এই চেহারা নিয়ে নায়ক হওয়া সম্ভব না...
মোহাম্মদ তাওকীর ইসলামের ‘দেলুপি’তে মিহির চরিত্রে অভিনয় করে আলোচনায় রুদ্র রায়। নির্মাণেও যুক্ত আছেন তরুণ এই অভিনেতা। খুলনায় বন্ধুদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। রুদ্রর আরও গল্প শোনাচ্ছেন নাজমুল হক
ছোট থেকেই চারুকলা নিয়ে পড়ার ইচ্ছে। আঁকাআঁকির প্রতি ছিল আলাদা টান। কিন্তু স্কুলশিক্ষক বাবা-মা সেই ইচ্ছাটাকে খুব একটা ভালোভাবে নেননি। তাঁদের ধারণা, চারুকলায় পড়লে ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। তারপরও দুবার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলায় ভর্তি পরীক্ষা দেন, কিন্তু কোনোবারই নির্বাচিত হতে পারেননি রুদ্র রায়।
এই ব্যর্থতা শুধু তাঁকে নয়, তাঁর পরিবারকেও হতাশ করে। আত্মীয়স্বজনের কটাক্ষ, বাবা-মায়ের সহকর্মীদের প্রশ্ন আর তুলনা—সব মিলিয়ে চাপ বাড়তে থাকে। তাঁর প্রেমিকা পর্যন্ত মন্তব্য করেন, ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার চেয়ে বিয়ে করে ফেলা ভালো।’ কথাটি রুদ্রকে আঘাত করে। এর মধ্যেই খুলনার সরকারি ব্রজলাল (বিএল) কলেজে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। চারুকলার পথ বন্ধ হলেও সেখানেই আরেকটা নতুন পথের খোঁজ পান রুদ্র, থিয়েটার। স্বপ্ন দেখেন একদিন অনেক বড় অভিনেতা হবেন, নাম লেখাবেন সিনেমায়। এ কথা শুনে তাঁর প্রেমিকা বলেছিলেন, ‘এই চেহারা নিয়ে নায়ক! সম্ভব না।’ রুদ্র তখন বলেছিলেন, ‘একদিন টিকিট কেটে আমাকে দেখতে আসতে হবে।’
থিয়েটারে হাতেখড়ি
২০১৯ সালের জানুয়ারিতে বিএল কলেজে থিয়েটার দলের একটি নাটক দেখে নিজের পথ খুঁজে পান রুদ্র। পরের সপ্তাহ থেকেই থিয়েটারে নিয়মিত যেতে শুরু করেন। এরপর জেলা শিল্পকলা একাডেমিতেও যোগ দেন। ব্যাকস্টেজেই সময় যেত বেশি। রুদ্রের কথায়, ‘ব্যাকস্টেজে হাততালি দিতে দিতেই ছয় মাস কেটে যায়। তবে এ সময়ে মঞ্চের শৃঙ্খলা, সময়নিষ্ঠা ও দলগত কাজ শিখি। যা আমার জীবনকে আজ এ জায়গায় নিয়ে এসেছে।’ আস্তে আস্তে কলেজের থিয়েটার দলের হয়ে মঞ্চে নিয়মিত সুযোগ পেতে থাকেন রুদ্র।
দেলুপিতে যুক্ত হওয়া
সুকর্ণ শাহেদ ধীমানের সিরিজ ফেউ দিয়ে পর্দায় নাম তোলেন রুদ্র। ছোট চরিত্র হলেও নির্মাতার তাঁকে দারুণ পছন্দ হয়ে যায়। ‘দেলুপি’র জন্য যখন খুলনার অভিনেতা খুঁজছিলেন তাওকীর ইসলাম, তখন রুদ্রকে পরিচয় করিয়ে দেন ধীমান। গত বছরের আগস্টের প্রথম সপ্তাহে রুদ্রকে ফোন করেন তাওকীর। রুদ্রর কথায়, ‘তাওকীর ভাইয়ের সঙ্গে আমার আগে ফোনে কথা হয়েছিল। তো ২৫ আগস্টে ভাই ফোন দিয়ে বললেন, খুলনা স্টেশনে থেকে দেলুটি আসবে নিলয়দা (টিম মেম্বার)। আমি যেন তাঁর সঙ্গে চলে আসি। পথে আরেক অভিনেতা চিরঞ্জিত বিশ্বাসকে তুলে নিই। এরপর প্রথমে ইজিবাইক ও পরে সাদুরঘাট থেকে নৌকায় করে পৌঁছে যাই দেলুটি। গ্রামের কালীনগর কলেজে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত প্রায় নয়টা। আমার কোমর পর্যন্ত তখন কাদায় মাখা! এ অবস্থায় তাওকীর ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। ভাই আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলেন, “আমি তাওকীর।” কণ্ঠ শুনেই চিনে ফেলেছিলাম। সেই স্মৃতি ভোলার নয়।’
দেলুপির নেপথ্যেও
খুলনার পাইকগাছা উপজেলার দেলুটি ইউনিয়নে হয় ‘দেলুপি’ সিনেমার শুটিং। প্রথমে তথ্যচিত্র রেকর্ডিংয়ের পর সিনেমার বাকি অংশের শুটিং করেন নির্মাতা। টানা চার মাস, আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত চলে এ কর্মযজ্ঞ। এর মধ্যে এ সিনেমার দৃশ্য ধারণ হয়েছে ৩২ দিন। অভিনয়ের পাশাপাশি এ ছবির নেপথ্যেও কাজ করেন রুদ্র। চিত্রনাট্য থেকে সংলাপ লেখায় তাওকীর ইসলামের সহকারীর দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
৯৯ মাল্টিমিডিয়া
রুদ্র রায়ের নিজের গড়া একটা টিমও আছে—‘৯৯ মাল্টিমিডিয়া’। ২০১৯ সালের দিকে শখের বশে বন্ধুদের সঙ্গে ছোট ছোট ভিডিও বানানো থেকেই টিমটির যাত্রা। টিমের প্রায় সবার জন্ম ১৯৯৯ সালে, সে কারণেই এই নাম। শুরুতে শুধু ফোনে ভিডিও করতেন। এখন টিমের সদস্য ৩০-৩২ জন, আর খুলনার একটি ফ্ল্যাটেই প্রোডাকশন, এডিটিং ও থাকার আলাদা ব্যবস্থা। টাকা রোজগারের উদ্দেশ্যে নয়, মানসিক তৃপ্তির জন্যই এ প্ল্যাটফর্মটি চালাচ্ছেন তাঁরা। অন্যের কপিরাইট গান ব্যবহার করায় অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে আয় নেই, তারপরও টিমটি টিকে আছে স্রেফ ভালোবাসার কারণে। রুদ্র নিজে এই টিমে অভিনয়, পরিচালনা, চিত্রনাট্য লেখা থেকে শুরু করে সিনেমাটোগ্রাফি—সবই করেছেন। তাঁর শৈশবের বন্ধু জিত এবং পার্থও এই টিমের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। রুদ্রের পাশাপাশি এ দুজনও ‘দেলুপি’র নেপথ্যে কাজ করেছেন।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
একসময় ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করতেন যে বাবা-মা, তাঁরাই আজ এ সন্তানকে নিয়ে গর্বিত। মা স্কুলে গেলে সহকর্মীরা রুদ্রের অভিনয় নিয়ে আলোচনা করেন, বাবা বাজারে গেলেই লোকের মুখে শোনা যায়, ‘ছেলে ‘দেলুপি’তে দারুণ করেছে।’ বিএল কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্স শেষ করে মাস্টার্সে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছেন রুদ্র। অভিনয়ের পাশাপাশি নির্মাতার খাতায়ও নাম লেখাতে চান। তাই চারুকলা নয়, রুদ্রর এখন ফিল্ম নিয়ে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার ইচ্ছে।