সাহসী দৃশ্যে তোলপাড়, সত্তরের আলোচিত সেই নায়িকাকে ভুলে গেছে বলিউড
‘আমি এত নগ্ন পুরুষ দেখেছি, এখন আর পোশাক পরা পুরুষদের সহ্য করতে পারি না।’ ১৯৭০ সালের বলিউড ছবি ‘চেতনা’য় এক তরুণ যৌনকর্মী তাঁর দ্বিধাগ্রস্ত গ্রাহককে উদ্দেশ করে বলেছিলেন কথাটি। বয়স তখন ২০, সদ্য ফিল্ম স্কুল-পাস করা রেহানা সুলতান অভিনয় করেছিলেন সেই যৌনকর্মীর ভূমিকায়। রক্তলাল শিফনের শাড়ি পরা সেই সিনেমা দিয়েই চমকে দিয়েছিলেন অভিনেত্রী। মনে করা হয়েছিল, হিন্দি সিনেমার আগামী দিনের তারকা হবেন তিনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রেহানা হয়ে গেছেন হিন্দি সিনেমার বিস্তৃত এক নাম। আজ ১৯ নভেম্বর রেহানা সুলতানের জন্মদিন। এ উপলক্ষে আলো ফেলা যাক তাঁর ক্যারিয়ারে।
সাহসী ব্যতিক্রম
সত্তরের দশকের শুরু, ভারতে তখনো ‘ধীরে চলা’ সমাজ। কয়েক বছর আগেও সেন্সর বোর্ড ‘লেডি চ্যাটারলিজ লাভার’ নিষিদ্ধ করেছিল। বলিউডে তখনো বাজিমাত করত আবেগময়, গান-নাচের বড় বড় ছবি। নির্মাতা শ্যাম বেনেগালের ভাষায়, সেই সময়ের নায়িকাদের ‘পবিত্র ও কুমারী’ হিসেবে দেখাতে হতো।
কিছুদিনের মধ্যেই প্রযোজকেরা তাঁকে দিতে লাগলেন একের পর এক ‘দুঃসাহসী’ চরিত্র—যেগুলো আসলে বৃষ্টির দৃশ্য, বাথটব দৃশ্য—এমন সব চিত্রনাট্য, যার উদ্দেশ্যই কেবল নারীর শরীর দেখানো। এক প্রযোজকের দেওয়া অশ্লীল চিত্রনাট্য দেখে রেহানা সরাসরি পালিয়ে যান।
এই সময়ের প্রথাভাঙা সিনেমা ছিল ‘চেতনা’—এক উদ্বাস্তু যৌনকর্মীর পুনর্বাসন নিয়ে তৈরি সাহসী কিন্তু অসম এক ছবি। সেই ছবির পরিচালক ছিলেন অদ্ভুত খামখেয়ালি মানুষ বি আর ইশারা। ছবিটি যেন ভারতকে নাড়িয়ে দিয়েছিল।
এক সমালোচক লিখেছিলেন, ‘রেহানা সুলতান যৌনকর্মীর ভূমিকায় চমকে দেওয়ার মতো সাহসী চরিত্রায়ণ করেছেন।’ আরেক সমালোচক লিখেছিলেন ‘নারীর দৃঢ় অবস্থানের নির্ভীক উপস্থাপনার। যৌনতার নতুন অধ্যায়ের পথপ্রদর্শক।’
কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ ছবি ভুলে গিয়ে নতুন রেহানাকে নিয়ে মেতে ছিলেন। দ্রুতই তাঁর নামের সঙ্গে ‘যৌন আবেদনময়ী’ তকমা যুক্ত হয়।
‘দস্তক’—আরেক ঝাঁকুনি
১৯৭০ সালে বছরের শেষদিকে মুক্তি পায় রেহানাকে নিয়ে আরেক ছবি—‘দস্তক’। উর্দু লেখক রাজিন্দর সিং বেদীর পরিচালিত এই চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছে এক নবদম্পতির দুর্দশার গল্প। ভুলবশত তাঁরা ভাড়া নিয়েছিলেন এমন একটি ঘর, যা আগে ছিল এক নর্তকীর। ফলে আগের ক্লায়েন্টদের দরজায় টোকা (দস্তক) তাঁদের নিত্যসঙ্গী।
এ ছবিতে রেহানা ছিলেন এক নিঃসঙ্গ, হতাশ তরুণী—স্বামী (অভিনেতা সঞ্জীব কুমার) কাজের জন্য বাইরে থাকায় চার দেয়ালের মাঝে বন্দী।
দুই ছবির পরই রেহানা তৎকালীন বলিউডের প্রিয় মুখ হয়ে ওঠেন। কেউ কেউ তাঁকে বলেছিলেন ‘নতুন ঢেউয়ের সিনেমার প্রথম সুপারস্টার’—কারণ, তিনি দুটি সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। সত্যজিৎ রায় পর্যন্ত তাঁর কাজের প্রশংসা করেন। সবচেয়ে বড় কথা, রেহানা ‘দস্তক’-এর জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জেতেন (যদিও ‘চেতনা’ আগে মুক্তি পেয়েছিল)। ভারতের জনপ্রিয় চলচ্চিত্র ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদেও জায়গা হয় তাঁর।
এই ছবির পোস্টারেও রেহানাকে বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখা যায়। সিনেমার প্রচারে বলা হয়েছিল ‘এক সেকেন্ডের নগ্ন দৃশ্য’ আছে—যদিও বাস্তবে তিনি কেবলই কাঁধ উন্মুক্ত করেছিলেন। আসলে ‘দস্তক’ কোনোভাবেই অশ্লীল ছবি ছিল না।
লেখক অদ্বিজিৎ ঘোষের ভাষায়, ছবিটি ছিল ‘সত্তরের দশকের নিম্নমধ্যবিত্ত ভারতীয়দের প্রতিদিনের দ্বিধা আর সিদ্ধান্তের গল্প।’
আকাশচুম্বী উত্থান, তারপরই বিতর্ক
দুই ছবির পরই রেহানা তৎকালীন বলিউডের প্রিয় মুখ হয়ে ওঠেন। কেউ কেউ তাঁকে বলেছিলেন ‘নতুন ঢেউয়ের সিনেমার প্রথম সুপারস্টার’—কারণ, তিনি দুটি সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। সত্যজিৎ রায় পর্যন্ত তাঁর কাজের প্রশংসা করেন। সবচেয়ে বড় কথা, রেহানা ‘দস্তক’-এর জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জেতেন (যদিও ‘চেতনা’ আগে মুক্তি পেয়েছিল)। ভারতের জনপ্রিয় চলচ্চিত্র ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদেও জায়গা হয় তাঁর।
কিন্তু আলোচনার মূল কেন্দ্র বারবার ফিরে আসছিল তাঁর ‘সাহসী দৃশ্য’-এর দিকে।
সমালোচক ফিরোজ রাঙ্গুনওয়ালা লিখলেন, ‘দৃশ্যগুলো প্রমাণ করে—ভারতীয় সিনেমা অবশেষে প্রাপ্তবয়স্কে পৌঁছেছে।’ তাঁর সাহসী দৃশ্য নিয়ে এত কথা হলো যে কেউই খেয়ালই করল না যে রেহানা তাঁর প্রথম ছবিতেই জাতীয় পুরস্কার জিতেছেন।
আরও ‘দুঃসাহসী’ চরিত্রের প্রস্তাব—তারপর পালানো
কিছুদিনের মধ্যেই প্রযোজকেরা তাঁকে দিতে লাগলেন একের পর এক ‘দুঃসাহসী’ চরিত্র—যেগুলো আসলে বৃষ্টির দৃশ্য, বাথটব দৃশ্য—এমন সব চিত্রনাট্য, যার উদ্দেশ্যই কেবল নারীর শরীর দেখানো। এক প্রযোজকের দেওয়া অশ্লীল চিত্রনাট্য দেখে রেহানা সরাসরি পালিয়ে যান। পরে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘সংলাপগুলো সাহসী নয়, নোংরা। অসুস্থ লাগত।’
অধিকাংশ প্রস্তাবই তিনি ফিরিয়ে দেন। দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি টুকটাক অভিনয় করেন, কিন্তু আর কখনো সেই সাফল্যের কাছে যেতে পারেননি। ১৯৮৪ সালে পরিচালক ইশারাকে বিয়ে করার পর ধীরে ধীরে পর্দা থেকে হারিয়ে যান।
একজন সমালোচক সত্তর দশকেই লিখেছিলেন, ‘চেতনা’র পোস্টারই তাঁকে সাহসী ভূমিকায় দেখা গেছে। সেটাই ছিল কার্যত তাঁর ক্যারিয়ারের ‘ইতি’। কারণ, ভারতে আপনি যাই করেন, একবার কোনো তকমা গায়ে লাগলে সেটা থেকে বেরিয়ে আসা মুশকিল।
তিনি পরে বলেন, ‘হ্যাঁ, আমাকে টাইপকাস্ট করা হয়েছিল। সবাই ভাবত আমি মানেই যৌনতা। প্রযোজকেরা আসত বৃষ্টির দৃশ্য, বাথটব দৃশ্য নিয়ে। আমি বলতাম—ভারতের ঘরে ঘরে কি বাথটব আছে? এত অবাস্তব কেন? তাই ফিরিয়ে দিতাম।’
চলচ্চিত্রকার সুধীর মিশ্র বলেন, ‘তাঁরা তাঁকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিল, তারপর ভুলে গেল। তিনি আমাদের দেশে প্রথমদিকের পেশাদার প্রশিক্ষিত অভিনেত্রীদের একজন। সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলেন। আর আজ তিনি ভুলে যাওয়া এক নাম—এটাই আমাদের শিল্পের নিষ্ঠুরতা।’
ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে বলিউডে—অন্য রকম যাত্রা
১৮ বছর বয়সে হুট করেই রেহানা ভারতীয় চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে আবেদন করেছিলেন। দুই সপ্তাহ পর স্ক্রিন টেস্ট, তারপরই ভর্তি। স্টানিস্লাভস্কির বই পড়েছেন, শত শত ছবি দেখেছেন, অড্রে হেপবার্ন ও সোফিয়া লরেন ছিলেন তাঁর প্রিয়। ভিট্টরিও দে সিকার ‘বাইসাইকেল থিভস’ আর ‘ইয়েস্টারডে, টুডে, অ্যান্ড টুমরো’ তাঁর প্রিয় ছবি। ইনস্টিটিউটে ছাত্রদের তৈরি ডজন ডজন ছবিতে অভিনয় করেছিলেন তিনি।
সমালোচক রউফ আহমেদের ভাষায়, ‘তিনি ছিলেন নিখুঁত, স্বাভাবিক অভিনেত্রী। লাজুক ছিলেন না, আবার আদর্শ নিরীহ নায়িকাও ছিলেন না।’
রেহানা গত বছর আবার আলোচনায় আসেন, অভিনয় নয় অসুস্থতার কারণে। হৃদ্যন্ত্রে জটিল অস্ত্রোপচারের জন্য আর্থিক সংকটে পড়েন অভিনেত্রী। সেই কঠিন সময়ে বলিউডের অনেকেই এগিয়ে এসে তাঁকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছেন, যাতে তিনি চিকিৎসা ও দৈনন্দিন খরচ সামলাতে পারেন। পরে রোহিত শেঠি, রাজন শাহী, রমেশ তৌরানি, বিপুল শাহ, জাভেদ আখতার অনেকেই তাঁকে আর্থিকভাবে সাহায্য করেন।
টাইপকাস্টের অভিশাপ—নায়িকাদের চিরন্তন সমস্যা
বলিউডে নায়কেরা ভুল করলে পরের ছবিতে তা ঠিক করার সুযোগ পায়। কিন্তু নায়িকাদের? নির্মাতা শ্যাম বেনেগাল বলেন, ‘নায়িকাদের দ্বিতীয় সুযোগ নেই। একবার ছাপ লেগে গেলে সহজে মুছবে না।’
একজন সমালোচক সত্তর দশকেই লিখেছিলেন, ‘চেতনা’র পোস্টারই তাঁকে সাহসী ভূমিকায় দেখা গেছে। সেটাই ছিল কার্যত তাঁর ক্যারিয়ারের ‘ইতি’। কারণ, ভারতে আপনি যাই করেন, একবার কোনো তকমা গায়ে লাগলে সেটা থেকে বেরিয়ে আসা মুশকিল।
তিনি লিখেছিলেন, ‘পুরুষতান্ত্রিক দর্শকের কাছে রেহানা মানে তিন অক্ষরের একটি শব্দ—সেক্স। পোশাক পরলেই তিনি মূল্যহীন। তাই “চেতনা” আর “দস্তক”-এর পর তাঁর প্রতিটি ছবিই ভদ্র, নিস্তেজ হাই তোলার মতো।’
অসুস্থতার কারণে আলোচনায়
রেহানা গত বছর আবার আলোচনায় আসেন, অভিনয় নয় অসুস্থতার কারণে। হৃদ্যন্ত্রে জটিল অস্ত্রোপচারের জন্য আর্থিক সংকটে পড়েন অভিনেত্রী। সেই কঠিন সময়ে বলিউডের অনেকেই এগিয়ে এসে তাঁকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছেন, যাতে তিনি চিকিৎসা ও দৈনন্দিন খরচ সামলাতে পারেন। পরে রোহিত শেঠি, রাজন শাহী, রমেশ তৌরানি, বিপুল শাহ, জাভেদ আখতার অনেকেই তাঁকে আর্থিকভাবে সাহায্য করেন।
বলিউড বদলাচ্ছে—তবু রেহানা সুলতান কোথায়
সময় বদলেছে, কিছু নারী নির্মাতা ও নতুন প্রজন্মের পরিচালক পুরোনো ফর্মুলা ভাঙতে চাইছেন। কিন্তু সত্তরের দশকের এই নির্ভীক অভিনেত্রী?
আলো-ঝলমলে দুনিয়া থেকে দূরে আজও তিনি অভিনয় করতে চান। রেহানার কথায়, ‘অভিনয়কে ভীষণ মিস করি। ক্যামেরা, সেটের পরিবেশ—সবকিছু। মনে হয় কেন থামলাম? আবার অভিনয় করতে চাই। কিন্তু আজ কে আমাকে নেবেন?’
বলিউডের প্রযোজকেরা কি তাঁর ডাক শুনতে পাবেন?
বিবিসি অবলম্বনে