প্রেমের মেট্রো-যাত্রায় জীবনের গল্প

‘মেট্রো...ইন দিনো’ সিনেমায় আদিত্য রায় কাপুর ও সারা আলী খান। ছবি: এক্স থেকে

অনুরাগ বসু মানেই ভিন্নধর্মী প্রেমের গল্প। ২০০৭ সালে ‘লাইফ ইন আ...মেট্রো’তে প্রেম, বন্ধন, বিচ্ছেদ আর জীবনের ছোট ছোট আবেগের গল্পই অন্য রকমভাবে বলেছিলেন। ১৮ বছর পর ‘মেট্রো ইন দিনোঁ’ সিনেমায় সেই গল্পেরই নতুন অধ্যায় নিয়ে ফিরলেন তিনি। সময়ের সঙ্গে বদলেছে প্রেমের ধরন, বদলেছে জীবনযাত্রা; কিন্তু হৃদয়ের টান, দাম্পত্যের টানাপোড়েন, প্রেমে পড়ার অনুভূতি এখনো ততটাই জীবন্ত। এটাই অনুরাগ বসুর ছবির শক্তি—সময় যতই বদলাক, প্রেমের ভাষা থেকে যায় একই।

ছবি: ‘মেট্রো ইন দিনোঁ’
পরিচালক: অনুরাগ বসু
সংগীত পরিচালক: প্রীতম
অভিনয়শিল্পী: অনুপম খের, নীনা গুপ্তা, পংকজ ত্রিপাঠী, কঙ্কণা সেন শর্মা, আলী ফজল, ফাতিমা সানা শেখ, আদিত্য রায় কাপুর, সারা আলী খান, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়।

চার জুটি, চার রঙের গল্প
ছবির কেন্দ্রে আছে চার জুটি। তাঁদের জীবন ভিন্ন, চাওয়া-পাওয়া আলাদা, কিন্তু এক সুতায় গাঁথা—ভালোবাসা। শিবানী (নীনা গুপ্তা) সংসারের চাপে স্বপ্ন বিসর্জন দিয়েছেন বহু আগেই। স্বামী সঞ্জীবের (শ্বাশত চট্টোপাধ্যায়) পরকীয়া মেনে নিয়ে সংসার চালিয়েছেন সন্তানের মুখ চেয়ে। কলেজ পুনর্মিলনীতে পরিমলের (অনুপম খের) সঙ্গে হঠাৎ দেখা, আবার নতুন করে দানা বাঁধে পুরোনো প্রেম। প্রেম এখানে বয়সের বেড়াজালে আটকে নেই—এটা স্মৃতির, প্রশ্রয়ের, হারিয়ে যাওয়া আবেগের গল্প।

‘মেট্রো ইন দিনো’ ছবির পোস্টার থেকে। আইএমডিবি

মন্টি (পঙ্কজ ত্রিপাঠী) আর কাজল (কঙ্কণা সেন শর্মা) প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন। এখন সংসার একঘেয়ে, রুটিনমাফিক। একে অপরের সঙ্গে কথা বলাও ফিকে হয়ে এসেছে। ডেটিং অ্যাপে নতুন এক নারীর প্রেমে জড়িয়ে পড়েন মন্টি। তারপর তাঁদের দাম্পত্যে যে ঝড় ওঠে, সেটাই গল্পের গুরুত্বপূর্ণ রসদ। গায়ক হতে চায় আকাশ (আলী ফজল), কিন্তু স্বপ্নের পথে বাস্তবতা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। শ্রুতি (ফাতিমা সানা শেখ) চায় মা হতে, আকাশ চায় না। তাদের প্রেমের গল্প একদিকে আবেগের, অন্যদিকে স্বপ্ন-বাস্তবতার দ্বন্দ্বে আটকে থাকা। পার্থ (আদিত্য রায় কাপুর) একজন ভ্রমণবিলাসী ব্লগার, বাউন্ডুলে প্রকৃতি। চুমকি (সারা আলী খান) ঠিক তার বিপরীত—সংসারী, চায় স্থিতিশীল জীবন। তাদের হঠাৎ দেখা, তারপর ধীরে ধীরে সম্পর্ক বদলে যাওয়া—এটাই চুমকি-পার্থের গল্পের মূল সুর। এই চরিত্রগুলো নিয়ে নিজের মতো করে গল্পটা বলেছেন অনুরাগ।

অনুরাগের গল্প বলা
যদি বলি ‘মেট্রো ইন দিনোঁ’ সিনেমার সবচেয়ে বড় সম্পদ গান, বাড়াবাড়ি হবে না। প্রীতমের সুরে প্রেম, বিরহ, আকাঙ্ক্ষা, হাসি-কান্না—সব আবেগই খেলা করেছে। পাপন, রাঘব চৈতন্যর পাশাপাশি প্রীতম নিজেও গেয়েছেন, যা ছবির আবহকে আরও গভীর করে তুলেছে। গানের কারণে হয়তো মনে হবে, সংলাপ জায়গা কম পেয়েছে। কিন্তু সেটাই ছবির মাধুর্য। পুরো ছবিটাই যেন সংগীতের জোয়ারে ভাসা এক প্রেমগাথা। তারপরও বলব, অনুরাগ বসুর সিনেমার সবচেয়ে বড় শক্তি তাঁর গল্প বলা। ‘মেট্রো ইন দিনোঁ’ও তার ব্যতিক্রম নয়। এই ছবিতে তিনি দেখিয়েছেন, প্রেম একরৈখিক না।

‘মেট্রো ইন দিনো’ ছবির বিভিন্ন দৃশ্য। কোলাজ

চিরকাল প্রেমের মধ্যে থাকে বেদনা, টানাপোড়েন, লুকিয়ে থাকা চাওয়া-পাওয়া। গল্পের আবহ, দৃশ্যভাষা, সংলাপ—সব মিলিয়ে ছবিটি প্রেমের সুরভিতে আচ্ছন্ন। সিনেমার প্রতিটি চরিত্র রক্তমাংসে বাস্তব। মনে হবে এদের গল্প তো আমাদের চারপাশেই ঘটে চলেছে। এখানেই অনুরাগের জাদু। এবারও জাদুটা ভালোভাবেই দেখাতে পেরেছেন।

ভালো–মন্দ
সংলাপ এই ছবির অন্যতম সেরা সম্পদ। আর প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ছবিটা দেখে একটা কথা বারবার মনে হয়েছে, এটা অভিনয়সমৃদ্ধ প্রযোজনা। নীনা গুপ্তা–অনুপম খেরের পরিণত বয়সের প্রেমের গল্পে চোখ জুড়িয়ে যায়। তাঁদের পরিণত অভিনয় বারবার মনে নাড়া দিয়েছে। পঙ্কজ ত্রিপাঠী ও কঙ্কণা সেন শর্মার কমিক টাইমিং, দাম্পত্যের টানাপোড়েন ফুটিয়ে তোলা এককথায় দুর্দান্ত। এটা বলতে পারি, আলী ফজল ও ফাতিমা সানা শেখের জুটি নিয়ে অনেক দিন আলোচনা চলবে। তাঁদের প্রেমের গভীরতা, সংলাপের সংবেদনশীলতা দারুণ লেগেছে। বয়সে নবীন সারা আলী খান আর আদিত্য রায় কাপুরের মিষ্টি রসায়ন ছবির সবচেয়ে হালকা, প্রাণবন্ত অংশ। ছবিতে স্বল্প উপস্থিতিতে শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় বুঝিয়ে দিয়েছেন যে কত বড় অভিনেতা তিনি। সব মিলে অভিনয়ে সবাইকে এ প্লাস দিলে অবিচার হবে না বলে মনে করছি। কেউ কারও চেয়ে কম না।

এবার ‘মেট্রো ইন দিনোঁ’র খামতি কী কী জানা যাক। ছবির দ্বিতীয়ার্ধে কিছু অংশ বেশি ধীর মনে হয়েছে। কিছু দৃশ্যে অতিরিক্ত নাটকীয়তা, কোথাও গানের আধিক্যও চোখে লেগেছে। মনে হয়েছে সিনেমা দেখছি না কনসার্টে এসেছি! তবে ছবির প্রধান পরিচয়, এটি মিউজিক্যাল রোমান্টিক ছবি—তাই এই বিষয়টা উপেক্ষা করাই যায়।

আরও পড়ুন

সব ছাপিয়ে ‘মেট্রো ইন দিনোঁ’ মূলত সময়ের প্রেমকাহিনি। প্রেম, দাম্পত্য, যৌনতা, বিচ্ছেদ, পুনর্মিলন—সবকিছু নিয়ে তৈরি এই ছবি এক আবেগঘন অভিজ্ঞতা। সিনেমার শেষে আপনার মনে একটাই প্রশ্ন ঘুরবে—সময় বদলায় ঠিকই, কিন্তু প্রেম কি সত্যিই বদলায়? ২ ঘণ্টা ৪২ মিনিটের এই ছবি গানে, কথায়, হাসিতে, আবেগে আপনাকে বেঁধে রাখবে।