বলিউডে নতুন বিতর্ক, এআই কি নায়ক-নায়িকা ও নির্মাতাদের তাড়াবে

‘রানঝানা’ সিনেমার পোস্টার থেকে। আইএমডিবি

ঝলমলে গান-নাচ আর বিশাল প্রোডাকশন টিমের জন্য পরিচিত বলিউডে এখন নতুন এক আলোড়ন—কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই। আলোচিত ছবির সমাপ্তি বদলানো থেকে শুরু করে পুরোপুরি এআইনির্ভর চলচ্চিত্র তৈরি—সব মিলিয়ে ভারতের কয়েক বিলিয়ন ডলারের চলচ্চিত্রশিল্পে তৈরি হয়েছে নতুন উত্তেজনা, আশঙ্কা, বিতর্ক ও বিভাজন।

‘রানঝানা’ দিয়ে বিতর্কের সূচনা
২০১৩ সালে মুক্তির পর আনন্দ এল রাইয়ের ‘রানঝানা’ দর্শক-সমালোচক উভয়ই পছন্দ করেন। এক যুগ পর সিনেমাটি নতুন করে মুক্তি পায়। কিন্তু এই মুক্তি নিয়েই নির্মাতা আনন্দ এল রাই আর প্রযোজনা সংস্থা ইরোস ইন্টারন্যাশনালের মধ্যে প্রচণ্ড বিতর্ক শুরু হয়েছে। কারণ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে সিনেমাটির সমাপ্তি বদলে মুক্তি দিয়েছে ইরোস। এতেই খেপেছেন নির্মাতা। তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন অন্য নির্মাতা, লেখক ও অভিনয়শিল্পীরা।

ছবির নায়ক ধানুশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখেন, ‘এই বিকল্প সমাপ্তি ছবির আত্মাটাকেই কেড়ে নিয়েছে।’ তিনি সতর্ক করে বলেন, এভাবে এআই ব্যবহার করা শিল্পী ও শিল্প উভয়ের জন্যই বাজে নজির হয়ে রইল।
পরিচালক রাই স্পষ্ট করে বলেন, এআই ভবিষ্যৎ, কিন্তু অতীত পাল্টানোর জন্য নয়।

‘রানঝানা’ সিনেমার দৃশ্য। আইএমডিবি

ভারতের প্রথম এআইনির্ভর পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি
বিতর্কের পরপরই এন্টারটেইনমেন্ট প্রতিষ্ঠান কালেকটিভ আর্টিস্টস নেটওয়ার্ক ঘোষণা দেয় ভারতের প্রথম পূর্ণাঙ্গ এআই জেনারেটেড চলচ্চিত্রের—‘চিরঞ্জীবী হনুমান: দ্য ইটার্নাল’। পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে ২০২৬ সালে মুক্তি পেতে যাওয়া ছবিটি পৌরাণিক গল্পকে বিশ্বমঞ্চে প্রযুক্তির নতুন মোড়কে উপস্থাপন করার লক্ষ্য নিয়েছে।
কিন্তু এ ঘোষণাকে সবাই স্বাগত জানাননি। নির্মাতা বিক্রমাদিত্য মোতওয়ানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, ‘এবং শুরু হলো। লেখক-পরিচালকের আর দরকার কী, যখন সবই মেড ইন এআই!’

শিল্প বনাম প্রযুক্তি
একদিকে আছেন তাঁরা, যাঁরা মনে করেন, এআই বলিউডের শ্রমনির্ভর প্রযোজনা থেকে বিপুল খরচ বাঁচাবে—অতিরিক্ত শিল্পী থেকে শুরু করে শত শত টেকনিশিয়ান পর্যন্ত। অন্যদিকে অনেকে মনে করেন, শিল্পের আত্মা নির্ভর করে মাংস-রক্তের শিল্পীর ওপর, এআই সেখানে বিকল্প নয়।
নির্মাতা শাকুন বাত্রা বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, সেরা ভবিষ্যৎ তখনই আসবে, যখন প্রযুক্তি ও মানব সৃজনশীলতা একসঙ্গে কাজ করবে। এআই কখনোই মানুষের প্রকাশক্ষমতার বিকল্প হতে পারে না।’

শেখর কাপুর। এএফপি

শেখর কাপুরের দৃষ্টিভঙ্গি
ভারতের ইতিহাসের অন্যতম সেরা পরিচালক শেখর কাপুর (‘মাসুম’, ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’, ‘এলিজাবেথ’, ‘ব্যান্ডিট কুইট’ নির্মাতা) বিষয়টি অন্যভাবে দেখছেন। তাঁর মতে, ভালো গল্পের জায়গায় এআই আসতে পারবে না।

শেখর বলেন, সবচেয়ে ভালো গল্পগুলোই অনিশ্চিত মোড় নেয়, আর এআই অনিশ্চয়তাকে সামলাতে পারে না। আর দারুণ অভিনয়ও এআইয়ের নাগালের বাইরে। কারণ, সেরা অভিনেতাদের চোখই আসল অভিনয় করে, মুখ নয়।

আরও পড়ুন

শেখর কাপুরের মতে, যাঁদের ছবি কেবল ফর্মুলায় গড়া, তাঁরাই সবচেয়ে ঝুঁকিতে। ‘আপনার সিনেমা যদি অনুমেয় হয়, তবে এআই আপনাকে ধ্বংস করবে’, বলেন তিনি। তবে এর মধ্যেও তিনি আশার আলো দেখেন, ‘এআই সবার জন্য দারুণ এক প্রযুক্তি। যাঁরা কখনো ফিল্ম স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পেতেন না, তাঁদের জন্যই এটি সুযোগ তৈরি করবে।’

শেখর কাপুর মুম্বাইয়ের ধারাভি বস্তিতে একটি এআইকেন্দ্রিক ফিল্ম স্কুল খোলার পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছেন। তাঁর মতে, এআই নতুন সৃজনশীলতার দরজা খুলে দিতে পারে, এমনকি জন্ম দিতে পারে নতুন প্রজন্মের এআইনির্ভর চলচ্চিত্র তারকা ও চরিত্র।

শেষ কথা দর্শকের
তবে শেষ পর্যন্ত সিনেমার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবেন দর্শকই। ‘রানঝানা’র পরিচালক রাই বলেন, ভক্তরা যখন মূল সমাপ্তিকে সমর্থন করেছেন, সেটিই সবচেয়ে বড় সান্ত্বনা। ‘তাদের প্রতিক্রিয়া আমার প্রতিক্রিয়ার চেয়েও অনেক বড়। এটা আমার চেয়ে বেশি তাদেরই ছবি’, বলেন রাই।

তথ্যসূত্র: এএফপি