যে যানে মঙ্গলে যাবেন ইলন মাস্ক

মহাকাশ ভ্রমণের ধারণা বদলে দিতে চান ইলন মাস্ক। সে জন্য তিনি তৈরি করেছেন ‘স্টারশিপ’। পুনর্ব্যবহারযোগ্য নভোযানটি একবারে ১০০ জন পর্যন্ত মানুষ নিয়ে মঙ্গল গ্রহের উদ্দেশে পৃথিবী ছাড়বে।

একাধিক গ্রহে বসতি গড়ার স্বপ্ন দেখেন ইলন মাস্ক
কোলাজ

জনপ্রিয় একটি উপদেশ হলো, সব ডিম এক ঝুড়িতে রাখবেন না। অর্থাৎ, বিনিয়োগ এমনভাবে করুন, যেন এক খাতে ক্ষতি হলে তা অন্য খাত থেকে পুষিয়ে নেওয়া যায়। এতে নিঃস্ব হওয়ার ঝুঁকি থাকে না। সে উপদেশটি মানবসম্প্রদায়ের বেলায় প্রয়োগ করতে চেয়েছেন ইলন মাস্ক।

স্পেসএক্স প্রতিষ্ঠার পেছনে মাস্কের মূল উদ্দেশ্য ছিল গ্রহে গ্রহে জীবন ছড়িয়ে দেওয়া। অর্থাৎ, গ্রহাণুর আঘাতের মতো বড়সড় কোনো বিপর্যয় যদি আসেই, তবে মানবসম্প্রদায়ের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চেয়েছেন তিনি।

২০১৬ সালে মেক্সিকোয় অনুষ্ঠিত এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে মাস্ক বলেছিলেন, মানবসম্প্রদায়ের ইতিহাস দুটি পথ ধরে এগোতে পারে। একটি পথ হলো, পৃথিবীতেই কাটিয়ে দেওয়া। বিকল্প পথ হলো, একাধিক গ্রহে বসতি গড়া। আমি আশা করছি, বিকল্প পথটি সঠিক বলে আপনারা একমত হবেন।

ইলন মাস্কের পরিকল্পনায় মঙ্গলে বসতি হবে যেমন
স্পেসএক্স

মাস্ক প্রায়ই তাঁর মঙ্গলে শহর গড়ার স্বপ্নের কথা বলেন। তাঁর ধারণা, টিকে থাকার মতো বসতি গড়তে হলে সেখানে বহুসংখ্যক মানুষের প্রয়োজন। আর সে স্বপ্নের বাস্তবায়ন স্টারশিপের মাধ্যমে সম্ভব হবে বলে মনে করেন তিনি। কারণ, নভোযানটি লাল গ্রহে একসঙ্গে শতাধিক মানুষ নিয়ে যেতে পারবে।

নভোযানটি পুনর্ব্যবহারযোগ্য হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। অর্থাৎ, অন্যান্য নভোযানের মতো স্টারশিপের মূল যন্ত্রাংশগুলো এক উড্ডয়নে বাতিল হয়ে যায় না। বরং মহাকাশ ভ্রমণ শেষে সেগুলো আবার উড্ডয়নের জন্য প্রস্তুত করা হয়। এতে পুরো অভিযানের খরচ কমে যাবে।

মঙ্গলযাত্রায় ইলন মাস্কের নভোযান যেমন

স্টারশিপ নভোযানটির দুটি অংশ। নিচের রকেট অংশটির নাম ‘সুপার হেভি’, আর যে অংশটি মঙ্গলে যাবে, সেটির নাম ‘স্টারশিপ’। পুরো কাঠামোটি ১২০ মিটার লম্বা, সার্বিকভাবে সেটিও স্টারশিপ নামেই পরিচিত। আলোচনার সুবিধার্থে লেখার বাকি অংশে আমরা নিচের অংশটিকে রকেট এবং ওপরের অংশটিকে মহাকাশযান হিসেবে উল্লেখ করব।

স্টারশিপের দুটি অংশ। নিচে থাকবে রকেট, আর ওপরের অংশটি মানুষ নিয়ে যাবে মঙ্গলে
স্পেসএক্স

মহাকাশযান অংশ নিয়েই শুরুতে কথা বলা যাক। মোচাকৃতির নাক এবং অবতরণের জন্য ডানার মতো অংশসহ স্টেইনলেস স্টিলের বাহনটি দেখলে মনে হবে যেন কল্পকাহিনি থেকে উঠে এসেছে। এই অংশ ৫০ মিটারের। সেটির আবার তিনটি অংশ। ডগার দিকে মালামাল বা মানুষ বহনের কামরা আছে। মাঝের অংশের ট্যাংকগুলো থেকে তরল মিথেন ও অক্সিজেন সরবরাহ করা হয় নিচের অংশে থাকা ছয়টি র‍্যাপ্টর ইঞ্জিনে।

স্টারশিপের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে মিথেন। আর মিথেন জ্বালানোর জন্য অক্সিডাইজার হিসেবে কাজ করবে অক্সিজেন। মিশ্রণটি মেথালক্স হিসেবে পরিচিত।

রকেট ইঞ্জিনের জন্য জ্বালানি হিসেবে মিথেনের ব্যবহার কিছুটা বিরল, তবে কার্যকর। তা ছাড়া মঙ্গলে বসতি গড়ার মাস্কের যে পরিকল্পনা, সেখানেও মিথেনের ভূমিকা আছে। স্পেসএক্স প্রতিষ্ঠাতা বলেছেন, মঙ্গলপৃষ্ঠের পানি এবং বায়ুমণ্ডলের কার্বন ডাই–অক্সাইডের মধ্যে বিক্রিয়া করে মিথেন উৎপন্ন সম্ভব হবে। আর পৃথিবীতে ফিরতি যাত্রায় মঙ্গল থেকেই জ্বালানি সংগ্রহ সম্ভব হলে যাওয়া-আসা আরও সহজ এবং সাশ্রয়ী হবে। এক দশকের বেশি সময় ধরে র‍্যাপ্টর ইঞ্জিনগুলো তৈরি করেছে স্পেসএক্স। দহনপ্রক্রিয়া হবে কয়েকটি ধাপে।

র‍্যাপ্টর ইঞ্জিন
স্পেসএক্স

নিচের রকেট অংশটি দৈর্ঘ্যে ৭০ মিটারের। এটি ৩ হাজার ৪০০ টন শীতল মেথালক্সে পূর্ণ থাকবে। রকেট চালাতে ব্যবহার করা হবে ২৮টি র‍্যাপ্টর ইঞ্জিন। এতে স্টারশিপের ১০০ থেকে ১৫০ টন মালামাল নির্দিষ্ট কক্ষপথ পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারবে সুপার হেভি।

উড্ডয়ন ও রিফুয়েলিং

লঞ্চ প্যাড ছেড়ে উড্ডয়নের সময় সমন্বিত স্টারশিপ সিস্টেম নির্দিষ্ট কক্ষপথের দিকে এগিয়ে যাবে। এরপর মহাকাশে যখন ওপরের অংশটি আলাদা হয়ে যাবে, নিচের রকেটটি তখন দিক পাল্টে এগোতে থাকবে পৃথিবীর দিকে। অবতরণের সময় সুপার হেভির নিচ দিক থেকে ডানা (ফিন) বেরিয়ে আসবে। এতে রকেটটি লঞ্চ প্যাডের নির্দিষ্ট জায়গায় ফিরিয়ে আনা সহজ হবে।

ওদিকে স্টারশিপের ওপরের অংশটি রিফুয়েলিংয়ের জন্য ‘পার্কিং কক্ষপথে’ প্রবেশ করবে। সেখানে মহাকাশযানটি আরেকটি স্টারশিপের সঙ্গে যুক্ত হবে। ওই স্টারশিপ পৃথিবীর চারদিকে কক্ষপথে আগে থেকেই ঘুরতে থাকবে। সেটির কাজই হলো, মূল স্টারশিপে অতিরিক্ত জ্বালানির সরবরাহ নিশ্চিত করা।

স্টারশিপের পরীক্ষামূলক সংস্করণের উড্ডয়ন ও অবতরণ

কী কাজে স্টারশিপ ব্যবহার করা হবে?

এক বাক্যে বললে, মঙ্গলে গিয়ে ফিরে আসার দীর্ঘযাত্রার জন্য। মঙ্গল গ্রহের উদ্দেশে পৃথিবী থেকে কেবল একমুখী যাত্রায় ৯ মাস লেগে যেতে পারে। স্টারশিপের ওপরের দিকে পেলোড অংশে ৪০টি কেবিন যুক্ত করার পরিকল্পনা ইলন মাস্কের। তিনি বলেছেন, চাইলে প্রতি কেবিনে সর্বোচ্চ পাঁচ বা ছয়জন মানুষ বহন করা যেতে পারে। তবে আমরা আশা করতে পারি, কেবিনপ্রতি দুই বা তিনজনের বেশি বহন করতে হবে না। অর্থাৎ, মঙ্গলে স্টারশিপের প্রতি যাত্রায় প্রায় ১০০ জন মানুষ বহন করা সম্ভব হবে।

পেলোড অংশে সবার জন্য সাধারণ একটি জায়গা, মালামাল বহনের জন্য একটি জায়গা, একটি গ্যালি এবং একটি আশ্রয়কেন্দ্র থাকবে। সৌরঝড় থেকে বাঁচার জন্য নভোচারীরা আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিতে পারবেন। আবার কেবল মালামাল বহনের জন্যও ব্যবহার করা যাবে স্টারশিপ।

স্টারশিপের এসএন১০ মডেলটি উড্ডয়নের আগে স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবি
রয়টার্স

তা ছাড়া চাঁদে দীর্ঘ সময় থাকার জন্য নাসার আরটেমিস অভিযানেও ভূমিকা রাখতে পারে স্টারশিপ। চাঁদে অবতরণের জন্য স্টারশিপের একটি নকশা দাঁড় করানোর জন্য ২০২০ সালে স্পেসএক্সকে সাড়ে ১৩ কোটি ডলার দিয়েছিল নাসা। আরটেমিস কর্মসূচির জন্য যে সংস্করণটি তৈরি করা হবে, তাতে পৃথিবীতে ফিরে আসার জন্য জরুরি তাপরোধক বা ফ্ল্যাপ থাকবে না। বরং স্টারশিপ হিউম্যান ল্যান্ডিং সিস্টেম পৃথিবী থেকে উড্ডয়নের পর মহাকাশেই রয়ে যাবে।

আরও অনেক কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে স্টারশিপ। পৃথিবীর মধ্যেই দুটি গন্তব্যে দ্রুত ভ্রমণের জন্য হতে পারে। আবার মাস্কের ভাষ্যমতে, ভবিষ্যতে হয়তো বৃহস্পতি বা সৌরজগতের অন্য কোনো গ্রহে অভিযানেও ব্যবহার করা যেতে পারে স্টারশিপ।

পতন হবে আড়াআড়ি। ছবিটি এসএন৯ মডেলের
ইনস্টাগ্রাম থেকে

ওপরের অংশটি অবতরণ করে কীভাবে?

অন্যান্য মহাকাশযান পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রকৌশলীরা প্যারাস্যুটের ওপর ভরসা করেছেন, কিংবা এমনভাবে নকশা করেছেন যেন রানওয়েতে বিমানের মতো অবতরণ করতে পারে। তবে স্টারশিপের ওপরের অংশ ভিন্নভাবে অবতরণ করার পরিকল্পনা রয়েছে। প্রথমে মহাকাশযানটি ৬০ ডিগ্রি কোণে বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করবে। এরপর হবে ‘নিয়ন্ত্রিত পতন’।

পতন হবে আড়াআড়ি। তবে ভূমির দিকে এগিয়ে আসার সময় স্টারশিপের গতি যথেষ্ট কমিয়ে আনা হবে। সবশেষে র‍্যাপ্টর ইঞ্জিনগুলোর সাহায্য নিয়ে নিরাপদ অবতরণের ব্যবস্থা করা হবে। মাস্ক জানিয়েছেন, এমন পরিকল্পনার কারণ হলো, মঙ্গলসহ যেকোনো গ্রহের পৃষ্ঠে অবতরণ সম্ভব করা।

কবে উড্ডয়ন করবে?

গত বছরগুলোতে স্টারশিপের বেশ কয়েকটি পরীক্ষামূলক সংস্করণ বা প্রোটোটাইপ পরীক্ষা করে দেখেছে স্পেসএক্স। শুরুতে ৩৯ মিটার লম্বা স্টারহপার দিয়ে পরীক্ষা চালানো হয়। এসএন৮ হিসেবে পরিচিত মডেলটি ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ১২ দশমিক ৫ কিলোমিটার উচ্চতা পর্যন্ত উড্ডয়ন করে। এদিকে দিন কয়েক আগে এসএন১০ নামের প্রোটোটাইপটি ভূমিতে অবতরণ করলেও গোড়ার চারদিকে আগুন ছড়িয়ে পড়ায় বিস্ফোরণ ঘটে

স্টারশিপে আট সঙ্গীকে নিয়ে চাঁদে যেতে চান জাপানি ধনকুবের ইয়ুসাকু মায়জাওয়া
রয়টার্স

সে যাহোক, জাপানি অনলাইন ফ্যাশন টাইকুন ইয়ুসাকু মায়জাওয়াকে ২০২৩ সালে চাঁদের আশপাশ থেকে ঘুরিয়ে আনবেন বলে জানিয়েছেন ইলন মাস্ক। সে যাত্রায় স্টারশিপে মায়জাওয়ার সঙ্গী হবেন আরও আটজন

মাস্ক আরও জানিয়েছেন, ২০২৪ সালে মঙ্গলে মানুষবিহীন অভিযান চালাতে চান তিনি। সে পরিকল্পনা আপাতদৃষ্টিতে উচ্চাভিলাষী মনে হলেও লোকটা কিন্তু ইলন মাস্ক। যে স্বপ্ন তিনি দেখেন, তা অর্জনের নজির তাঁর ইতিহাস বহু আছে।

সূত্র: বিবিসি