‘চিঠঠি আয়ি হ্যায়’সহ পঙ্কজ উদাসের জনপ্রিয় পাঁচ গানের গল্প

দেশের সীমা পার হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে ‘চিঠঠি আয়ি হ্যায়, আয়ি হ্যায়’র সুর! এই গজলের সুরলহরি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনত মানুষকোলাজ

সময়টা আশির দশক। গজলের মূর্ছনায় ভরে উঠেছে ভারতের আকাশ-বাতাস। দেশের সীমা পার হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে ‘চিঠঠি আয়ি হ্যায়, আয়ি হ্যায়’র সুর! এই গজলের সুরলহরি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনত মানুষ। কখন যে চোখ ভরে উঠত, বুঝতেই পারতেন না শ্রোতারা। বলছি বিখ্যাত এই গজলের শিল্পীর কথা, যাঁর নাম পঙ্কজ উদাস। এখন অনন্তকালের পথে পাড়ি জমিয়েছেন এই গজলসম্রাট। তাঁর প্রয়াণে পতন ঘটল সংগীতজগতের বিশাল এক নক্ষত্রের। প্রিয় শিল্পীকে হারিয়ে হতাশার কালো মেঘ ডানা মেলেছে ভক্ত-সহকর্মীদের হৃদয়েও।

শুধু ‘চিঠঠি আয়ি হ্যায়’ নয়, পঙ্কজ উদাসের গাওয়া ‘চান্দি জ্যায়সা রঙ্গ’, ‘না কাজরে কি ধার’, ‘দিওয়ারো সে মিলকার রোনা’, ‘আহিস্তা’, ‘থোড়ি থোড়ি পেয়ার করো’, নিকলো না বেনাকাব’-এর মতো গজলের সুরে এখনো মনকে জাগিয়ে তোলেন ভক্ত-শ্রোতারা। এই মহাতারকার সংগীতজীবনের ৩৫ বছরে তাঁর বিশেষ ৫টি গানের স্মৃতিকথা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ভারতীয় গণমাধ্যম আনন্দবাজার পত্রিকা। গানগুলো হলো, ‘চিঠঠি আয়ি হ্যায়’, ‘জিয়ে তো জিয়ে ক্যায়সে বিন আপকে’, ‘চান্দি জ্যায়সা রঙ্গ’, ‘অওর আহিস্তা কিজে বাতেঁ’, ‘দিওয়ারো সে মিলকার রোনা আচ্ছা লাগতা হ্যায়’। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ওঠা এই সেরা পাঁচ গানের গল্প উঠে এসেছে শিল্পীর কণ্ঠে।

আরও পড়ুন

চিঠঠি আয়ি হ্যায়
খুদে বার্তা পাঠানোর চল সবে এসেছে। আগে না ছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, না ছিল মুঠোফোন। একটা সময় ছিল যখন কাগজ-কলমই ছিল অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম। বলছি চিঠির কথা। তখনকার সময় প্রেম–ভালোবাসাসহ সব অনুভূতিরই একমাত্র বাহক বা মাধ্যম ছিল চিঠি। তাই চিঠিকে ঘিরে কত গান, কবিতা, গল্প-উপন্যাস! প্রবাসে থাকা প্রিয়জনের কাছে অনুভূতির দলিল এই চিঠি। চিঠি এলেই যে প্রিয়জনের মনে শিহরণ জেগে উঠত। সেই চিঠি নিয়েই পঙ্কজ উদাসের গান, ‘চিঠঠি আয়ি হ্যায়. . ’। এই গানই তাঁকে টেনে নিয়ে এসেছে একালে। বর্তমান সময়ে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগে, তিনিই যেন হাতে লেখা চিঠির ধারক ও বাহক।
‘চিঠঠি আয়ি হ্যায়’ গানের পেছনের গল্প বলতে গিয়ে স্মৃতিকাতর হয়ে যান শিল্পী পঙ্কজ উদাস। এই গান তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। দেশ ও কালের সীমানা ছাড়িয়ে গেছে ‘চিঠঠি আয়ি হ্যায়’। পঙ্কজ উদাস বলেন, ‘চিঠি নয়, সেদিন আমার কাছে সরাসরি ফোন এসেছিল। এই একটা ফোনে বদলে গেছে আমার পুরো জীবন। ফোনে নিজের “নাম” ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন রাজেন্দ্র কুমার। কিন্তু তত দিনে আমার “মুকারার” আর “তরন্নাম”–এর মতো গজলের অ্যালবাম দেশ-বিদেশে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। বিদেশে কয়েকটি অনুষ্ঠানও হয়েছে। এমন অবস্থায় হঠাৎ আমি অভিনয় করতে যাব কেন? ওটা তো আমার জায়গাই নয়! কিন্তু মুখের ওপর রাজেন্দ্র কুমারের মতো মানুষকে “না” বলার সাহসটাই করে উঠতে পারিনি। পরিস্থিতি সামলে নিতে লুকোচুরি করে বেড়াচ্ছিলাম তখন।

‘রেগে যান রাজেন্দ্রকুমার। এবার আর আমাকে নয়, ভাই মানহর উদাসের কাছে ফোন গেল! ভাইকে বললেন, “তোমার ভাই তো খুব বেয়াদব।” তবে একসময় সাহস সঞ্চয় করে অভিনয়ে না আসার কারণটা তাঁকে বুঝিয়ে বলতে পেরেছিলাম। এবার আর অভিনয় নয়, আমাকে দিয়ে লাইভ গান করানোর প্রস্তাব দিয়ে বসলেন তিনি। গানে তো আমি রাজিই। পাঁচটা বৈঠকে সাত মিনিটের গান। লেখা হলো ‘চিঠঠি আয়ি হ্যায়, বতনসে চিঠঠি আয়ি হ্যায়। বড়ে দিনো কে বাদ…’
পঙ্কজ উদাস বলেন, ‘তখন ফেসবুক বা স্কাইপে কিছুই ছিল না। প্রবাসের সঙ্গে দেশের যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে ওঠে “চিঠঠি আয়ি হ্যায়” গানটি। দেশের জন্য মন কেমন করছে? প্রবাসের মানুষগুলোর সঙ্গে তাঁদের প্রিয়জনদের বেঁধে দিত এই গান। এভাবে কেটে গেছে ৩৫ বছর। আজ খুব মনে পড়ছে সেই সব দিনের কথা, চিঠির শুরুর সময়ের কথা। ফিরে তাকালে মনে হয়, “চিঠঠি আয়ি হ্যায়” গানটির মাধ্যমে নামে-বেনামে কত মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছি আমি। এই গান থেকে এ জন্মে যেন পঙ্কজ উদাসের মুক্তি নেই। সেই গানের বয়সও এখন তিরিশ।’

মুম্বাইয়ে আয়োজিত ‘খাজানা গজল উৎসব ২০১৭’–তে গজল পরিবেশন করতে গিয়েছিলেন শিল্পীরা। অনুশীলনের সময় ক্যামেরাবন্দী হয়েছেন বাঁ দিক থেকে জাভেদ আলী, পঙ্কজ উদাস, ভুপেন্দ্রর সিংহ ও মিতালি মুখার্জি: এএফপি

কিন্তু গানটার রেকর্ডিং খুব একটা সহজ ছিল না বলে জানান পঙ্কজ। ‘নাম’ ছবির সেই দৃশ্যের শুটিং ছিল মুম্বাইয়ে। শিল্পী বলেন, ‘তখন লাইভ গাইতে হতো। কনসার্টের পরিবেশ তৈরি করে ৬০ জন মিউজিশিয়ানের সঙ্গে এক টেকেই গান ওকে। গান গেয়ে আমি তো মহা চিন্তায়! ভেবেছি আবার গাইতে হবে। হঠাৎ দেখি, গান শুনে কান্নায়

ভেঙে পড়লেন লক্ষ্মীকান্তের স্ত্রী। আর লক্ষ্মীকান্ত বললেন, “এ গান অনেক দূর যাবে।” এই তো সেদিন দিল্লির এক কনসার্টে আমার হাত ধরে কেঁদেই ফেলেছিল একটি ছেলে। বলল, “চিঠঠি আয়ি হ্যায় গানটা শুনে মনে হলো, ভোপালে থাকা আমার মা–বাবার কথা সামনে থেকে শুনছি...।”
‘এমন কোনো অনুষ্ঠান আমার মনে পড়ে না যেখানে “চিঠঠি আয়ি হ্যায়” গাইতে হতো না। মঞ্চ থেকে দেখি, কত মানুষের চোখে পানি। কেউ মনে করছেন বিদেশে থাকা প্রিয়জনের কথা, আবার কেউ ভালোবাসার মানুষের কথা ভেবেই অশ্রুসজল হয়ে উঠেছেন।’

পঙ্কজ উদাস
এএনআই

জিয়ে তো জিয়ে ক্যায়সে বিন আপকে
‘চিঠঠি আয়ি হ্যায়’ গানের তুমুল জনপ্রিয়তার পর রটে যায় যে ছবিতে পঙ্কজ উদাসের গান মানেই ছবি সুপারহিট। শিল্পী বলেন, এরপর ‘সজন’ ছবিতে “জিয়ে তো জিয়ে ক্যায়সে বিন আপকে” গাইলাম। ছবিতে ছিলেন মাধুরী দীক্ষিত, সঞ্জয় দত্ত, সালমান খান। আমার গান শুনে মাধুরীও গেয়ে উঠলেন। ও খুব ভালো গান করে, এটা অনেকেই জানেন না। গানের শুটিংয়ের পর সালমান বলে উঠল, বাহ! পঙ্কজ ভাই বাহ! ক্যামেরা তখনো অন। চিত্রনাট্যে এমন কোনো সংলাপই ছিল না। কিন্তু সালমান এত সাবলীলভাবে বলেছিল যে সংলাপটি রেখেই দেওয়া হলো। আজও অনুষ্ঠানে গেলে এই গান গাইতেই হয়। তখন দর্শকদের ভেতর কেউ না কেউ বলবেনই, বাহ! পঙ্কজ ভাই বাহ!’

চান্দি জ্যায়সা রঙ্গ
প্রেমের গান হিসেবে জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠেছিল ‘চান্দি জ্যায়সা রঙ্গ’। শিল্পী বলেন, ‘আমার তো মনে হয় এই গান প্রেমের চিরকালীন “ন্যাশনাল অ্যানথেম”। প্রেমের গানে গানেই বহু গায়ক বনে যান অদৃশ্য প্রেমিক। আজ বলতে দ্বিধা নেই যে এখনো ভালোবাসার রঙিন খামে প্রচুর চিঠি পাই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও আসে প্রেমের বার্তা। এটাও জানি যে এত ভালোবাসা, প্রেম আমার জন্য নয়, আমার গানের জন্য।

আমিও একসময় প্রেমে পড়েছি, গেয়ে উঠেছি “চান্দি জ্যায়সা রঙ্গ”। কত মানুষ এই গান শুনিয়ে পাঠিয়েছেন প্রেমের প্রস্তাব। অনুষ্ঠানে তো এই গান গাইতেই হয়। গাওয়ার আগে বলে নিই, প্রেমিকা রেগে থাকলে এই গান শোনার পর সাত দিনের বেশি রেগে থাকবে না।’

পঙ্কজ উদাস
ফেসবুক থেকে

অওর আহিস্তা কিজে বাতে

‘অওর আহিস্তা কিজে বাতে’ গানের শুটিংয়ে এক অস্ট্রেলিয়ান ছেলের সঙ্গে ভারতীয় এক মেয়ের প্রেমকাহিনি বলা হয়েছিল। গানের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে পঙ্কজ উদাস বলেন, ‘আমার তো মনে হয়, ভালোবাসার কোনো সীমা কিংবা ভাষা নেই। আমার রোমান্স বৃষ্টির সঙ্গে। অঝোর ধারাই আমাকে দিয়ে গান গাইয়ে নেয়।’৫.

দিওয়ারো সে মিলকার রোনা আচ্ছা লগতা হ্যায়

গজল উৎসবে ‘দিওয়ারো সে মিলকার রোনা আচ্ছা লাগতা হ্যায়’ গানটি গাওয়ার সময় নিজের বাবার শেষ অবস্থার খবর পান পঙ্কজ উদাস। কিন্তু তিনি থেমে যাননি। গানটি শেষ করে হাসপাতালে ছুটে যান বাবার কাছে। শেষবার দেখা হয় বাবার সঙ্গে। এখনো এই গান গাইতে গাইতেই বাবাকে দেখতে পান শিল্পী।সাক্ষাৎকারে নিজের দীর্ঘ সংগীতজীবনের স্মৃতিচারণা করেন পঙ্কজ উদাস।

পঙ্কজ উদাস
ইনস্টাগ্রাম থেকে

বলেন, ‘যখন শুনতে পাই, অমিতজি (অমিতাভ বচ্চন) বলেন, জলসায় আমার গান বাজে, বুঝতে পারি না কী বলব এই বিখ্যাত মানুষকে। তিনি আমার গানের খবর রাখেন! এসব মন্তব্যই জীবনে বেঁচে থাকা। সংগীতজীবনের শুরু থেকে আমার সঙ্গে আছেন বন্ধু সুনীল গাভাস্কর। বাইরে কোথাও গেলে আজও বন্ধুর ট্র্যাভেল ব্যাগে থাকে আমার গজল। ভাগ্যবান না হলে শচীন তাঁর আত্মজীবনীতে আমার গানের কথা লেখেন? যেদিন পড়লাম, বিস্মিত হলাম। শচীন লিখেছেন, তিনি ও তাঁর বাবা পঙ্কজ উদাসের গানের ভক্ত। আজীবন শাহরুখ খান আমার গানের ভক্ত। কারণ, জীবনের শুরুর দিকে দিল্লিতে আমার একটি অনুষ্ঠানে শ্রোতাদের আসনে বসিয়ে প্রথম আয় করেছিল সে। তাঁরা সবাই আমাকে সমৃদ্ধ করেছেন।’