সর্বজনীন পেনশন কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দিয়ে শুরু করতে হবে?
শিক্ষা খাত কতটা ভিন্নভাবে দেখা হয়, তার বড় প্রমাণ পাই ক্যাডার সার্ভিস/সরাসরি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বাইরে রেখে প্রথমেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্য স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে সর্বজনীন বেতন স্কেলের আওতায় আনার মধ্য দিয়ে। আসলে আমাদের দেশে পদে পদে চোখে আঙুল দিয়ে শিক্ষা খাতকে বৈষম্যমূলকভাবে হেয় করা হয়।
বাংলাদেশের উন্নয়নের বড় বাধা হলো পেশাগত বৈষম্য। যেভাবে ছোট–বড় তালিকা করে এ দেশে প্রশাসন চলে, পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এমনটি নেই। আমাদের দেশে প্রকৌশলী, চিকিৎসক বা শিক্ষকদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ হলেন প্রশাসন ক্যাডার থেকে আসা নন–স্পেশালাইজডরা; অথচ এসব স্পেশালাইজড খাতগুলো স্বাধীনভাবে চলতে দেওয়া উচিত ছিল। তাদের জন্য আলাদা বেতনকাঠামো করা যেতে পারত। বুয়েট, মেডিকেল বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা নিশ্চয়ই আলাদাভাবে সম্মানিত হওয়ার অধিকার রাখেন; অথচ আমাদের দেশে এ পেশায় এসে পদে পদে অপমানিত হতে হয়। সবচেয়ে ভালো ছাত্র সরকারি চিকিৎসক হয়ে ঠিকমতো প্রমোশন পান না। সরকারি কলেজের শিক্ষকদেরও একই অবস্থা, কিন্তু জেনারেল ক্যাডারের লোকজন শুধু প্রমোশন নয়, বাড়ি–গাড়িসহ সোনার হরিণ পেয়ে যাচ্ছেন। সমাজের চোখে তাঁদের তুলে দেওয়া হচ্ছে ওপরের দিকে। যার কারণে এখন যা হচ্ছে, তা সত্যিই ভয়ংকর একটি দেশের জন্য। বুয়েট–মেডিকেল থেকে পাস করে পুলিশ প্রশাসনের জন্য লড়ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে চাইছেন না। সবাই ছুটছেন বিসিএস নামক সোনার হরিণের দিকে।
বাংলাদেশে এমনিতেই কোনো বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক মানের নয়। তার ওপর জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় করে সমস্যা আরও বাড়িয়ে তোলা হচ্ছে। এটি আমাদের পলিসিগত সমস্যা অনেক আগে থেকেই বলছি। কিন্তু যাঁরা এখনো শিক্ষকতা পেশায় আসছেন, তাঁরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্র। কিন্তু রাষ্ট্র এই সেরা ছাত্রদের নার্সিং করতে এমন কী করছে? তাঁরা এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পর থেকে যখন একটা অনুন্নত কলেজের ফ্লেভার পাচ্ছেন, তখন কোনোভাবেই তাঁর মধ্যে দেশের জন্য অনেক কিছু করার ইচ্ছা শক্তিশালী হয় না। তারপর যখন দেখেন রাষ্ট্রও ইচ্ছাকৃতভাবে হেয় করছে, তখন বেশির ভাগ মেধাবী শিক্ষক যে করেই হোক বিদেশে সেটেল্ড হওয়ার রাস্তা খোঁজেন। আমরা এত এত ব্রেন পাচারের কথা বলি, তাঁদের ধরে রাখতে কি কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছি? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে যখন তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্লেভার পান না, রাষ্ট্রের অবহেলার শিকার হন, তখন তাঁদের দেশ ছেড়ে চলে যাওয়াকে আমরা অন্যায় বলতে পারি না।
পৃথিবীর সব দেশে মেধাবীদের বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আলাদাভাবে সম্মান করা হয়। জাপানে দেখেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা বিমানবন্দর থেকে শুরু করে দেশের অভ্যন্তরে সব জায়গায় আলাদা মর্যাদা পান। আমাদের এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের জন্য সমাজে সে মানসিকতা তৈরি করতে পারিনি। আমরা পদে পদে এমন উদাহরণ তৈরি করছি, যা একজন নাগরিকের শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছা মেরে ফেলে। আজ কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে সর্বজনীন পেনশনের বিপরীতে দাঁড়াতে হচ্ছে? কেন শিক্ষকেরা মনে করছেন, তাঁদের সঙ্গে অন্যায় করা হচ্ছে? কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বারবার অপমান করা হয়েছে। প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গ্রেড অবনমন করা হয়েছে। এখন সর্বজনীন পেনশনের মাধ্যমে আরও একবার মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ভিনগ্রহের।
সরকারের সদিচ্ছা থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আসলেই ভিনগ্রহের উচ্চ মর্যাদায় আসীন করতে পারত। তাঁদের জন্য আলাদা বেতন স্কেল থাকতে পারত। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য স্বাধীন শিক্ষা কমিশন করার চিন্তা করতে পারত। বিশ্ববিদ্যালয় চলতে পারত শিক্ষায় সংশ্লিষ্ট লোকদের দিয়ে। আমাদের রাষ্ট্রের এ রকম কোনো চিন্তাভাবনা নেই, বরং সব ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্তশাসন নিভিয়ে দিতে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। আমরা একদিকে বিশ্বমানের শিক্ষা চাচ্ছি, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে এমন পদক্ষেপ নিচ্ছি, যাতে মেধাবীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে উৎসাহ না পান।
সরকারের উচিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সর্বজনীন পেনশন স্থগিত করে দ্রুত স্বতন্ত্র স্কেলের ব্যবস্থা করা। অন্য দেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য উন্নত বেতন স্কেল, গবেষণায় টাকা বাড়ানো ও বিশ্ববিদ্যালয় অবকাঠামোর মানোন্নয়নসহ বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে আরও শক্তিশালী করা। চাকরির শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য ফাউন্ডেশন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা অপরিহার্য। বিভিন্ন সময়ে শিক্ষকদের পাঠদান–সম্পর্কিত প্রশিক্ষণের আয়োজন ইউজিসি করতে পারে। উন্নত জাতি গড়ে তুলতে হলে উন্নত বিশ্ববিদ্যালয় দরকার। আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো, জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন বন্ধ করে বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে নজর দেওয়া। আশা করছি, সরকার আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় উৎসাহিত করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
লেখক: মো. ফজলুল করিম, অধ্যাপক, বিজিই বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, টাঙ্গাইল