বিশ্ব শিক্ষক দিবসের ভাবনা
বিশ্বে সবার জন্য শিক্ষা ও মানসিক বিকাশের কারিগর হিসেবে নিয়োজিত শিক্ষক সমাজের মর্যাদা ও অধিকার রক্ষার প্রত্যয় নিয়ে ১৯৯৪ সাল থেকে বিশ্ব শিক্ষক দিবস উদ্যাপিত হয়ে আসছে। সেই হিসেবে এ বছর দিবসটির ৩২ বছর পূর্ণ হলো। এ দিবসের লক্ষ্য হলো বিশ্বব্যাপী শিক্ষকদের নৈতিক সমর্থন জোগানো এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চাহিদা ও প্রয়োজনের বিষয়টি বিচার-বিশ্লেষণ করে শিক্ষকদের মাধ্যমে কত দক্ষতা ও যোগ্যতার সঙ্গে তা মেটানো সম্ভব, সেই নিশ্চয়তা বিধানে ভূমিকা রাখা। সারা পৃথিবীতে শিক্ষক সমাজ শিক্ষাক্ষেত্রে যে অবদান রেখে চলেছে, ইউনেসকোর মতে, বিশ্ব শিক্ষক দিবস সেই সচেতনতা, বোধগম্যতা ও উপলব্ধির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ এক বৈশ্বিক উদ্যাপন।
বিশ্বব্যাপী শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত পেশাজীবী সংগঠন এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল অনেক আগে থেকেই বিশ্বাস করতে শুরু করে যে একদিন বিশ্ব শিক্ষক দিবস আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি লাভের পাশাপাশি বিশ্বের সব দেশে একযোগে উদ্যাপিত হবে। তারা আরও বিশ্বাস করে যে শিক্ষকদের মর্যাদার প্রশ্নটি বিবেচনায় নিয়ে ১৯৬৬ সালে আইএলও ও ইউনেসকোর মধ্যে যে স্মারক স্বাক্ষরিত হয়, প্রতিটি দেশ তা বাস্তবায়নে সচেষ্ট হবে। ১৯৬৬ সালের অক্টোবর মাসে প্যারিসে শিক্ষকদের মর্যাদাসংক্রান্ত এক আন্তসরকার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনে আইএলও ও ইউনেসকো শিক্ষকদের অধিকার, দায়িত্ব ও মর্যাদাবিষয়ক একটি যৌথ সুপারিশমালা প্রণয়ন করে, যা শিক্ষকতা পেশাকে সম্মানজনক অবস্থানে নেওয়াসহ শিক্ষকদের মৌলিক ও অব্যাহত প্রশিক্ষণ, নিয়োগ ও পদোন্নতি, চাকরির নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা বিধানের প্রক্রিয়া, পেশাগত স্বাধীনতা, কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন, দায়িত্ব ও অধিকার, শিক্ষাসংক্রান্ত নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ, দেনদরবারের কৌশলসংক্রান্ত দক্ষতা, কার্যকর শিক্ষাদান ও শিক্ষণের পরিবেশ সৃষ্টি এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে মাইলফলক হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি লাভ করে। মূলত ১৯৯৪ সালের ৫ অক্টোবর ইউনেসকোর ২৬তম অধিবেশনে সংস্থার তৎকালীন মহাপরিচালক ফ্রেডারিক এম মেয়র এডুকেশন ইন্টারন্যাশনালের অনুরোধে ৫ অক্টোবরকে বিশ্ব শিক্ষক দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। বর্তমানে বিশ্বের ১০০টির বেশি দেশে আজকের দিনে বিশ্ব শিক্ষক দিবস উদ্যাপিত হয়। সেখানে একটি বিষয়ে সবাই ঐকমত্য প্রকাশ করেন যে বর্তমান বিশ্বে শিক্ষকেরা একটি ক্রমবর্ধমান জটিল, বহুসাংস্কৃতিক ও প্রযুক্তিনির্ভর দ্রুত পরিবর্তনশীল সমাজে মেধা ও শ্রম দিয়ে চলেছেন। তাঁদের সেই অবদানের বিষয়টি শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও অন্যান্য পেশাজীবী যেন সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারেন, তার ওপর গুরুত্বারোপের জন্য ইউনেসকো ও এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল দিনটি উদ্যাপনের উদ্যোগ নেয়। প্রতিবছর শিক্ষা পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের অবদান তুলে ধরার জন্য এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল একটি জনসচেতনতামূলক প্রচারাভিযানও চালিয়ে থাকে।
প্রতিবছরের মতো বিশ্ব শিক্ষক দিবস ২০২৫–এর প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ‘শিক্ষকতাকে একটি সহযোগী পেশা হিসেবে পুনর্গঠন’। প্রতিপাদ্যটি বাংলাদেশের চলমান শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার ও নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সময়োপযোগী ও গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিপাদ্যটি শিক্ষক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাব্যবস্থার জন্য সহযোগিতার রূপান্তরমূলক সম্ভাবনা তুলে ধরে। বিশ্বব্যাপী বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় যে সংকট বিদ্যমান, সেই পটভূমিতে প্রতিপাদ্যটি যুক্তিসংগত, বিশেষত বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা, এ দেশে যেমন মানসম্মত শিক্ষকের সংকট রয়েছে, পাশাপাশি তাঁদের সামাজিক অঙ্গীকারের অভাব রয়েছে। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে একজন শিক্ষকের মানসম্মত শিক্ষাদানের অঙ্গীকার থাকা দরকার।
দার্শনিক বাট্রান্ড রাসেলের কথায়, ‘শিক্ষক সমাজ হচ্ছেন প্রকৃতই সমাজ ও সভ্যতার বিবেক।’ এ জন্য শিক্ষকদের বলা হয় সমাজ বিনির্মাণের স্থপতি। ইউনেসকো বলছে, বর্তমান বিশ্বে একধরনের শিক্ষাসংকট চলছে। ২৫০ মিলিয়ন শিশু শিক্ষার প্রাথমিক দক্ষতা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে। অনেক দেশে শিক্ষক স্বল্পতার কারণে শিক্ষার মান পড়ে যাচ্ছে। বিশ্বে ১ দশমিক ৪ মিলিয়ন শ্রেণিশিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে। তার সঙ্গে রয়েছে তাঁদের মানসম্মত প্রশিক্ষণের অভাব। সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা বিষয়ে প্রশিক্ষণের কাজটি অতি দ্রুত সময়ে শেষ করার ব্যাপারে ইউনেসকো দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। বিশ্বব্যাপী শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি, যা প্রতিটি দেশকে বাস্তবায়নের জন্য ইউনেসকো সুপারিশ ও সমর্থন জোগাবে, তা হলো:
* পেশা, পেশাগত দক্ষতা ও মর্যাদা বৃদ্ধির সুযোগ, উন্নত বেতন–কাঠামোসহ চাকরির সুবিধাজনক পরিবেশ;
* প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষার উন্নত পরিবেশ;
* শিক্ষকদের জন্য উচ্চমানের প্রশিক্ষণ;
* শিক্ষক নিয়োগ ও দক্ষতা বৃদ্ধি বিষয়ে কার্যকরী ব্যবস্থাপনা;
তাদের প্রত্যাশা, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও বিভিন্ন দেশের সরকার সম্মিলিতভাবে কাজ করবে শিক্ষক ও শিক্ষার মানোন্নয়নে বিশেষ করে সেসব দেশে, যেখানে ব্যাপকসংখ্যক শিশুরা শিক্ষার বাইরে অবস্থান করে। এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষার মান ও মর্যাদার দিক দিয়ে শিক্ষকদের অবস্থান সম্পর্কে শিক্ষা পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা যথেষ্ট অবগত। একটি দেশ স্বাধীনতা লাভের পাঁচ দশক পর একটি জাতীয় শিক্ষানীতি পেয়েছে। এই দীর্ঘসময় এ দেশের সামগ্রিক শিক্ষা কোনো সুনির্দিষ্ট নীতির আলোকে পরিচালিত হয়নি। দীর্ঘদিন কোনো শিক্ষানীতি না থাকার জন্য নিশ্চয় শিক্ষক সমাজ দায়ী ছিল না। বাস্তবিক ভিত্তি থেকে শিক্ষাকে জাতির মেরুদণ্ড বলা হয়, কিন্তু তাকে দৃঢ় ও সোজা রাখতে এবং এই পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষদের যথাযথ মর্যাদা ও সম্মানজনক জীবনযাপনের জন্য যা প্রয়োজন, তা প্রদানের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময় রাষ্ট্র পরিচালনাকারীদের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তোলার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। শিক্ষকেরা শুধু বেতন-ভাতা ও সুযোগ- সুবিধার ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার তা–ই নন, মর্যাদার প্রশ্নেও তাঁরা অন্যান্য পেশাজীবী গোষ্ঠীর তাচ্ছিল্য ও ঔদাসীন্যের শিকার। দীর্ঘদিন থেকে শিক্ষকদের বঞ্চিত রাখার যে সংস্কৃতি এ দেশে তৈরি হয়েছে, একটি মহল তা বহাল রাখতে যেন মরিয়া। আর সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্র পরিচালনাকারীদের অবহেলা তো রয়েছে। এই সরকারের পূর্ববর্তী সময়কালে শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন–কাঠামোর কথা আমরা শুনেছি, কিন্তু সেই শাসনকাল পার হয়ে গেছে, তারাই আছেন রাষ্ট্রক্ষমতায় কিন্তু এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই, যদিও ইতিমধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত অনেক বিভাগের স্বতন্ত্র বেতন–কাঠামো চালু হয়েছে।
বিশ্ব শিক্ষক দিবস, শুধু একটি দিবস নয়। শিক্ষক সমাজ একটি দিনে তাদের অবদান সম্পর্কে অন্যের মূল্যায়ন ও অভিব্যক্তি জানার পাশাপাশি নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হবেন এবং তা পালন করতে নতুন করে সংকল্পবদ্ধ হবেন। শিক্ষক দিবস শুধু শিক্ষকদের দাবি আদায়ের জন্য নয়, শিক্ষার মান উন্নয়নে শিক্ষকদের ভূমিকাই যে সবচেয়ে বেশি সে কথা মনে করে দেয়। শুধু শিক্ষকদের নয়, শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করার জন্য শিক্ষা ক্ষেত্রের সব ধরনের সমস্যা ও অসামঞ্জস্যতা দূর করে একটা পরিকল্পিত শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। তা না হলে ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি অর্জনও বাধাগ্রস্ত হবে। এ দিবস উদ্যাপনের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী শিক্ষক সমাজ তাদের অধিকার সুরক্ষা ও দায়িত্ব পালনের প্রত্যয় ঘোষণা করে। সেই সঙ্গে সফলভাবে দায়িত্ব পালনের জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক সম্মানিত ও স্বীকৃতি লাভ করবেন এ প্রত্যাশাটুকু করতেই পারেন। ইউনেসকোর মতো একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা পাশে থেকে সমর্থন জোগালে তাঁরা লক্ষ্যে পৌঁছাবেন বলে বিশ্বাস করতে সাহস জাগে।
শিক্ষক দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয় শিক্ষকেরা কেবল জ্ঞান দান করেন না, বরং শিক্ষার্থীর আদর্শ-মূল্যবোধ, দক্ষতা ও স্বপ্ন গড়ে তুলতে সহায়তা করেন। নব নব প্রযুক্তি, শিক্ষণপদ্ধতি আর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে শিক্ষকেরা আগামীর বিশ্বনাগরিক তৈরি করেন। তাই শিক্ষকদের যথাযথ সম্মান, মর্যাদা ও স্বীকৃতি দিতে পারলে, তাঁরা আরও সামর্থ্য ও অনুপ্রেরণা নিয়ে নতুন প্রজন্মকে গড়ে তুলতে সক্ষম হবেন।
লেখক: শিক্ষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ, যশোর-৭৪০০