শিক্ষার্থীদের হাত ধরে জলবায়ু মোকাবিলায় আশার আলো
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি হলো বাংলাদেশ। ইতিমধ্যে এর প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে—একদিকে উপকূলে ভাঙন, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস, অন্যদিকে পাহাড়ি ভূমিধস ও খরার মতো দুর্যোগ আমাদের জীবন ও জীবিকাকে কঠিন করে তুলছে। এ বাস্তবতায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনরক্ষায় শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করা এখন সবচেয়ে জরুরি। এই শিক্ষার্থীদের মতো আরও অনেককে সহায়তা করেছে জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থা (ইউএনসিডিএফ) এবং ইউএনডিপির লোকাল গভর্নমেন্ট ইনিশিয়েটিভ অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (লজিক) প্রকল্প। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় (এলজিআরডি) মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীন পরিচালিত লজিক প্রকল্প বাংলাদেশ সরকার, সুইডেন, ডেনমার্ক, ইউএনসিডিএফ ও ইউএনডিপির একটি যৌথ প্রয়াস।
প্রকল্পটি দেশের নয়টি জেলায় ২৯১টি ওয়ার্ডে প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষার্থীকে যুক্ত করেছে। প্রতিটি ওয়ার্ডে গড়ে তোলা হয়েছে একটি করে প্ল্যাটফর্ম, যেখানে স্থানীয় শিক্ষার্থীরা শুধু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় কাজ করছেন না, বরং তহবিল কার্যকরভাবে ব্যবহার করা, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং পরিবর্তন সৃষ্টিকারী নেতৃত্ব তৈরিতেও ভূমিকা রাখছেন।
লজিক ইয়ুথ প্ল্যাটফর্মের অন্যতম বড় অর্জন হলো তরুণ উদ্যোক্তাদের উত্থান, যাঁরা শুধু জীবিকা অর্জন করছেন না, বরং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলাও করছেন। বাংলাদেশের জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ জেলাগুলোতে তরুণেরা তাঁদের দৃঢ়তা, সৃজনশীলতা ও ব্যবসায়িক দক্ষতা দিয়ে স্থানীয় সমস্যাকে টেকসই সবুজ সমাধানে রূপান্তর করছে।
চর মনতাজের অন্তু রানীর লড়াই ও সাগরকন্যা ড্রাই ফিশ ব্যবসা—
পটুয়াখালী জেলার একটি দুর্গম দ্বীপ হচ্ছে চর মন্তাজ। সমুদ্রের ঢেউ আর ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে এ অঞ্চল প্রতিবছর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দ্বীপটি একদিন সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। এই ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বেড়ে উঠেছেন সম্মান দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী অন্তু রানী। পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি গত এক বছর ধরে সক্রিয়ভাবে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কাজ করছেন।
অন্তুর কথায়, ‘আমরা যাঁরা উপকূলের মানুষ, প্রতিদিন নতুন নতুন সমস্যার মুখোমুখি হই। একদিকে নদীভাঙন, অন্যদিকে পানির লবণাক্ততা। আমাদের কৃষি, স্বাস্থ্য, এমনকি পড়াশোনাও ঝুঁকির মধ্যে। আগে শুধু ভয় পেতাম, এখন মনে হয় কিছু একটা করা দরকার। লজিক প্রজেক্টে কাজ করার ফলে আমি শিখেছি, তরুণরা একসঙ্গে হলে পরিবর্তন আনা সম্ভব।’
২০২৩ সালে স্থানীয় কিছু তরুণ ও নারীর সঙ্গে মিলে অন্তু ‘সাগরকন্যা পিওর ড্রাই ফিশ’ নামের একটি ব্যবসা শুরু করেন। এটি মূলত নারীদের নেতৃত্বে পরিচালিত একটি শুঁটকি মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণ ব্যবসা। অন্তুর ভূমিকা ছিল—হিসাব-নিকাশ ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা, পণ্য প্রচার ও বিপণন ও স্থানীয় সরকারি দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা।
২০২৫ সালে অন্তু প্রথমবারের মতো ঢাকায় যান বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিটের ইয়ুথ এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ এক্সপোতে অংশ নিতে। সেখানে তিনি সাগরকন্যা ড্রাই ফিশের সাফল্য, বিনিয়োগ পরিকল্পনা ও ভবিষ্যৎ ভিশন উপস্থাপন করেন দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সামনে।
কুড়িগ্রামের ফারিদুল ইসলাম ও ইউথনেট ফর ক্লাইমেট জাস্টিস—
কুড়িগ্রামের রাজিবপুর উপজেলার নদীবেষ্টিত চরাঞ্চল দেশের অন্যতম জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। বন্যা, নদীভাঙন এবং ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ এখানে মানুষের জীবন ও জীবিকাকে অনিশ্চয়তার মধ্যে রাখে। এই বাস্তবতায় বেড়ে ওঠা মো. ফারিদুল ইসলাম শুরুতে লজিক ইয়ুথ প্ল্যাটফর্মের একজন উপকারভোগী ছিলেন। ২০২০ সালে তিনি স্থানীয় পর্যায়ে জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক প্রশিক্ষণ পান এবং সচেতনতামূলক সভা আয়োজন ও সমবায় শক্তিশালীকরণের কাজ শুরু করেন।
সময় গড়াতে গড়াতে ফারিদুল ইসলাম একজন কমিউনিটি লিডার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তিনি শুধু সচেতনতা তৈরি করেননি, বরং তরুণদের একত্রিত করে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন “ইউথনেট ফর ক্লাইমেট জাস্টিস”। তাদের গৃহীত পদক্ষেপগুলো হলো—টেকসই কৃষি উদ্যোগ: স্থানীয় নারী উদ্যোক্তাদের সহায়তায় নতুন ধরনের শস্য (যেমন কুইননায়া ও চিয়া) উৎপাদন করা হচ্ছে, যা জলবায়ু সহনশীল এবং বাজারে ভালো চাহিদাসম্পন্ন। নারী উদ্যোক্তা সহায়তা: মুরগি পালন, হস্তশিল্প, ও ক্ষুদ্র কৃষি ব্যবসায় নারীদের সম্পৃক্ত করে আয় বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি করা। বাজার সংযোগ: স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সবুজ পণ্য জাতীয় পর্যায়ের প্রদর্শনীতে উপস্থাপন করা। ২০২৫ সালে বাংলাদেশ বিজনেস সামিটে ফারিদুল ও তাঁর সহকর্মীরা কুইনোয়া ও চিয়া বীজ প্রদর্শন করেন এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রশংসা অর্জন করেন।
ইয়ুথনেট এখন পর্যন্ত কুড়িগ্রামের তিনটি উপজেলায় চার শতাধিক তরুণকে সংগঠিত করেছে যারা প্রত্যেকে নিজ নিজ এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অবদান রাখছে। নারীদের আর্থিকভাবে ক্ষমতায়ন, কৃষিতে বৈচিত্র্য আনা ও দুর্যোগকবলিত জনগোষ্ঠীকে প্রস্তুত করার মাধ্যমে সংগঠনটি একধরনের নতুন আশা জাগিয়েছে।
পাহাড়ের ছেলে সবিন চাকমার উদ্যোগ: সৌরচালিত বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ব্যবস্থা
রাঙামাটি জেলার সাফারি ইউনিয়নে থাকেন সবিন চাকমা। পাহাড়ি এলাকায় ভূমিধস, বন্যা, খরা তাঁর জীবনের নিত্যসঙ্গী। স্কুলজীবন থেকেই প্রকৃতি নিয়ে তাঁর আগ্রহ। বর্তমানে কলেজপড়ুয়া সবিন লজিক প্রজেক্টে যুক্ত হয়ে স্থানীয় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কাজ করছেন।
সবিনের অভিজ্ঞতা শোনালেন তিনি নিজেই, ‘বর্ষায় আমাদের এলাকায় পাহাড়ধস হয়, অনেক সময় মানুষের জীবন যায়। আবার শুষ্ক মৌসুমে পানিসংকট দেখা দেয়। আগে শুধু সমস্যাগুলো দেখতাম, এখন মনে হয় সমাধানের জন্য আমাদেরই এগোতে হবে। লজিকের মাধ্যমে আমরা শিখেছি কীভাবে ঝুঁকি চিহ্নিত করে স্থানীয় পর্যায়ে সমাধান বের করতে হয়। তরুণদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো পরিবর্তন সম্ভব নয়।’
তাঁর গ্রামের মানুষের জন্য একটি সৌরচালিত বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ব্যবস্থা চালু করেছেন। দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় পানির সহজলভ্যতা কম হওয়ায় স্থানীয় লোকজন দীর্ঘদিন ধরে পানীয় জলের সমস্যায় ভুগছিলেন। সবিন চাকমা স্থানীয় প্রাকৃতিক জলাশয় এবং সৌরশক্তি ব্যবহার করে একটি পরিবেশবান্ধব ও টেকসই পানি সরবরাহ ব্যবস্থা তৈরি করেছেন, যা প্রতিদিন শতাধিক মানুষকে নিরাপদ পানীয় জল পৌঁছে দিচ্ছে।
যুব উদ্যোক্তাদের প্রয়োজনীয়তা
লজিকের তরুণেরা প্রতিনিয়ত শিখছেন। তরুণেরা মোকাবিলা করছেন জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি। জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা মনে করেন জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি যেসব স্থানে, সেখানে সরকার বিশেষ করে যুব মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর এবং স্থানীয় সরকার বিভাগ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় দুর্যোগে তাঁদের জ্ঞান কাজে লাগাতে পারে। স্বেচ্ছাসেবকের জ্ঞান কাজে লাগাতে পারে। নতুন স্বেচ্ছাসেবক গড়ে তুলতে পুরোনোদের কাজে লাগাতে পারে। এ জন্য বিশেষ বাজেট রেখে বিশেষ প্রকল্প হাতে নেওয়া যেতে পারে।
বাংলাদেশ একই সঙ্গে দুটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি—জলবায়ু–সংকট ও যুব বেকারত্ব। মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশ হলো ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী তরুণ। এই বিশাল সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে তাঁদের উদ্যোক্তা যাত্রায় বিনিয়োগ জরুরি। বিশেষ করে সবুজ খাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি, টেকসই কৃষি, ইকো-ট্যুরিজম, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি। তরুণদের উদ্যোগের মধ্যে আছে—কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে গ্রামীণ ও জলবায়ু-প্রভাবিত এলাকায়। উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করবে, স্থানীয় জ্ঞানকে টেকসই চর্চায় রূপান্তরের মাধ্যমে। সহনশীলতা বাড়াবে, কারণ, এসব ব্যবসা জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে। এসডিজি অর্জন ত্বরান্বিত করবে, বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তন, দারিদ্র্য হ্রাস ও লিঙ্গ সমতার ক্ষেত্রে।
আজকের শিক্ষার্থী আগামী দিনের নেতৃত্ব। তাঁদের সৃজনশীল চিন্তা, সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতাই পারে বাংলাদেশকে টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিতে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, তাঁরা জলবায়ু পরিবর্তনকে শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে দেখছেন না, বরং সামাজিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ হিসেবেও বিবেচনা করছেন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, জীবিকা—সবকিছুর সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের যোগসূত্র আছে। এ কারণে শিক্ষার্থীরা যখন এক হয়ে ঝুঁকি চিহ্নিত করেন, সমাধানের পথ খোঁজেন এবং সেই জ্ঞান চারপাশের মানুষকে শেয়ার করেন, তখন তাঁরা কেবল নিজেদের ভবিষ্যৎ নয়, গোটা সমাজের ভবিষ্যৎ রক্ষায় ভূমিকা রাখেন।