গাজার শিক্ষার্থীদের মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন অধরা, কারণ...

গাজার শিক্ষার্থীরা ট্রাম্পের কারণে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যেতে পারছেন নাছবি: সংগৃহীত

যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েও আমেরিকায় যেতে পারছেন না গাজার কয়েক ডজন শিক্ষার্থী। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন ফিলিস্তিনি পাসপোর্টধারীদের জন্য প্রায় সব ধরনের অ-অভিবাসী ভিসা স্থগিত করায় বিপাকে পড়েছেন তাঁরা।  

ভাঙাচোরা জীবন,  সীমান্তে আটকে স্বপ্ন

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর কয়েক দিনের মধ্যেই গাজার মরিয়ামের (নিজেকে এবং পরিবারকে রক্ষার জন্য ছদ্মনাম ব্যবহার করছেন) জীবন ওলটপালট হয়ে যায়। বাড়িঘর, স্কুল এবং ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব গাজা, যেখানে তিনি পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পড়ছিলেন—সবকিছু ধ্বংস হয়ে যায় ইসরায়েলের বিমান হামলায়। ডিসেম্বরে নিহত হন তাঁর শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য খ্যাতিমান পদার্থবিজ্ঞানী সুফিয়ান তাইয়েহ। মরিয়ম বলেন, ‘আমার কাছে তিনি বাবার মতো ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর খবর শোনার পর আমার মনে হলো পড়াশোনা শেষ হয়ে গেল। মনে হচ্ছে আমার পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেল।’

তবু রাফার তাঁবুতে ঠাঁই নিয়ে অনিশ্চিত বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট–বিভ্রাটের মধ্যেও মরিয়াম হাল ছাড়েননি। সীমান্তের কাছে দুর্বল মিসরীয় সিগন্যাল পাওয়া যায়, এমন স্থানে গিয়ে জীবনের ঝুঁকি তিনি বিদেশে যাওয়ার জন্য আবেদন করেন আর সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন। শেষ পর্যন্ত আমেরিকার মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণ অর্থায়নে পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তির সুযোগ পান। কিন্তু তিনি এখনো গাজাতেই আটকে আছেন। ভিসা নিষেধাজ্ঞা থামিয়ে দিয়েছে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন।

মরিয়ম বলেন, ‘সম্পূর্ণ অর্থায়িত পিএইচডি প্রোগ্রামের ভর্তির সুযোগের বার্তা পাওয়ার মুহূর্তটি আমি কখনোই ভুলব না। আমাদের তাঁবুতে ফিরে আমার বাচ্চাদের শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সুসংবাদটি জানিয়েছিলাম। বলেছিলাম, আমরা এই দুঃস্বপ্ন থেকে বাঁচব। কিন্তু ট্রাম্পের ভিসা প্রক্রিয়া স্থগিতের কথা শুনে সবকিছু আবার ভেঙে পড়েছিল। মনে হয়েছিল যেন আমার স্বপ্নগুলো আবারও ধ্বংস হয়ে গেছে।’

যুদ্ধ না থাকলেও ফিলিস্তিন শিক্ষার্থীদের ভিসা সাক্ষাৎকার দিতে মিসর বা ইসরায়েলে যেতে হতো। এখন রাফা সীমান্ত প্রায় বন্ধ আর ইসরায়েল যাওয়ার অনুমতি মেলা অসম্ভব।

গাজা শহরের আরেক শিক্ষার্থী ২২ বছরের লায়লারও অবস্থা একই। ইসরায়েলের আক্রমণ শুরু হওয়ার সময় পাঁচ বছরের ইঞ্জিনিয়ারিং প্রোগ্রামে চার বছরে চলছিল। ওয়াই–ফাইয়ের সংযোগ পেতে প্রতিদিন দুই ঘণ্টা হেঁটে এদিক ওদিক যেতেন। সৌরবিদ্যুৎ দিয়ে ফোন চার্জ করে আবেদনপত্র পাঠাতেন। যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পান তিনি। কিন্তু তারপর এল নিষেধাজ্ঞা। সব এলোমেলো হয়ে গেল। তিনি জানালেন, ‘আমরা এখনো গাজাতেই আটকে আছি।’

লায়লাও ছদ্মনাম। তিনি গার্ডিয়ানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম প্রকাশ না করার জন্য অনুরোধ করেছেন।

যুদ্ধ শুরুর আগে ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের শহর রামাল্লার একটি স্কুলে শিক্ষার্থীরা
ফাইল ছবি: রয়টার্স

ওয়াশিংটনের স্থগিতাদেশ ও নিরাপত্তার অজুহাত

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের পাসপোর্টধারীদের জন্য ভিসা প্রক্রিয়া সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, প্রতিটি ভিসা সিদ্ধান্তই জাতীয় নিরাপত্তার সিদ্ধান্ত।

অন্য দেশের পাসপোর্টধারী ফিলিস্তিনিদের ক্ষেত্রে এই নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য নয়। তবে যদি তাঁদের ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ বা প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়, তাহলে সমস্যা হবে। অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের এক কেব্‌ল বার্তায় বলা হয়েছে, ‘অ্যান্টি-আমেরিকান’ মতামত প্রতিরোধে এই অতিরিক্ত যাচাই প্রক্রিয়া চালু করা হয়েছে।

সম্পূর্ণ অর্থায়িত পিএইচডি প্রোগ্রামের ভর্তির সুযোগের বার্তা পাওয়ার মুহূর্তটি আমি কখনোই ভুলব না। তাঁবুতে ফিরে বাচ্চাদের শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সুসংবাদটি জানিয়েছিলাম। বলেছিলাম, আমরা এই দুঃস্বপ্ন থেকে বাঁচব।
ফিলিস্তিনের শিক্ষার্থী মরিয়াম

সীমিত সহায়তা, অগণিত বাধা

স্টুডেন্ট জাস্টিস নেটওয়ার্ক নামের একটি মার্কিন সংগঠন গাজার শিক্ষার্থীদের ভর্তি ও ভিসা প্রক্রিয়ায় সহায়তা করছে। তাদের মতে, যাদের সহায়তা করা হয়েছে, অল্প কয়েকজনই যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছাতে পেরেছেন। অনেকের বৃত্তি ঝুঁকির মুখে। সংগঠনের এক সদস্য মাজিদ বলেন, ‘প্রত্যেকেই ভিসা বন্ধে প্রভাবিত হয়েছেন। পূর্ণ অর্থায়নের সুযোগ কেড়ে নেওয়া ভয়াবহ ব্যাপার।’

যুদ্ধ না থাকলেও শিক্ষার্থীদের ভিসা সাক্ষাৎকার দিতে মিসর বা ইসরায়েলে যেতে হতো। এখন রাফা সীমান্ত প্রায় বন্ধ আর ইসরায়েল যাওয়ার অনুমতি মেলা অসম্ভব।

মার্কিন শিক্ষকদের আকুতি

মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক থমাস কোহেন মরিয়াম ও আরেক শিক্ষার্থীকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছিলেন। এমনকি মরিয়ামের মিসরে যাওয়ার খরচ বহন করার কথাও বলেছিলেন। কিন্তু ২০২৪ সালের মে মাসে ইসরায়েল রাফা সীমান্ত দখল করার পর সেটিও বন্ধ হয়ে যায়।

থমাস কোহেন বলেন, ‘তারা যোগ্যতা নিয়েই পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছে। বিদেশে পড়ার এই সুযোগ তাদের জীবনও বাঁচাতে পারত।’ নিজের পরিবারের পোল্যান্ডের নাজির হলোকাস্টের অভিজ্ঞতার কথা টেনে তিনি বলেন, ‘অনেকে বাঁচতে পারেননি, কারণ বের হওয়ার পথ ছিল না। আমি চাই না ইতিহাস আবারও (মরিয়াম ও লায়লার ক্ষেত্রে) এমন হোক।’ এখন তিনি শিক্ষার্থীদের ইউরোপ বা কানাডায় সুযোগ খুঁজতে বলছেন।

অনিশ্চয়তাই যেন একমাত্র সম্বল

গাজার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। বোমাবর্ষণ থেকে রেহাই পাচ্ছে না ত্রাণশিবির, স্কুল এমনকি হাসপাতালও। বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া অনেকের কাছে মুক্তির পথও বটে। কিন্তু সে সুযোগও এখন অনিশ্চিত। মাজিদ বলেন, ‘এরা আবেদন করেছে বোমাবর্ষণ, অনাহার, ক্ষতির মধ্যে দাঁড়িয়ে। পরিবার হারিয়েছে, কাগজপত্র নষ্ট হয়েছে। তাদের শিক্ষার সুযোগ কেড়ে নেওয়া মানে তাদের ভবিষ্যৎ কেড়ে নেওয়া।’

আরও পড়ুন