ও বিজনেস ইন্টেলিজেন্স স্যুট

• Nev ERP—এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স প্ল্যানিং সিস্টেম

• CivicPlus—এআই-ভিত্তিক সেন্টিমেন্ট অ্যানালাইসিস সিস্টেম।

শাহীন আক্তারের অধীনে এ প্রতিষ্ঠানে ১৬ জন কাজ করেন।

শাহীন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, আমি মানবিক বিভাগ থেকে শুরু করেও আজ সফটওয়্যারের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছি। মাইক্রোসফটের ভেন্ডর পরীক্ষায় ১০০০-এর মধ্যে ৯৪৪ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়ে Microsoft Certified Solutions Developer (MCSD) সার্টিফিকেশন অর্জন করেছি। মাইক্রোসফট আমার ব্যাকগ্রাউন্ড জানতে চায়নি—তারা আমার দক্ষতা ও যোগ্যতা যাচাই করেছে। আর এই অর্জন আমাকে শিখিয়েছে, ব্যাকগ্রাউন্ড নয়, আসল বিষয় হলো ইচ্ছা, অধ্যবসায় এবং অবিরাম শেখার মনোভাব।

নিজের দক্ষতাকে উচ্চতায় নেওয়ার জন্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যাপ্লাইড পরিসংখ্যান অ্যান্ড ডেটা সায়েন্স বিষয়ে মাস্টার্স করেন শাহীন আক্তার
ছবি: সংগৃহীত

তরুণদের উদ্দেশে শাহীন আক্তার বলেন, প্রতিদিন একটু একটু করে শেখার চেষ্টা করুন। সুযোগ কখন, কোথা থেকে আসবে, কেউ জানেন না; কিন্তু প্রস্তুত থাকলে সেটিই আপনার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে।

শাহীন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইএসডিবি-বিআইএসইডব্লিউ আইটি স্কলারশিপ প্রোগ্রাম একটি সফল ক্যারিয়ার পরিবর্তনের মডেল, যা নন-আইটি ব্যাকগ্রাউন্ডের স্নাতকদের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দক্ষতা অর্জনের সুযোগ দিয়ে আইটি খাতে সফলতা অর্জনে সহায়তা করে। আমার নিজের যাত্রাই এর একটি উজ্জ্বল উদাহরণ।’

ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক-বাংলাদেশ ইসলামিক সলিডারিটি এডুকেশন ওয়াক্‌ফ (আইএসডিবি-বিআইএসইডব্লিউ) পরিচালিত আইটি স্কলারশিপ প্রোগ্রাম নন-আইটি ব্যাকগ্রাউন্ডের স্নাতকদের জন্য সম্পূর্ণ বিনা মূল্যের সাড়ে আট মাস আইটি প্রশিক্ষণ কোর্স। বাজারের চাহিদা অনুযায়ী কোর্সগুলো সাজানো হয়েছে, যা চাকরির জন্য অত্যন্ত উপযোগী। এ পর্যন্ত কোর্স সম্পন্নকারীদের মধ্যে ৯২ শতাংশ দেশ ও বিদেশে সফলভাবে কর্মরত রয়েছেন।

আইএসডিবি-বিআইএসইডব্লিউ বাংলাদেশ সরকার ও ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (জেদ্দা, সৌদি আরব) যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত একটি প্রতিষ্ঠান। এটি তথ্যপ্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে বাংলাদেশের যুবসমাজকে কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে দক্ষ করে গড়ে তুলছে।

আইটি স্কলারশিপের রাউন্ড-৭০ এর আবেদন চলছে। শেষ তারিখ: ১৫ নভেম্বর ২০২৫
আবেদন করুন: apply.isdb-bisew.info
বিস্তারিত তথ্য পাবেন : www.isdb-bisew.org