বীজগণিতের আদি পিতা

বছরজুড়ে গণিত শিখি

মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল খাওয়ারিজমি

শিরোনাম শুনেই তোমরা হয়তো অনেকে বুঝে গেছো, আজকে আমরা কার সম্পর্কে কথা বলতে যাচ্ছি। হ্যাঁ, আজকে আমরা জানব বীজগণিতের জনক আল খাওয়ারিজমি/খোরিজোমির সম্পর্কে। যিনি গড়ে তুলেছিলেন বীজগণিতের স্তম্ভ। যদিও তাঁর আগেও অনেক গণিতবিদ বীজগণিত নিয়ে বিক্ষিপ্তভাবে কাজ করেছেন, কিন্তু তিনি বিষয়টিকে পূর্ণতা দিয়েছেন। তো চলো, তাঁর সম্পর্কে জানা যাক।

তাঁর পুরো নাম ছিল আবু জাফর মুহাম্মদ বিন মুসা আল খাওয়ারিজমি। মধ্যযুগের বিখ্যাত মনীষীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তিনি। যদিও তাঁর জীবনী নিয়ে সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। কেননা তিনি তাঁর জীবনী লিখে যাননি এবং তাঁর সমসাময়িক কেউ তাঁর জীবনী লেখেননি। এমনকি তাঁর ধর্ম পরিচয় নিয়েও রয়েছে কিছুটা বিতর্ক।

তাঁর জন্মের সাল নিয়ে বিভিন্ন ধরনের তথ্য পাওয়া যায়। জি জে টুমার মনে করেন, খাওয়ারিজমি ৮০০ সালের আগে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৮৪৭ সালের পর মারা যান। কারও কারও মতে, তিনি ৭৮০ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৮৫০ সালে মারা যান। তবে অধিকাংশ ইতিহাসবিদই মনে করেন, তিনি ৭৮০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মস্থান নিয়েও রয়েছে অনেক বিতর্ক। কেউ কেউ মনে করেন, ইরানে কিংবা এর আশপাশের অঞ্চলে।

আল জাবর ওয়াল মুকাবালার কিছু অংশ

তবে কিছু ইতিহাসবিদের মতে, তিনি উজবেকিস্তানের খিবা অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর নামের ভেতরেই রয়েছে এর কিছু সূত্র। মনে করা হয়, ‘খাওয়ারিজমি’ শব্দটি এসেছে ‘খাওয়ারেজম’ শব্দ থেকে। খাওয়ারেজম শব্দটির অর্থ হলো কাঠের আগুনে রান্না করা মাছ বা মাংস। প্রাচীনকালে উজবেকিস্তানের খিবা প্রদেশের একটি অংশ ছিল খাওয়ারেজম। তবে খাওয়ারিজমি ঠিক এই অঞ্চলেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন কি না, এর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

তবে ইতিহাসবিদেরা একমত যে তাঁর পূর্বপুরুষেরা এ প্রদেশে বসবাস করতেন। এবার আসি তাঁর ধর্মের বিষয়টি নিয়ে। অনেকে তাঁর নাম শুনেই ধারণা করতে পারেন যে তিনি ইসলাম ধর্মের অনুসারী ছিলেন। তবে আল তাবারির মতো গবেষক দাবি করেন, খাওয়ারিজমি ইসলাম ধর্মের অনুসারী ছিলেন না। তিনি ছিলেন পারস্য ধর্ম বা জোরাস্ট্রিয়ান। আল তাবারির এ দাবি থেকেই বিতর্কের শুরু হয়। যদিও তাবারির বিপরীতে মত দিয়েছেন খাওয়ারিজমি ছিলেন মুসলিম। তিনি যে মুসলিম ছিলেন, এ বইয়ের সূচনাতে তাঁর কিছু লেখা দেখে তার ধারণা পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন
তিনি লিখেছেন: ‘সব প্রশংসা আল্লাহর প্রাপ্য তাঁর অশেষ নেয়ামতের জন্য। কেবল তিনি এই প্রশংসার অধিকারী এবং তাঁর প্রিয় বান্দাদের জন্য তা অাবশ্যক করেছেন; এবং শুধু তাঁর প্রশংসার মাধ্যমেই এই কৃতজ্ঞতা সম্পন্ন হয়।...... ” [ সূত্র- কিতাব আল জাবর ওয়াল মুকাবালা] ।

এমন শব্দচয়ন কেবল একজন ধর্মপ্রাণ নিবেদিত ব্যক্তির ক্ষেত্রে করা সম্ভব। তিনি একজন মুসলিম ছিলেন, এতে দ্বিমত থাকার কথা নয়।

তাঁর বাল্যজীবন ও শিক্ষাজীবন সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তিনি কীভাবে শিক্ষাজীবনে প্রবেশ করলেন, কে তাঁর শিক্ষাগুরু, সেই সম্পর্কে কোনো তথ্যই পাওয়া যায়নি। তবে কেউ কেউ মনে করতেন, খাওয়ারিজমি বায়তুল হিকমায়

পড়ালেখা করতেন। বীজগণিতের ওপর তাঁর জনপ্রিয় গ্রন্থ আল জাবর ওয়াল মুকাবালা। ‘আল জাবর’ শব্দটি থেকেই অ্যালজেবরা ও অ্যালগরিদম শব্দটি এসেছে। তাঁর এই গ্রন্থে বিভিন্ন বীজগাণিতিক সমস্যা সমাধানের উপায় নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনিই প্রথম দ্বিঘাত সমীকরণের পদ্ধতিগত সমাধান উপস্থাপন করেন। এ ছাড়া তাঁর এই বইয়ে আরও আলোচনা করা হয়েছে বাণিজ্য, ব্যবসায়িক লেনদেন, মূলধন ও ঋণ, দেনমোহর পরিশোধ, পরিমিতি, উত্তরাধিকার পরিশোধসহ নানা বিষয় নিয়ে।

আরও পড়ুন

প্রাচীন মধ্যপ্রাচ্যের গণিতবিদ অনেকের বইয়ে ভারতীয় গণিতবিদদের লেখা অনুবাদ বা পুনঃ আবিষ্কারের কথা জানা গেলেও সুইস-আমেরিকান ইতিহাসবিদ ফ্লোরিয়ান ক্যাজোরির মতে, আল খাওয়ারিজমির বীজগাণিতিক কাজ ভারতীয় গণিতবিদদের কাজ থেকে আলাদা ছিল। তাঁর এ বইয়ে ভারতীয় গণিতবিদদের কোনো লেখা পুনরুদ্ধার বা অনুবাদ করে লেখার মতো কিছু পাওয়া যায়নি। তাঁর আরেকটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল পাটিগণিতের বিষয়ে। তাঁর লেখার মধ্যে রয়েছে কিতাব আল-হিসাব হিন্দি (ভারতীয় পাটিগণিতের যোগ ও বিয়োগ)। তাঁর এই বইয়ে তিনি দশমিক সংখ্যার (হিন্দু-আরবি সংখ্যা) অ্যালগরিদম বর্ণনা করেছেন।

জ্যোতির্বিদ্যাতেও খাওয়ারিজমি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তিনি তাঁর নিজস্ব জ্ঞান ও ভারতীয় গণিতবিদ, জ্যোতির্বিদদের লেখনীর সাহায্য নিয়ে তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থে জ্যোতির্বিদ্যাবিষয়ক বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেছেন। একই সঙ্গে ত্রিকোণমিতি ও ভূগোলেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।

আরও পড়ুন