ঢাকার বাইরে ছড়িয়ে পড়ছে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি

সৈয়দা নিগার বানুর ‘নোনাপানি’, কৌতূহলের ‘দুঃসাহস’, মোহাম্মদ তাওকীর ইসলামের ‘দেলুপি’ ও সুব্রত সঞ্জীবের ‘আঁধারের আলো’র দৃশ্য। কোলাজ

তরুণ নির্মাতারা একসময় ধরেই নিতেন সিনেমা, নাটক নির্মাণ বা কারিগরি বিষয়ে দক্ষ হওয়ার জন্য ঢাকামুখী হওয়া ছাড়া উপায় নেই। সেখানে ভিন্ন পথে হেঁটেছেন একাধিক নির্মাতা ও প্রযোজক; জেলা বা বিভাগীয় শহরেই গড়ে তুলেছেন নির্মাণের আলাদা জগৎ।

রাজশাহীতে একঝাঁক তরুণ
দুই সপ্তাহ আগে হলে মুক্তি পেয়েছে ‘দেলুপি’। সিনেমার শুটিং হয়েছে খুলনায়। এটি পরিচালনা করেছেন মোহাম্মদ তাওকীর ইসলাম। সিনেমার কলাকুশলী ও টিমের অন্য সদস্যরা বেশির ভাগ রাজশাহী ও খুলনার। এই পরিচালক নিজেও বেড়ে উঠেছেন রাজশাহীতে। রাজশাহীতেই গড়ে তুলেছেন তাঁর প্রোডাকশন হাউস ফুটপ্রিন্ট ফিল্ম।
তাওকীর বলেন, ‘আমি ভারতের এশিয়ান স্কুল অব মিডিয়া স্ট্যাডিজ–এ পড়াশোনা করি। পড়াশোনা শেষে দেশে ফিরে, আমার কাজের জন্য কমফোর্ট জোনের কথা ভাবছিলাম। একসময় মনে হলো, সিনেমা বানানোর স্বপ্নটা আমার বেড়ে ওঠা চেনা অঙ্গন রাজশাহীতে হলে সমস্যা কোথায়? সিনেমা বানানোর যে স্বপ্ন আমি দেখেছি, সেটা তো রাজশাহী থেকেও অর্জন করা সম্ভব। তখন পরিকল্পনা করি আমার কমফোর্ট জোনে কাজ করতে হবে। চলি আসি রাজশাহী।’

‘সিনপাট’-এর দৃশ্য। ছবি : চরকির সৌজন্যে

রাজশাহী থেকে প্রথম নির্মাণ করেন স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা ‘কঙ্ক পুরাণ’। তারপর একের পর এক স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা বানিয়েছেন। এর মধ্যে একটু একটু করে রাজশাহীতেই গড়ে তুলেছেন টিম। এরাই তাঁর শক্তি। এসব অভিনয়শিল্পী ও কলাকুশলীকে দিয়ে ২০২০ সালের দিকে নির্মাণ করেন ‘শাটিকাপ’। রাজশাহীর আঞ্চলিক ভাষার ওয়েব সিরিজটি চরকিতে প্রচারের পর আলোচনায় আসে। আর পেছনে তাকাতে হয়নি। পরে রাজশাহীতেই বানিয়েছেন ওয়েব সিরিজ ‘সিনপাট’সহ একাধিক প্রকল্প। তাওকীর জানালেন, রাহী আবদুল্লাহসহ একাধিক তরুণ নির্মাতা এখন নিয়মিত রাজশাহীতে কাজ করছেন।

‘দেলুপি’র দৃশ্য। নির্মাতার সৌজন্যে

তাওকীর বলেন, ‘রাজশাহীতে এখন প্রচুর ইউটিউবার ও টিকটকার রয়েছেন। রংপুরে মোজাহিদ নামে একজন কাজ করেন। উত্তরবঙ্গে আরও অনেকে রয়েছেন। তাঁরা পেশাদার প্রোডাকশন হাউস দিয়ে কাজ করছেন। এরা কেউ কেউ স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা করছেন। ভবিষ্যতে সিনেমা বানানোর স্বপ্ন দেখছেন এসব তরুণ। রাজশাহীতে প্রডাকশন হাউসের সংখ্যা বেশি হলেও আলাদা করে রাজশাহীকে আমরা ইন্ডাস্ট্রি বলতে চাই না। তাহলে পুরো দেশটাই লিমিটেড হয়ে যাবে। কোরিয়ায়ও কিন্তু এভাবে স্থানীয় পর্যায়ে কাজ হয়, কিন্তু তারা মেইন ইন্ডাস্ট্রিকে অনুসরণ করে। ইন্ডাস্ট্রি ভাগ করার পক্ষে নই আমি।’

খুলনাতেও একাধিক পরিচালক
পরিচালক সুকর্ণ শাহেদের শুরুটা খুলনায়। তিনি খুলনা ফিল্ম সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরে ২০১৫ সালে সেখানেই বানিয়ে ফেলেন প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। চার বছর পরে সিনেমা বানানোর স্বপ্ন নিয়ে চলে আসেন ঢাকায়। কিছু কাজও করেন। এর মধ্যে ২০২৩ সালে সিদ্ধান্ত নেন খুলনায় ফিরবেন। খুলনায় এখন তাঁর সোল কিচেন প্রোডাকশন হাউসের অফিস রয়েছে। সেখান থেকে বানিয়েছেন ওয়েব সিরিজ ‘ফেউ’। এখন নিয়মিত কাজ করছেন। ইতিমধ্যে প্রযোজনাও শুরু করেছেন। সব কাজই হচ্ছে খুলনায়। এখন খুলনায় কাজ করতেই তাঁর আগ্রহ বেশি।

‘ফেউ’ –এ চঞ্চল চৌধুরী
ছবি : চরকির সৌজন্যে

খুলনাকে কেন বেছে নিয়েছেন এই পরিচালক? এমন প্রশ্নে সুকর্ণ শাহেদ বলেন, ‘খুলনায় বড় হয়েছি, নিজের মতো করে এক্সপ্লোর করতে পারি। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি খুলনাতেই সিনেমা বানানোর ভালো পরিবেশ রয়েছে। যেটা হয়তো ঢাকায় আমি পাই না। একটা সিনেমা লেখার জন্য মানসিক শান্তি দরকার হয়। সেটা আমি খুলনাতেই পাই। আমাদের পুরো কাজই বলা যায় খুলনায়। সিনেমার পাশাপাশি বিজ্ঞাপনের কাজও সেখানে করছি। এগুলো নিয়ে ক্লায়েন্টও খুশি।’ তাদের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের সিনেমাটি পরিচালনা করেছেন রবিউল আলম।

খুলনার আরও বেশ কয়েকজন পরিচালক ও প্রযোজকের সঙ্গে কথা হলো। তাঁরা মনে করেন, এখন ঢাকার সঙ্গে খুলনার দূরত্ব মাত্র তিন–চার ঘণ্টা। যোগাযোগ আর বাধা নয়। এ ছাড়া খুলনার নিজস্ব গল্প ও চরিত্রগুলো নিয়েই তারা কাজ করতে আগ্রহী। ২০২৩ সালে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সিনেমা বানিয়েছেন সৈয়দা নিগার বানু। ‘নোনাপানি’ নামের সেই সিনেমার শুটিংয়ের জন্য বেছে নেন তাঁর কাছ থেকে দেখা লোকেশন ও চরিত্র। খুলনার প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে যুদ্ধ করছে সেই গল্প। সিনেমার শুটিংও হয় খুলনা অঞ্চলে। তিনি আগে ঢাকায় থাকলেও এখন স্থায়ীভাবেই খুলনায় থাকেন। গত বুধবার কথা বলার সময় ফিল্ম ও মিউজিকের ওপর ক্লাস নিচ্ছিলেন। তাঁর কথায়, শূন্য থেকে তরুণদের গড়ে তুলতে চান। তরুণদের যেন শিখতে ঢাকামুখী হতে না হয়, সেই বাধাগুলো ভাঙার চেষ্টা করছেন।
তিনি বলেন, ‘খুলনা জনপদের গল্প, মানুষের জীবন আমাকে টানে। আমার চেনা গল্পটাই আমি বলতে চাই। এ জন্য পাকাপোক্তভাবে লোকবল তৈরি করছি। আগামীর তরুণদের সুযোগ করে দিতে চাই। কাউকে যেন আর ঢাকার দিকে তাকিয়ে থাকতে না হয়। কেউ কেউ হয়তো ঢাকায় চলে যাচ্ছেন, এতে আমরা ভাবছি না। আবার কাউকে তৈরি করছি। কারণ, আমরা মনে করি, সেই পরিবেশ ও সম্ভাবনা খুলনায় রয়েছে। এখানে একসময় অনেকেই নিয়মিত কাজের সুযোগ পাবেন। সেভাবেই সবার সঙ্গে চেষ্টা করছি।’

সাউথ বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি
বাগেরহাট অঞ্চলে সাউথ বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলতে কাজ করছেন একদল নির্মাতা। তাঁদের প্রেরণা ভারতের দক্ষিণি সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির মতো স্থানীয় গল্প। ‘সাহস’ সিনেমা দিয়ে এই যাত্রা ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। ‘দুঃসাহস’ নামে আরও একটি সিনেমার শুটিংও শেষ হয়েছে। এ সিনেমার পরিচালক কৌতূহল জানান, তাঁরা ইতিমধ্যে লোকবল তৈরিতে মনোযোগ দিয়েছেন। শিল্পী–কলাকুশলী তৈরি করছেন। কেউ চাইলে শতাধিক শিল্পী ও কলাকুশলী তাঁরা সরবরাহ করতে পারবেন। এর আগে কমলা রকেট বানিয়ে প্রশংসিত হন নূর ইমরান মিঠু। তিনিও একটি সিনেমার শুটিং এখানে শেষ করেছেন।

‘দুঃসাহস’–এর পোস্টার থেকে। মোস্তাফিজুর নূর ইমরানের ফেসবুক থেকে

সিনেমাটির এখন ডাবিং চলছে। এখানে এখন নিয়মিত নাটকের শুটিং হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন পরিচালক বলেন, ‘এ অঞ্চলের পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির গল্প বলতে ৮ বছর ধরে গবেষণা করছি। শুটিংসহ সবকিছু হবে বাগেরহাটসহ আশপাশের অঞ্চলে। ঢাকামুখী নয়, দর্শকদের নতুন গল্প, চরিত্র, ভিজুয়াল উপহার দিতে চাই। বাজেট আমাদের কাছে বাধা হবে না। আমরা কম বাজেটে সিনেমার শুটিং করতে পারব। সেভাবেই সবকিছু এগিয়ে চলছে। ভবিষ্যতে প্রতিবছর এখান থেকে সিনেমা মুক্তি পাবে। আমাদের ১০ থেকে ১৫ জনের মতো নির্মাতা রয়েছে।’

আরও পড়ুন

টঙ্গী থেকে নন্দীবাড়ি
সিনেমা নির্মাণের জন্য শুরু থেকেই ঢাকায় আসতে চাননি যুবরাজ শামীম। তাঁর টঙ্গীতে বানানো সিনেমা ‘আদিম’ মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে অংশ নিয়ে পুরস্কার পায়। বর্তমানে তিনি গাজীপুর জেলার নন্দীপুর গ্রামে গড়ে তুলেছেন প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। সেখান থেকে নির্মাণ করেছেন ‘অতল, ‘গন্ধম, ‘এক ঋতুর অনন্তকাল’ ইত্যাদি সিনেমা। নিজের মতো করে সিনেমার শুটিং করে পোস্টপ্রোডাকশনের কাজ করছেন। সেগুলো ভেনিস, রটারডামসহ বড় বড় উৎসব পাঠাচ্ছেন।

আদিম ছবির দৃশ্যে বাদশা ও সোহাগী। নির্মাতার সৌজন্যে

নিজেকে তিনি চলচ্চিত্র নির্মাতা মনে করেন না। মনে করেন একজন চলচ্চিত্রশিল্পী। ‘একজন কবি কী করেন? তিনি ইচ্ছা হলেই একটা কবিতা লিখে ফেলতে পারেন। আমি সেভাবে এখন জীবনকে যাপন করছি। এই গ্রাম নদী কোলাহল থেকে দূরে ভিন্ন একটা পরিবেশের মধ্যে আমি থাকি। এটাই আমার আর্ট লাইফ। আমার মনে হলো এখন শুটিং করা দরকার। সঙ্গে সঙ্গে শুটিং করি। ক্যামেরা সঙ্গেই থাকে। এই শুটিংয়ে আমার পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। আমি নিজের মতো করে এখানে সিনেমার মাধ্যমে নিশ্বাস নিতে পারছি। যে কারণে আমাকে এই পরিবেশ টানে। তা ছাড়া এখনকার জীবনে তেমন কোনো জটিলতা নেই। জীবনযাপনের ব্যয়ও অতটা নয়। এটাই আমাকে নিজের মতো করে সৃজনশীল কাজ করতে উৎসাহিত করে।’

আরও পড়ুন

তাঁর কাজ মানেই বরিশাল
বরিশাল থেকে ঢাকায় আসতে চান না সুব্রত সঞ্জীব। ঢাকা থেকে তারকাদের নিয়ে যান বরিশাল। এই নির্মাতা ও চিত্রনাট্যকারের স্বপ্ন, বরিশালে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলা। সেভাবেই তিনি কাজ করছেন। তাঁর শুটিংয়ের জন্য গড়ে তুলেছেন প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। এমনকি একাধিক স্থানীয় অভিনয়শিল্পীও রয়েছেন। এর আগে একটি নাটকের জন্য পাঁচ শতাধিক পার্শ্বচরিত্রের প্রয়োজন হলে সেটাও ম্যানেজ করে ফেলেন।

সবাই যেখানে ঢাকামুখী, সেখানে বরিশালে বসেই কাজ করছেন নির্মাতা সুব্রত সঞ্জীব
ছবি: নির্মাতার সৌজন্যে

সুব্রত সঞ্জীব বলেন, ‘নাটক নির্মাণ করলেও আমার স্বপ্ন সিনেমা। সেই সিনেমার কাজও আমি বরিশালে করতে চাই। সেই প্রস্তুতি নিয়েই এগোচ্ছি।’ এই পরিচালক মনে করেন, ঢাকা শহরে সৃষ্টিশীল কাজ করা কঠিন। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে ২০ মিনিটের পথ লাগে দুই–তিন ঘণ্টা। এমন ব্যস্ত নগরীতে শিল্পচর্চা তাঁর জন্য কঠিন। ঢাকায় থাকাটাও ব্যয়বহুল। তিনি বলেন, ‘ইন্ডাস্ট্রি ঢাকা থেকে ছড়িয়ে যাওয়া উচিত। গড়ে ওঠা উচিত বিভাগীয় শহরগুলো। পাশাপাশি পার্বত্য অঞ্চল, সিলেটের মতো শহরে শিল্পচর্চার জায়গা হতে পারে। যেখানে মানুষের নিশ্বাস নেওয়ার, ভাবার সুযোগ রয়েছে।’