প্রায় চার বছরের অনিশ্চিত অপেক্ষা শেষে শনিবার বিকেলেই মিলল সুখবর। বাংলাদেশ সেন্সর বোর্ডের আপিল কমিটির সদস্য ও সাংবাদিক শ্যামল দত্ত জানান, মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ছবি ‘শনিবার বিকেল’ মুক্তি দিতে কোনো বাধা নেই। এ উপলক্ষে চলুন দেখে নেওয়া যাক, ছবিটি নিয়ে এ পর্যন্ত কী কী হয়েছে।
২০১৭ সালের ৩০ ডিসেম্বর থেকে ‘শনিবার বিকেল’-এর মহড়ায় অংশ নিতে থাকেন অভিনয়শিল্পীরা। ২০১৮ সালের ৫ জানুয়ারি ঢাকার কোক স্টুডিওতে শুরু হয় ছবিটির শুটিং। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে জানানো হয়, মুক্তির জন্য সিনেমাটি পুরোপুরি প্রস্তুত। এমনকি সেন্সর ছাড়পত্রও পেয়েছে। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে জানানো হয়, মাস দুয়েকের মধ্যেই সিনেমাটি মুক্তি দিতে চাচ্ছে তারা। ছবির অন্যতম প্রযোজক আবদুল আজিজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছবিটি নিয়ে আমাদের অনেক প্রত্যাশা।অবশেষে ছাড়পত্র পেয়েছি। আগামী মার্চ মাসের শেষ দিকে ছবিটি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দেওয়ার পরিকল্পনা করছি। যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে এপ্রিল মাস পর্যন্ত দর্শকদের অপেক্ষা করতে হবে।’
তবে তখনই খবর আসে, সিনেমার একটি সংলাপের ব্যাপারে নিজেদের পর্যবেক্ষণ দিয়ে ছবিটির ছাড়পত্র দিয়েছে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড কর্তৃপক্ষ। জানা যায়, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের সদস্যরা ভাবছেন, ছবিটি ঢাকার হোলি আর্টিজান হামলার ঘটনা অবলম্বনে তৈরি হয়েছে।
অথচ শুরুতে কিন্তু ‘শনিবার বিকেল’-এর প্রশংসা করেছিলেন সেন্সর বোর্ডের কয়েকজন সদস্য। অন্যতম সদস্য ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ বলেছিলেন, ‘ছবিটি ভালো লেগেছে। আমার মনে হয়েছে, ছবিটির গল্পের সঙ্গে হোলি আর্টিজান হামলার ঘটনার যথেষ্ট মিল রয়েছে। তবে এ বিষয়ে পরিচালক ভালো বলতে পারবেন। কারণ, পরিচালক সরাসরি হোলি আর্টিজান বিষয়ে এই সিনেমায় কিছুই বলেননি, একটি আক্রমণ বুঝিয়েছেন। কারিগরি দিক থেকে ছবিটি খুবই সমৃদ্ধ।’
আরেক সদস্য ও চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি মুশফিকুর রহমান বলেন, ‘ভালো চলচ্চিত্রের সব গুণ এই সিনেমায় আছে। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী অন্য ধরনের একটি সিনেমা বানাতে চেয়েছেন। আশা করছি, দর্শকের ছবিটি ভালো লাগবে।’
সিদ্ধান্তের অপেক্ষা
নতুন করে আবার ‘শনিবার বিকেল’ দেখার সিদ্ধান্ত নিল সেন্সর বোর্ড। ২০১৯ সালের অক্টোবরে সেন্সর বোর্ডের তখনকার ভাইস চেয়ারম্যান নিজামূল কবীর প্রথম আলোকে বলেন, এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। তবে সিনেমাটি প্রথমবার দেখার পর সেন্সর বোর্ড সদস্যরা তাঁদের পর্যবেক্ষণ জানান। এরপর আরেক দফা সিনেমাটি দেখার ব্যবস্থা করা হয়।
সেন্সর বোর্ডের সচিব মোহাম্মদ আলী সরকারের সঙ্গেও কথা বলেছিল প্রথম আলো। তখন তিনি জানান, দুই দফা দেখার পরও সিনেমাটির কয়েকটি সংলাপ নিয়ে এখনো কিছু পর্যবেক্ষণ রয়ে গেছে। তা ছাড়া পুরো সিনেমা নিয়ে বোর্ড সদস্যরা তাঁদের পর্যবেক্ষণের কথা জানিয়েছেন। দেখা যাক, কী হয়। সিনেমাটি দেখলে এ-ও বোঝা যায়, এটি হোলি আর্টিজান বেকারিতে ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসী আক্রমণ ও জিম্মিদশাকে অবলম্বন করে (বানানো)।
আনুষ্ঠানিক চিঠি পাওয়ার আগে বোর্ডের সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। তবে নিজের সিনেমাটি নিয়ে ফারুকী বলেন, ‘এটা কোনোভাবেই হোলি আর্টিজানের ঘটনা নিয়ে নয়। আমাদের গল্পের চরিত্রগুলোর সঙ্গে হোলি আর্টিজানের ঘটনার কোনো মিল নেই। তবে হোলি আর্টিজানের চরিত্রগুলোর আত্মত্যাগ, বীরত্বগাথা কোথাও কোথাও আছে। এই বীরত্ব এবং আত্মত্যাগ থেকে আমরা উৎসাহিত হয়েছি। আসলে আমি অন্য রকম একটা গল্প বলতে চেয়েছি।’
২০১৯ সালে ১৫ সদস্যের সেন্সর বোর্ড সর্বসম্মতিক্রমে সিনেমাটি প্রদর্শনের উপযোগী নয় বলে মত দেন। সেন্সর ছাড়পত্র নিয়ে নানা ঘটনার মধ্যেই মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের প্রতিযোগিতা বিভাগে নির্বাচিত হয় ‘শনিবার বিকেল’। ২০১৯ সালের এপ্রিলে উৎসবে ছবিটির ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ারও হয়। পরে অস্ট্রেলিয়া, প্যারিস, কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশের উৎসবে ছবিটি প্রদর্শিত হয়।
ছবিটি আদতে দেশের ভাবমূর্তিকে আরও উজ্জ্বল করবে এবং দেশটির ধর্মীয় সহিষ্ণুতা সবার হৃদয় ছুঁয়ে যাবে—২০১৯ সালে ‘শনিবার বিকেল’ নিয়ে এমনটাই লেখেন মার্কিন সংবাদমাধ্যম হলিউড রিপোর্টার।
সোচ্চার সংস্কৃতি অঙ্গন
২০২২ সালে ‘শনিবার বিকেল’–এর দ্রুত মুক্তি দাবি করে সরব হন নির্মাতা, চলচ্চিত্র সমালোচকেরা। ছবিটির দ্রুত ছাড়পত্র দিতে কলম ধরেন নির্মাতা মোরশেদুল ইসলাম, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, সমালোচক ফাহমিদুল হক। একই বছরের নভেম্বরে ‘শনিবার বিকেল’-এর মুক্তি চেয়ে বিবৃতি দেন ১২৯ সংস্কৃতিকর্মী। তাঁরা বলেন, ‘সিনেমা-নাটক-সংগীত, শিল্পসংস্কৃতির এমন নানা ক্ষেত্রে, নানা সময় হাজির করা হচ্ছে বহুমুখী বাধা। এটি আমাদের উদ্বিগ্ন করছে।’
বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি রক্ষার দায়িত্ব এখন আপিল কমিটির কাঁধে এসে পড়েছে। আমরা কি বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে এমন দেশ হিসেবে পরিচিত করতে চাই, যেখানে শিল্পের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে?
এর মধ্যেই জানা যায়, হোলি আর্টিজানের ঘটনা নিয়ে নির্মিত বলিউড সিনেমা ‘ফারাজ’ মুক্তি পাবে আগামী ৩ ফেব্রুয়ারি। এরপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের অভিমান, হতাশা প্রকাশ করেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। একই ঘটনা নিয়ে চার বছর আগে সিনেমা বানিয়েও মুক্তি দিতে পারছেন না, এটা তিনি মানতেই পারছিলেন না তিনি। বিষয়টি নিয়ে নিয়মিত ফেসবুকে সরব থেকেছেন নির্মাতা। তাঁকে সমর্থন জানিয়েছেন অনেক নির্মাতা, অভিনয়শিল্পী থেকে শুরু করে সাধারণ দর্শক।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা আলোচনার মধ্যেই জানা যায়, ২১ জানুয়ারি ‘শনিবার বিকেল’ নিয়ে শুনানি হবে। জানানো হয়, মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে সভাপতি ও সেন্সর বোর্ডের চেয়ারম্যানকে আহ্বায়ক করে গঠিত সাত সদস্যের সেন্সর আপিল কমিটিতে সদস্য হিসেবে থাকবেন সংসদ সদস্য ও বিশিষ্ট অভিনয়শিল্পী সুবর্ণা মুস্তাফা, সাবেক অতিরিক্ত সচিব নূরুল করিম, অভিনেত্রী সুচরিতা ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দত্ত এবং সদস্যসচিব হিসেবে থাকবেন সেন্সর বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান।
আপিল কমিটির শুনানির আগে প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেছিলেন, ‘বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি রক্ষার দায়িত্ব এখন আপিল কমিটির কাঁধে এসে পড়েছে। আমরা কি বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে এমন দেশ হিসেবে পরিচিত করতে চাই, যেখানে শিল্পের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে? এ ছাড়া বলতে চাই, আমার দেশের একটা ঘটনার ছায়া অবলম্বনে আমি ছবি বানিয়েছি। বিদেশি একজন চলচ্চিত্রকার তো সে ঘটনারই চিত্রায়ণ করেছেন। ফেব্রুয়ারি মাসের ৩ তারিখে সেটা বিশ্বব্যাপী মুক্তি পাবে। এটা শুধু আমাদের দেশের চলচ্চিত্রকারদের আত্মমর্যাদার প্রশ্ন নয়, বাংলাদেশেরই আত্মমর্যাদার ভার। আপিল কমিটি নিশ্চয়ই ব্যাপারটা গুরুত্ব দিয়ে দেখবে।’
অবশেষে সেই বহুল প্রতীক্ষিত রায়টি এল। শনিবার বিকেলেই জানা গেল ‘শনিবার বিকেল’ মুক্তিতে আর বাধা নেই।