কবিতা লেখা বিজ্ঞানের চেয়ে কঠিন
নোবেলজয়ী মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানী কিপ থর্নকে অনেকে চেনেন মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্তকারী হিসেবে। হলিউডের আলোচিত ছবি ‘ইন্টারস্টেলার’-এর বিজ্ঞানবিষয়ক উপদেষ্টা ও নির্বাহী প্রযোজক হিসেবেও তাঁর পরিচিতি আছে। ২০১৭ সালে নোবেল জয়ের পর নোবেল কর্তৃপক্ষকে একটি বিশেষ সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন তিনি। সেই সাক্ষাৎকারের কিছু নির্বাচিত অংশ থাকল আজ।
ছেলেবেলার স্বপ্ন
আমার বেড়ে ওঠা যুক্তরাষ্ট্রের ইউটার লোগান শহরে, রকি পাহাড়ের দুই হাজার মিটার উঁচুতে। ছেলেবেলা থেকে বরফ আর তুষারপাত দেখে এসেছি। তাই স্বভাবতই একদম ছোটবেলায় স্বপ্ন ছিল আমি বরফ সরানোর ট্রাক ড্রাইভার হব আর নিজ হাতে পাহাড় থেকে বরফের স্তূপ সরাব। কিন্তু আট বছর বয়সে মা একটা লেকচার শুনতে নিয়ে যান। বিষয় ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞান। ওই ক্লাসের পর থেকে আমার মাথায় বরফ সরানোর ট্রাকের বদলে ঢুকে যায় সোলার সিস্টেমের বিষয়-আশয়। বাড়িতে ফিরে মা আর আমি মিলে জ্যোতির্বিজ্ঞান বোঝার জন্য কিছু মজার মজার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করি, জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ের বই পড়া শুরু করি এবং কিছুদিনের মধ্যেই মনস্থির করে ফেলি—আমি জ্যোতির্বিজ্ঞানী হব।
তখন আমার বয়স ১৩। সল্ট লেকের একটা বইয়ের দোকানে একদিন পদার্থবিদ ও মহাবিশ্বতত্ত্ববিদ জর্জ গ্যামের লেখা ওয়ান টু থ্রি ইনফিনিটি নামের বইটা খুঁজে পাই। ওখান থেকেই প্রথমবারের মতো গণিত, তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা ও মহাবিশ্বতত্ত্বের ব্যাপারে গভীরভাবে জানতে পারি। জ্যোতির্বিজ্ঞানের চেয়ে নতুন এসব বিষয় আমাকে টানতে শুরু করে। তাই ১৩ বছর বয়সেই ঠিক করে ফেলি, আমি পদার্থবিদ হব, এর পাশাপাশি সুযোগ থাকলে জ্যোতির্বিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্কিত কাজও করে যাব।
বিজ্ঞানের আনন্দ, বিজ্ঞানীর আনন্দ
বিজ্ঞানের মজা হলো, এর মধ্যে ডুবে থাকায়। মাঝেমধ্যে বিজ্ঞান কঠিন লাগবে, মাঝেমধ্যে লাগবে হতাশাজনক। কিন্তু এর ভেতর ডুবে থেকে যখন জটিল সমস্যাগুলো একটু একটু বুঝতে পারা যায়, সেটাই হয়ে ওঠে এক বিরাট অর্জন। অনেক চেষ্টার পর নতুন কিছু বুঝতে পারা—সে এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি। তোমার গবেষণার ফলাফল আরেকজন বুঝতে পারল কি পারল না, সেটা ব্যাপার নয়। তুমি নিজের থেকে বুঝে অনেক দিনের চেষ্টা আর সংগ্রামের পর একটা জটিল ধাঁধা মিলিয়ে ফেলতে পারলে, সেটাই রাজ্যের প্রশান্তি এনে দেয়। মোট কথা, আবিষ্কারের আনন্দই বিজ্ঞানীর সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
আবিষ্কারের আনন্দের পাশাপাশি আমার জীবনের আরেকটি সুখকর ব্যাপার হলো, নতুনদের তৈরি করা। আমি গর্বের সঙ্গে বলতে পারি যে এ পর্যন্ত ৫০ থেকে ৫৩ বা ৫৪ জন পিএইচডি শিক্ষার্থীকে মেন্টর (পরামর্শদাতা) হিসেবে আমি পথ দেখাতে পেরেছি এবং তাদের মধ্যে বেশির ভাগই আজ নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফল। নিজ নিজ ক্ষেত্রে বলছি এ কারণে যে আমি আমার শিক্ষার্থীদের এমনভাবে তৈরি করেছি যেন তারা কখনোই একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে না আটকে থাকে, যেন তাদের বিজ্ঞান ও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত সবকিছুর ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা থাকে। তাই তো আজ আমার শিক্ষার্থীদের মধ্যে যেমন কেউ সিআইএর বিশ্লেষক আছে, আবার তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার শিক্ষকও আছে। কেউ প্রযুক্তি খাতে কাজ করছে, কেউ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে গেছে। দুজন শিক্ষার্থী তো এখন ফিন্যান্সের দুনিয়ায় বেশ সুনাম কুড়িয়েছে। অথচ একেক দুনিয়ায় স্থায়ী এসব সফল মানুষই সবাই একসময় আমার অধীনে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার ওপর পিএইচডি করেছে—কথাটা মনে পড়লেই ভীষণ আনন্দ হয়।
কিছু উপদেশ
আমার নাতনি কার্নেগি মেলন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এখন পদার্থবিদ্যায় পিএইচডি করছে। পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়ার ইচ্ছার কথা সে যেদিন প্রথম আমাকে বলেছিল, তাকে আমি একটা উপদেশ দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, পদার্থবিদ্যা হচ্ছে এমন একটা গাড়ি, যাতে চড়ে বসলে তোমার সামনে অসংখ্য গন্তব্যের হাতছানি পাবে। কিন্তু এত বিকল্পের (অপশন) মধ্য থেকে তোমাকে বেছে নিতে হবে তাকেই, যে গন্তব্যকে তুমি ভালোবাসবে, যে গন্তব্য তোমাকে টানবে। সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করলেও ভালোবাসা ছাড়া কখনোই তুমি তোমার গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে না। আমার বয়স যখন চার-পাঁচ বছর, তখন আমার দাদা আমাকে এই উপদেশ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘কিপ, সফল হতে চাইলে এমন কাজ করো, যেটা খেলার মতো লাগবে। যেন কঠোর থেকে কঠোর পরিশ্রমও মনের আনন্দে করে ফেলতে পারো।’
আরেকটা কথা আমি অনেককে বলি—নিজের মতো করে কাজ করো। তোমাকে অন্যের দেখানো কায়দায় কাজ করতে হবে, তা নয়। যখন স্নাতকে পড়ছিলাম, তখন বুঝতে পারি আমার মাথা অন্যদের চেয়ে একটু দেরিতে কাজ করে। প্রথম দেড় বছর সবার সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে ভীষণ সংগ্রাম করতে হয়েছিল। এরপর ধীরে ধীরে আমি সবার সঙ্গে তাল মেলানো ছেড়ে দিই, নিজের একটা পদ্ধতি বের করি। যা পড়তাম, ওগুলো হাতে লিখে নোট করে রাখতাম। এভাবে নোট রাখতে শুরু করার পর থেকে আমার জড়তা কেটে গেল। দেরিতে কাজ করা মাথায়ও দ্রুত সব ঢুকতে লাগল।
হলিউড, ‘ইন্টারস্টেলার’ ও পুরোনো প্রেমিকা
এখন পর্যন্ত যা-ই করেছি, জীবনে কখনো পরিকল্পনা করে করিনি। নতুন কিছু করার জন্য সুযোগের হাতছানি পেলেই আমি সেদিকে ছুটে গেছি। সেটা মাধ্যাকর্ষণ তরঙ্গ নিয়ে কাজ হোক, কিংবা ইন্টারস্টেলার ছবির উপদেষ্টার দায়িত্ব—আমার কাছে সবই অপ্রত্যাশিতভাবে পাওয়া সুযোগ।
সিনেমার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার চিন্তা কখনোই করিনি। এরপরও হয়ে গেল। আমি যখন ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকতাম, হলিউডের একজনের সঙ্গে প্রেম করতাম। তাঁর নাম ছিল লিন্ডা ওস্ট। সিনেমার প্রযোজক ছিল সে। পরে অবশ্য সেই প্রেম কোনো পরিণতি পায়নি, তবে আমরা এখনো বেশ ভালো বন্ধু।
তো বেশ কয়েক বছর আগে লিন্ডা একদিন আমাকে ফোন করে। প্রস্তাব দেয়, ‘তুমি কি একদিন আমার সঙ্গে একটা সিনেমার কিছু আইডিয়া নিয়ে বসতে পারবে?’ খুব অল্প সময় ভেবেই আমি রাজি হয়ে যাই। মনে মনে ভাবি, এটা আমার জন্য মজার এক নতুন অভিজ্ঞতা হবে। পাশাপাশি আমি আমার চেয়ে পুরোপুরি আলাদা একটা জগতের কিছু মেধাবী মানুষের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার, আলাপ করার সুযোগ পাব। আর তা ছাড়া হলিউডের ছবির মধ্য দিয়ে বিজ্ঞানের ক্ষমতা, বিজ্ঞানের সৌন্দর্যের যেসব কথা আমি বলতে চাই, সেটা খুব সহজেই লক্ষ-কোটি মানুষকে বলতে পারব। এসব নানা কথা ভেবেই লিন্ডার প্রস্তাবে রাজি হওয়া। টিকিট কেটে কেউ তো আর বিজ্ঞানের লেকচার শুনতে যাবে না, সিনেমা হলেই যাবে। আর একজন বিজ্ঞানের অধ্যাপক তাঁর গবেষণা, তাঁর লেকচার নিয়ে একা কোটি মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারেন না। তাই বলা যায়, সুযোগটা লোভনীয়ই ছিল!
আমরা এরপর আলোচনায় বসলাম, কিছু ভালো আইডিয়াও বেরিয়ে এল। এরপর লিন্ডা আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল ক্রিস্টোফার নোলান ও জনাথন নোলানের সঙ্গে। জানতে পারলাম, তাঁরা এই ছবির চিত্রনাট্য লিখবেন আর পরিচালনা করবেন। তাঁরা দলে যুক্ত হয়ে আমাদের গল্পটা পুরোপুরি বদলে দিলেন, কিন্তু আমার বিজ্ঞানের অংশটা থাকল একেবারে অপরিবর্তিত। আমার সঙ্গে নির্মাতার রসায়নটা বেশ জমে গেল। কারণ, আমাদের দুজনের লক্ষ্যই এক ছিল, আমরা দুজনই খাঁটি বিজ্ঞাননির্ভর একটা সিনেমা বানাতে চাচ্ছিলাম, যেটায় শিল্প ও বিজ্ঞান সমানভাবে গুরুত্ব পাবে।
কবিতা বড় কঠিন
আমি এখন কবিতা নিয়ে আছি। কবিতার বই লিখছি, ওটার জন্য কাজ করছি মেধাবী চিত্রশিল্পীদের সঙ্গে। আমার এখনকার ব্যস্ততা শুধুই আমার শখগুলো নিয়ে। এসবের বাইরে অবসর পেলে আমি আর আমার স্ত্রী পাহাড়ে যাই, স্কুবা ডাইভ করি, স্কি করি। তবে এখন বিজ্ঞানের চেয়ে কবিতা লেখা অনেক কঠিন মনে হয়। তাই কবিতার জন্য সময় দিতে গিয়ে অবসর পাওয়া যায় না। আর এই ব্যস্ততাই আমি বেশি উপভোগ করি। প্রায় ৫০ বছর ধরে পদার্থবিজ্ঞানের কঠিন কঠিন সব গবেষণা আমি ভালোবেসে করে গেছি। এবার কবিতা লেখার নতুন চ্যালেঞ্জে নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কারের সুযোগ পাচ্ছি। এই কাজে নতুন বলে সব খুব কঠিন লাগছে। কঠিনকেই তো ভালোবাসি, এতেই আমার আনন্দ।