ব্যক্তিগত ভিডিও ফাঁসের কারণেই কি থমকে যায় রিয়ার ক্যারিয়ার
মা মুনমুন সেন, নানি সুচিত্রা সেন, রিয়া সেনও এসেছিলেন অভিনয়ে। শুরুটা মন্দ ছিল না। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকেই ‘স্টাইল’ সিনেমা ব্যবসায়িক সাফল্য পায়। ছিলেন মডেল। হিন্দি, বাংলাসহ অনেক সিনেমারই প্রস্তাব আসতে থাকে। একের পর এক সিনেমায় যুক্ত হন। কিন্তু পরে হঠাৎই হারিয়ে যান। এখনো অভিনয় করলেও উল্লেখযোগ্য সিনেমা সিরিজের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে আর তাঁকে দেখা যায় না। তিনি আর কেউ নন, রিয়া সেন।
শুরুর গল্প
মাত্র ১৬ বছর বয়সে ফাল্গুনী পাঠকের জনপ্রিয় গান ‘ইয়াদ পিয়া কি আনে লগি’-এর মিউজিক ভিডিও দিয়ে রাতারাতি পরিচিতি পান রিয়া সেন। ১৯৯৮ সালে মুক্তি পাওয়া সেই গান থেকেই শুরু তাঁর আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসা। এরপর ১৯৯৯ সালে তামিল ছবি ‘তাজমহল’-এর মাধ্যমে বড় পর্দায় অভিষেক। দুই দশকের বেশি সময়ের অভিনয় ক্যারিয়ারে তিনি কাজ করেছেন ৩০টির বেশি ছবিতে।
‘স্টাইল’, ‘কেয়ামত’, ‘ঝংকার বিটস’, ‘শাদি নম্বর ওয়ান’, ‘আপনা সাপনা মানি মানি’—এমন একাধিক জনপ্রিয় ছবির মাধ্যমে রিয়া সেন একসময় বলিউডে পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছিলেন। দেখা গেছে বাংলাদেশের সিনেমাতেও।
‘সিনেমা নির্বাচন নিয়ে তখন খুব রোমাঞ্চিত ছিলাম’
ভারতীয় সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে একবার রিয়া বলেন, বলিউডে শুরুর দিনগুলোতে নিজের করা চরিত্রগুলো নিয়ে তিনি ভীষণ উচ্ছ্বসিত ছিলেন। তাঁর মনে হচ্ছিল, সঠিক পথেই এগোচ্ছেন। কিন্তু কয়েকটি সফল ছবির পর ধীরে ধীরে একধরনের ‘লেবেল’ তাঁকে অস্বস্তিতে ফেলতে শুরু করে।
তাঁর ভাষায়, ‘আমি বুঝতে পারলাম, যেসব ছবি আমি করছিলাম, সেগুলো আর আমার সঙ্গে মানানসই লাগছিল না। আমি যে ধরনের চরিত্র করছিলাম, তাতে আমি স্বচ্ছন্দ ছিলাম না। সম্ভবত এ কারণেই মানুষ ভাবতে শুরু করে আমি খারাপ অভিনেত্রী, এতে আমি কাউকে দোষ দিই না। তখন বলিউডে মেয়েদের ক্ষেত্রে বিষয়টা ছিল গ্ল্যামারাস হওয়া—কী পোশাক পরছেন, কী মেকআপ করছেন, সবকিছুই বাহ্যিক সৌন্দর্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল। আমি সেখানে ঠিক মানিয়ে নিতে পারছিলাম না।’
‘ট্যাগ পাওয়াটা ছিল ভয়ংকর অভিজ্ঞতা’
রিয়া আরও জানান, অল্প বয়সে ‘সাহসী’ অভিনেত্রীর তকমা পাওয়াটা তাঁর জন্য মানসিকভাবে খুবই কষ্টদায়ক ছিল। ‘এই ট্যাগগুলো পাওয়া ছিল ভীষণ খারাপ একটা অভিজ্ঞতা। আমি তখন স্কুলে পড়তাম, অথচ সেই সময় থেকেই আমাকে ওই ধরনের লেবেল দেওয়া হচ্ছিল। সব সময় একটা নির্দিষ্টভাবে দেখতে হবে, এই চাপ খুব বেশি ছিল। বাইরে বের হলেও মানুষ ভাবত, “ও তো রিয়া সেন-স্ক্রিনে যেমন দেখি, বাস্তবেও সে ঠিক তেমনই।”’
‘পর্দায় নিজেকে দেখে অবাক হয়ে যেতাম’
ক্যারিয়ারের পরের দিকে এসে সব সময় গ্ল্যামারাস থাকার চাপ তাঁকে আরও বিচলিত করে তোলে। তিনি বলেন, ‘সবাই গ্ল্যামারাস হতে চায়, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি খুব অল্প বয়সে এই জগতে এসেছিলাম। যখন নিজেকে পর্দায় দেখতাম, তখন মনে হতো, ইশ! এটা কি সত্যিই আমি?’
রিয়া আরও যোগ করেন, ‘আমি খুব অস্বস্তি অনুভব করতে শুরু করেছিলাম। একদমই আমি যা, তার সঙ্গে এই চরিত্রগুলো মিলছিল না। প্রতিদিন শুটিং সেটে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চুল কোঁকড়ানো, ভারী মেকআপ নিয়ে বসে থাকা—এগুলো আর আমাকে টানত না। তখনই আমি সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নিই যে বলিউডে কাজ করা বন্ধ করব।’
বলিউড থেকে বাংলা সিনেমার পথে
যেটা বলিউডের জন্য একধরনের ‘ক্ষতি’ ছিল, সেটাই হয়ে ওঠে বাংলা সিনেমার জন্য লাভ। রিয়া সেন নতুনভাবে নিজেকে খুঁজে পান ঋতুপর্ণ ঘোষ পরিচালিত ‘নৌকাডুবি’ (২০১১) ছবিতে। এরপর তিনি কাজ করেন ‘জাতিস্মর’ ও ‘হিরো ৪২০’ সিনেমায়।
রিয়ার কথায়, ‘বাংলা ছবিতে আমি আমার নিজের মতো হতে পেরেছি। সেখানে নানা ধরনের চরিত্রে কাজ করেছি। আমি অনুভব করেছি, সেখানে পরিচালকেরা আমার ভেতরের সম্ভাবনাটাকে বেশি বুঝতে পেরেছেন। বলিউডে আমি অন্যের চাহিদা অনুযায়ী কাজ করতাম। এখন আমি জানি, আমি কী দিতে পারি।’
ওয়েব সিরিজে নতুন স্বাধীনতা
স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের উত্থান তাঁর অভিনয়জীবনকে নতুন প্রাণ দিয়েছে বলেও মনে করেন রিয়া। বাংলা ছবিতে জায়গা করে নেওয়ার পর তিনি ওটিটি দুনিয়াও আস্তে আস্তে নিজেকে তৈরি হতে দেন।
২০১৭ সালের পর থেকে তিনি ‘রাগিণী এমএমএস: রিটার্নস’, ‘পয়জন’, ‘মিসম্যাচ’-এর মতো হিন্দি ও বাংলা ওয়েব সিরিজে কাজ করেছেন। রিয়া বলেন, ‘ওটিটির কাজ উপভোগ করছি। ওয়েব সিরিজ আমাকে বিভিন্ন ধরনের চরিত্রে কাজ করার সুযোগ দিচ্ছে। সাধারণ বলিউড ফর্মুলার ছবির চেয়ে এই জগতে আমি নিজেকে বেশি মানানসই মনে করি। আমি বলছি না যে আর কখনো বলিউডে কাজ করব না, তবে এখন যেখানে আছি, সেখানে আমি খুব খুশি।’
কারণ কি ব্যক্তিগত ভিডিও
দীর্ঘ ক্যারিয়ারে রিয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু অনেকে মনে করেন ব্যক্তিগত ভিডিও ফাঁসের জেরেই থমকে যায় তাঁর বলিউড ক্যারিয়ার। এখন টুকটাক কাজ করলেও আগের হারানো অবস্থান আর ফিরে পাননি।
২০০৫ সালে রিয়া সেনের একটি ব্যক্তিগত ভিডিও ফাঁস হয়। ধারণা করা হয়, ভিডিওতে তাঁর সঙ্গে ছিলেন রিয়ার সেই সময়ের প্রেমিক আসমিত প্যাটেল। এ ঘটনা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই তুমুল বিতর্ক শুরু হয়। অনেক সিনেমা থেকে বাদ পড়েন তিনি। পরে টুকটাক অভিনয় করলেও রিয়া আর অভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি।
এখন রিয়া
আজকাল সিনেমা ও সিরিজের পার্শ্ব চরিত্রেই বেশি দেখা যায় রিয়াকে। চলতি বছর হিন্দি সিনেমা ‘নাদানিয়া’য় দেখা গেছে রিয়াকে। এ ছাড়া মুক্তির অপেক্ষায় আছে ওয়েব সিরিজ ‘পরিণীতা’।
বলিউড লাইফ অবলম্বনে