ল্যাম্পপোস্টের নিচে ডাস্টবিন, রাজ্জাক আজীবন বহন করেছিলেন সেই স্মৃতি

নায়ক রাজ্জাক তাঁর ফেলে আসার জীবনের কথা অবলীলায় বলতেন, গর্ববোধ করতেনকোলাজ
১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি। কলকাতার ৮ নম্বর নাকতলা রোডের বাড়িতে জন্ম নিলেন একটি শিশু। তিনি চিত্রনায়ক রাজ্জাক। ১৯৬৪ সালের ২৬ এপ্রিল ঢাকায় এসেছিলেন রাজ্জাক। এসেছিলেন শরণার্থী হিসেবে। সময়ের পরিক্রমায় তিনি বাংলা চলচ্চিত্রে ‘নায়করাজ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। আজ ২১ আগস্ট নায়করাজ রাজ্জাকের মৃত্যুদিন। এই দিনে স্মরণ করি রাজ্জাকের জীবনের সত্যিকার গল্প।

উত্তরার রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশনের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় মূল ভবনের বিশাল সাইনবোর্ডের লোগো কখনো খেয়াল করেছেন? ল্যাম্পপোস্টের নিচে একজন মানুষ বসে আছে, পাশেই একটা ডাস্টবিন—লোগোটা এমন। নায়করাজ রাজ্জাকের সব প্রতিষ্ঠানের লোগো। একজন চিত্রনায়কের ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানের লোগো এমন কেন? অনেকের মনে এমন ভাবনা তৈরি হয়ে নিশ্চয়। নায়করাজের কাছে এর ব্যাখ্যা জানা যায়নি। এখন তো তিনি সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ঊর্ধ্বে।
আজ বৃহস্পতিবার রাজ্জাকের চলে যাওয়ার আট বছর পূর্ণ হচ্ছে। বছর কয়েক আগে রাজ্জাকের প্রয়াণদিবস সামনে রেখে কিছু জানা–লেখার আশায় গিয়েছিলাম উত্তরার রাজলক্ষ্মী কমপ্লেক্সে। সেদিন রাজ্জাকের সুযোগ্য দুই সন্তান বাপ্পারাজ ও সম্রাটের সঙ্গে বেশ খানিকটা সময় কেটেছিল। সুযোগ পেয়ে বাপ্পারাজের কাছে জানতে চেয়েছিলাম তাঁদের পারিবারিক প্রতিষ্ঠানগুলোর লোগোটি এমন হওয়ার কারণ। প্রথম আলোর কাছে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বাপ্পারাজ সেদিন জানালেন, ‘এটা প্রতীকী।’

কথায় কথায় বাপ্পারাজই জানিয়েছেন তাঁদের প্রতিষ্ঠানের বিশেষ লোগোটির কথা। বাবার মতো অমায়িক তাঁর দুই ছেলে। জীবদ্দশায় নায়ক রাজ্জাক তাঁর ফেলে আসার জীবনের কথা অবলীলায় বলতেন, গর্ববোধ করতেন। ছেলে জানালেন বাবার সেই গৌরবগাথা। একটি পুরোনো প্যাড আনালেন অফিসের এক কর্মীকে দিয়ে। যেখানে লেখা, রাজলক্ষ্মী টেলিফিল্মস, ৭৪ কাকরাইল। মিলল আরেকটি পুরোনো প্যাড। রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশন, ৬৪ বিজয়নগর...। দুটি প্যাডের প্রতিষ্ঠানের নামের পাশেই সেই লোগোটা, ল্যাম্পপোস্টের নিচে একজন মানুষ বসে আছে, পাশেই একটা ডাস্টবিন।
প্রথম আলোর কাছে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বাপ্পারাজ বলেছিলেন, ‘১৯৬৪ সালে বাবা শূন্য থেকে জীবন শুরু করেছিলেন। তখন আমার বয়স আট মাস মাত্র। আমার নিজের মনে নেই প্রথম দিকের কথা। বাবার কাছে শুনেছি। ১৯৬৪ সালের আগে বাবা কখনো ঢাকায় আসেননি। কারও বাসায় উঠবেন—এমন পরিচিতজনও ছিল না। কপর্দকহীন হয়ে ঢাকা এসে আমাদের নিয়ে স্টেডিয়াম এলাকার একটি ল্যাম্পপোস্টের নিচে বসে ছিলেন। সেখান থেকে শুরু। এই ল্যাম্পপোস্টের নিচ থেকেই ঢাকায়, বাংলাদেশে বাবার নতুন জীবন শুরু। আমাদের নতুন শুরু। এ বিষয়টিকে প্রতীকী অর্থে বোঝানো হয়েছে লোগোটিতে।’ বাপ্পারাজ বলেন, ‘আব্বা যখন প্রথম রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশনের যাত্রা করেন, তখন এই লোগোটা করা হয়। বাবার পরিকল্পনামতো এটার নকশা করেছিলেন সুভাষ দত্ত। আমাদের সব কটি প্রতিষ্ঠানে, সাইনবোর্ডে, প্যাডে এই লোগো ব্যবহার করা হয়েছে।’

১৯৬৪ সালের ২৬ এপ্রিল ঢাকায় এসেছিলেন রাজ্জাক। এসেছিলেন শরণার্থী হিসেবে। সময়ের পরিক্রমায় তিনি বাংলা চলচ্চিত্রে ‘নায়করাজ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। একজীবনে রাজ্জাক সিনেমা ছাড়া অন্য কিছুই স্থায়ীভাবে করেননি।
১৯৬৪ থেকে আমৃত্যু এ দেশের চলচ্চিত্রশিল্পকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছেন রাজ্জাক
কোলাজ

জীবনটাই ছিল সিনেমার গল্পের মতো
লোগোর সূত্রেই সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাকের মতোই মনে পড়তে লাগল রাজ্জাকের অতীতের কথাগুলো। তাঁর বলা গল্পগুলো। তিনি বলতেন, ‘আমার জীবনটাই একটা সিনেমা...।’

কপর্দকহীন হয়ে ঢাকা এসে আমাদের নিয়ে স্টেডিয়াম এলাকার একটি ল্যাম্পপোস্টের নিচে বসে ছিলেন। সেখান থেকে শুরু। এই ল্যাম্পপোস্টের নিচ থেকেই ঢাকায়, বাংলাদেশে বাবার নতুন জীবন শুরু।

নানা সময়ের সাক্ষাৎকারে রাজ্জাক জানিয়েছিলেন, একটা সময় ফার্মগেট এলাকায় থিতু হয়েছিলেন দুই বাচ্চা আর স্ত্রী লক্ষ্মীকে নিয়ে। তখন জীবিকা নির্বাহের জন্য টিভি নাটকে অভিনয় করতেন। নাটকে অভিনয় করে সপ্তাহে পেতেন ৬০ থেকে ৬৫ টাকা। মাসের খরচ ৬০০ টাকা। রাজ্জাক বলেছিলেন, ‘অল্প আয়ে সংসারের খরচ চলে না। বাচ্চাদের দুধ জোগাড় করতেই সব টাকা ব্যয় হয়ে যেত। ওই সময় স্বামী-স্ত্রী দুজন মাঝেমধ্যে উপোসও করতাম। পয়সার অভাবে ফার্মগেট থেকে ডিআইটি টিভি কেন্দ্রে হেঁটে যাতায়াত করতাম।’
একবার রাজ্জাকের মুখে তাঁর জীবনের গল্পটা শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল। ২০১৬ সালে। এফডিসিতে এসেছিলেন রাজ্জাক। সেদিন ছিল তাঁর জন্মদিন উদ্‌যাপনের আয়োজন। অনেক কথা বলেছিলেন সেদিন। এই প্রতিবেদক সেখানে উপস্থিত ছিলেন। অকপটে জানিয়েছিলেন নিজের এক জীবনের কথা। সেদিন রাজ্জাক ঠিক এ কথাই বলেছিলেন, ‘সকলের ভালোবাসা পেয়ে আজ আমি পরিপূর্ণ। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে অনেক সময় অর্ধাহারে দিন কেটেছে আমার। সপ্তাহে ৬৫ টাকা পেতাম টেলিভিশনে একটি অনুষ্ঠান করে, সেই ৬৫ টাকা দিয়ে আমার সংসার চলেছে। একটা সময় পর আমি “বেহুলা”র নায়ক হলাম। ৫০০ টাকা সাইনিং মানি নিয়ে খুশিতে বাড়ি এলাম। তারপরের কাহিনিটা অনেকেই জানেন।’ সেদিন কথা বলার এক ফাঁকে বারবার কেঁদেছিলেন তিনি। অশ্রুসিক্ত রাজ্জাক বলেছিলেন, ‘আজকে আমি এই যে নায়করাজ, এটা আমার একার পক্ষে সম্ভব হয়নি।...আমার যাঁরা শ্রদ্ধেয় পরিচালক ছিলেন, তাঁরা আমাকে এবং তিনজন নায়িকা নিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। সেই যুদ্ধে আমি একজন সৈনিক হিসেবে কাজ করেছি তাঁদের সঙ্গে। শুধু রোববার দিন বাড়ি যেতাম আমি, অন্য দিনগুলোয় মেকআপ রুমের ফ্লোরে শুয়ে থাকতাম।’ তাঁর সঙ্গে সেদিন মিলনায়তনের উপস্থিত অনেকেই কেঁদেছিলেন।

এক্সট্রা থেকে নায়ক
সেই নায়ক রাজ্জাকের অভিনয়জীবনের শুরুটা হয়েছিল একেবারেই ছোট চরিত্রের অভিনয়ের মাধ্যমে। সিনেমা দুনিয়া যাকে বলে ‘এক্সট্রা’। কলেজে পড়ার সময় চলচ্চিত্রে প্রথম অভিনয়ের সুযোগ পান। অজিত ব্যানার্জির ১৯৫৮ সালের ছবি ‘রতন লাল বাঙালি’। ওই ছবির মূল চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন আশিস কুমার ও নায়িকা সন্ধ্যা রায়। ছোট্ট একটি চরিত্র ছিল রাজ্জাকের—পকেটমার।

‘নীল আকাশের নিচে’ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে রাজ্জাক আবির্ভূত হলেন রোমান্টিক নায়ক হিসেবে
ভিডিও থেকে

রাজ্জাকের দ্বিতীয় ছবি ‘পঙ্ক তিলক’। পরিচালনা করেছেন মঙ্গল চক্রবর্তী। ওই ছবিতে ছাত্রের ভূমিকায় অভিনয় করেন। একজন ছাত্র হিসেবে ক্লাসে আসা-যাওয়া, দু-একটা সংলাপ—এই ছিল রাজ্জাকের উপস্থিতি। তৃতীয় ছবি ‘শিলালিপি’। এখানেও তাঁর চরিত্রটি ছিল সে অর্থে নগণ্য। একটি গানের দৃশ্যে অতিরিক্ত শিল্পী হিসেব অংশগ্রহণ করেছিলেন। অবশ্য এবার সম্মানী পেয়েছেন। ২০ টাকা। আগের দুটি ছবিতে ‘এক্সট্রা’র ভূমিকায় অভিনয় করে আদৌ কোনো পারিশ্রমিক বা সম্মানী পেয়েছিলেন কি না, জানা যায় না। তৃতীয় ছবি ‘শিলালিপি’র ২০ টাকার সম্মানী রাজ্জাকের আস্থা আর উৎসাহ আরও বাড়িয়ে দেয়। অবশ্য তিনি বুঝেছিলেন, টালিগঞ্জে (পশ্চিম বাংলার চলচ্চিত্রশিল্পের মূল কেন্দ্র) সুবিধা করতে পারবেন না। ‘এক্সট্রা’ হয়েই থাকতে হবে। নিলেন নতুন চ্যালেঞ্জ। চলে গেলেন মুম্বাই (তখনকার বোম্বে)।

একদিন পর্দার সামনে থাকার একটা সুযোগ এল। সেটা ১৯৬৫ সালে, ‘আখেরি স্টেশন’ ছবিতে সহকারী স্টেশনমাস্টারের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। ঢাকার ছবিতে ওটিই রাজ্জাকের প্রথম অভিনয়।

১৯৫৯ সালের কথা। কলকাতার ছেলে রাজ্জাক মুম্বাই এসেছেন অভিনয় শিখতে। নায়ক হতে চান। সেখানে গিয়ে ভর্তি হন অভিনয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘ফিল্মালয়’-এ। তখন ওখানে ক্লাস নিতেন দিলীপ কুমার, শশধর মুখার্জিরা। ওখানে এক বছরের কোর্স। কিন্তু রাজ্জাক বরাবরই অস্থির ছিলেন। তাত্ত্বিক, পদ্ধতিগত শিক্ষা রাজ্জাকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটায়। বোম্বের চিত্রজগতে ঢোকার সুযোগ খুঁজতে থাকেন, কিন্তু বিষয়টি কঠিন নয়, অসম্ভবই ছিল। কলকাতায় ফিরে আসেন রাজ্জাক।

স্ত্রী খায়রুন্নেসা লক্ষ্মীর স্মৃতিতে রাজ্জাকের চলচ্চিত্র যাত্রা 
আমরা কলকাতা থেকে এ দেশে আসি সম্ভবত ’৬৪ সালে। বাপ্পা তখন আট মাসের। ঢাকায় এসে উঠেছিলাম কমলাপুর ঠাকুরপাড়ায়। শুরুতে এ জন্য অনেক সমস্যা হয়েছিল। অবশ্য আস্তে আস্তে সব ঠিকও হয়ে যায়। তারপর কমলাপুর থেকে আমরা চলে আসি নয়াটোলায়। তখন সে সিনেমায় সবে অভিনয় শুরু করেছে, তা–ও ছোট চরিত্রে। আমিও মনে-প্রাণে চাইতাম, ও যেন চলচ্চিত্রে প্রতিষ্ঠা পায়। তারপর কত সময় গেল। ও আস্তে আস্তে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আর আমি বাচ্চা ও ঘরসংসার সামলাতে লাগলাম। অনেকেই তখন আমাকে এসে ওর সম্পর্কে নানা গালগল্প করত, আপনার হিরোকে (ও যখন থেকে ছবির হিরো হলো, তখন থেকে এখন পর্যন্ত আমি ওকে ‘হিরো’ বলেই ডাকি) আজ অমুকের সঙ্গে ওমুক জায়গায় দেখেছি। আর আপনি ঘর সামলাচ্ছেন। এসব কি দেখেন না? আমি ওদের এসব মুখরোচক কথা কখনোই কানে নিতাম না। কারণ, আমার হিরো ছবিতে বিভিন্ন নায়িকার সঙ্গে কাজ করে, সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের নিয়ে গুঞ্জন হতেই পারে। যখন ফার্মগেটে হলিক্রসের সামনে আমরা থাকতাম। তখন অনেক মেয়ে বাড়িতে আসত ওর সঙ্গে দেখা করতে, অটোগ্রাফ নিতে। দেখতাম, ভক্তরা ওর কাপড় ছুঁয়ে দেখছে, জুতা ছুঁয়ে দেখছে। তাকে জড়িয়ে ধরছে। দেখতাম, কিন্তু কিছুই বলতাম না। আমি কখনোই তার কোনো কিছুতেই বাধা দিতাম না; বরং তাকে সাহস দিতাম। তারপর স্বাধীনতার আগে নিজেরা গুলশানের এই জায়গা কিনলাম। নিজেদের বাড়িতে (লক্ষ্মীকুঞ্জ) উঠলাম।

ইতিমধ্যে বিয়ে করে কিছুটা থিতু হন। কিন্তু এর মধ্যে উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে শুরু হয় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা। পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, আসাম, ত্রিপুরা থেকে দলে দলে মুসলিমরা পাড়ি দেয় তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে। রাজ্জাকও স্ত্রী লক্ষ্মী ও শিশুপুত্র বাপ্পাকে নিয়ে ওই দাঙ্গার সময় ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৬৪ সালের ২৬ এপ্রিল রাজ্জাক ঢাকা পৌঁছান। নায়ক হওয়ার বাসনা নিয়ে ঘুরে বেড়ান ছবিপাড়ায়।

রাজ্জাক শুধু নায়ক হিসেবেই নয়, পরিচালক হিসেবেও বেশ সফল। ‘আয়না কাহিনী’সহ কয়েকটি ছবিটি নির্মাণ করেন তিনি।
আরও পড়ুন

একদিন পর্দার সামনে থাকার একটা সুযোগ এল। সেটা ১৯৬৫ সালে, ‘আখেরি স্টেশন’ ছবিতে সহকারী স্টেশনমাস্টারের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। ঢাকার ছবিতে ওটিই রাজ্জাকের প্রথম অভিনয়। এরপর আরও বেশ কয়েকটি ছবিতে ছোটখাটো চরিত্রে অভিনয় করেন। যেমন ‘কার বউ’ ছবিতে অটোরিকশাচালক (বেবিট্যাক্সি ড্রাইভার), ‘১৩ নম্বর ফেকু ওস্তাগার লেন’-এ পাড়ার ছেলে মিন্টু, ‘ডাকবাবু’তে আদালতের কর্মচারী, ‘কাগজের নৌকা’য় বাইজিবাড়ির মাতাল। একসময় পরিচয় হয় জহির রায়হানের সঙ্গে। তিনি রাজ্জাককে ‘বেহুলা’ ছবিতে নেন। ওই ছবি সাইনিং মানি হিসেবে ৫০০ টাকা নগদ পেয়েছিলেন। সেই টাকার কিছু অংশ সংসারের কাজে খরচ হয়। বাকি টাকা বন্ধুবান্ধবকে মিষ্টি খাইয়ে শেষ করেন রাজ্জাক।

ছবিটি তখন দারুণ ব্যবসাসফল হয়েছিল। সেই সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের দর্শক সানন্দে গ্রহণ করে নেয় রাজ্জাককে। ‘বেহুলা’ ছবিটি করার পর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি রাজ্জাক।

ঢাকায় রাজ্জাকের শুরু
নির্মাতা কামাল আহমেদের ‘উজালা’ নামের সিনেমার চতুর্থ সহকারী পরিচালক হিসেবেও কাজ করেছেন রাজ্জাক। ঢাকার ইন্ডাস্ট্রিতে এটি তাঁর প্রথম কাজ। এরপর ‘পরওয়ানা’ সিনেমায়ও সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু পরিবারের অভাব-অনটন কাটছে না। অভিনয়ের সুযোগ পাওয়ার আশায় তিনি ঘুরছেন। এর মধ্যে ‘ঘরোয়া’ নামের একটি টিভি ধারাবাহিকে অভিনয় শুরু করলেন।

এক্সট্রার ভূমিকায়, আউট অব ফোকাসে অখ্যাত-অগুরুত্বপূর্ণ চরিত্র করেও একসময় হিরো হয়ে ওঠা যায়! রাজ্জাক প্রমাণ করে দিয়েছিলেন। একে একে ‘অবুঝ মন, নীল আকাশের নিচে, স্বরলিপি, ময়নামতি, জীবন থেকে নেয়া, স্মৃতিটুকু থাক, রংবাজ, অশ্রু দিয়ে লেখা, আলোর মিছিল, ওরা ১১ জন, অশিক্ষিত, সমাধি, অনন্ত প্রেম, মাটির ঘর, ছুটির ঘণ্টা, লাইলি মজনু—এমন অসংখ্য সফল সিনেমার নায়ক তিনি।সেই মানুষটি প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া তেমন করেননি। ব্যবসা, চাকরি—কোথাও থিতু হননি। এর একটাই কারণ—নায়ক হতে চেয়েছিলেন রাজ্জাক।

‘বেহুলা’ ছবিটি করার পর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি রাজ্জাক। এক্সট্রার ভূমিকায়, আউট অব ফোকাসে অখ্যাত-অগুরুত্বপূর্ণ চরিত্র করেও একসময় হিরো হয়ে ওঠা যায়! রাজ্জাক প্রমাণ করে দিয়েছিলেন।
নায়ক রাজ্জাক পরিচালিত ও অভিনীত জনপ্রিয় সিনেমার একটি ‘সন্তান যখন শত্রু’। সেই সিনেমায় শুটিংয়ের দৃশ্যের একটি মুহূর্তে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, নায়ক রাজ্জাক একটি দৃশ্য বুঝিয়ে দিচ্ছেন ছেলে বাপ্পারাজকে। পাশে দৃশ্য বোঝে নিচ্ছেন পূর্ণিমা, কাজল ও ফেরদৌস
ফাইল ছবি
আরও পড়ুন

ঢাকায় এসে সেই ল্যাম্পপোস্টের পাশে আশ্রয় নেওয়া রাজ্জাক একসময় উত্তরায় বাণিজ্যিক ভবন, গুলশানে বাড়ি করেছেন। এ অর্জন মোটেও আলাউদ্দিনের চেরাগে ঘষে হয়নি। নিজের মেধা, প্রতিভার সবটুকু ঢেলে দিয়ে পরিশ্রম করে তিলে তিলে তৈরি করেছেন। বছরের পর বছর লেগে ছিলেন। একজন এক্সট্রা থেকে হয়েছেন নায়ক, ঢাকাই চলচ্চিত্রশিল্পের রাজা। হয়েছিলেন নায়করাজ।

রাজ্জাকের নায়িকারা
অনেক নায়িকার সঙ্গেই জুটি বেঁধেছেন রাজ্জাক। বেহুলা (১৯৬৬) ছবিতে সুচন্দার সঙ্গে প্রথম জুটি। সুচন্দার সঙ্গে পরে আনোয়ারা (১৯৬৭), জুলেখা (১৯৬৭), দুই ভাই (১৯৬৮), সংসার (১৯৬৮), সখিনা (১৯৬৮), কুঁচবরণ কন্যা (১৯৬৮), মনের মত বউ (১৯৬৯), জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০) প্রভৃতি ছবিতে অভিনয় করেন। ঢাকার চলচ্চিত্রে সবচেয়ে সুপারহিট জুটি মনে হয় রাজ্জাক-কবরী। কবরীর সঙ্গে প্রথম ছবি নিশি হলো ভোর (১৯৬৮)। বাঁশরী (১৯৬৮) ছবিতে রোমান্টিক ইমেজে দেখা দেন এই জুটি। কাজী জহিরের ময়নামতি (১৯৬৮) ছবিতে তুঙ্গে ওঠে রাজ্জাক-কবরী জুটির জনপ্রিয়তা। বলা হয়, ময়নামতি রাজ্জাক-কবরীর প্রেম-বিরহের সার্থক ছবি। এই জুটির অন্যান্য ছবির মধ্যে রয়েছে নীল আকাশের নীচে (১৯৬৮), কখগঘঙ (১৯৭০), দর্পচূর্ণ (১৯৭০, দীপ নেভে নাই (১৯৭০), স্মৃতিটুকু থাক (১৯৭০), রংবাজ (১৯৭৩), বেঈমান (১৯৭৪), উপহার (১৯৭৫), গুন্ডা (১৯৭৫) প্রভৃতি। শাবানা, ববিতা, শবনম, রোজিনা, সুচরিতা, অঞ্জনা, কাজরী প্রমুখের সঙ্গেও অনেক ছবিতে অভিনয় করেছেন রাজ্জাক। শাবানার সঙ্গে তাঁর মধুমিলন (১৯৭০), অবুঝ মন (১৯৭২), অতিথি (১৯৭৩), চাষীর মেয়ে (১৯৭৫), অমর প্রেম (১৯৭৭), অলংকার (১৯৭৮), মাটির ঘর (১৯৭৯), ছুটির ঘণ্টা (১৯৮০), পুত্রবধূ, রজনীগন্ধা প্রভৃতি ছবি স্মরণীয় হয়ে আছে। সংসার (১৯৬৮) ছবিতে ‘সুবর্ণা’ নামে রাজ্জাকের মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করেন ববিতা। পরে পীচ ঢালা পথ (১৯৭০) ছবিতে রাজ্জাকের নায়িকা হন ববিতা। এই জুটির হিট ছবি বাঁদী থেকে বেগম (১৯৭৫), আকাংখা (১৯৭৬), অনন্ত প্রেম (১৯৭৭), অগ্নিপরীক্ষা (১৯৭৮), আনারকলি (১৯৮০), লাইলী মজনু (১৯৮৩) প্রভৃতি। অঞ্জনার সঙ্গে অশিক্ষিত ও দোয়েলের সঙ্গে চন্দ্রনাথ ছবিতে রাজ্জাকের অভিনয় স্মরণীয় হয়ে আছে। সূত্র: অনুপম হায়াতের কলাম

শুধু অভিনয়ের জন্য জীবনে যত ঝড়ঝাপটা আসুক, নিজের স্বপ্নটাকে হারিয়ে যেতে দেননি। আজ তাঁর চলে যাওয়ার দিনে এফডিসিতে দেওয়া এক বক্তৃতার কথাগুলো মনে পড়ছে। সেদিন কথা বলার এক ফাঁকে কেঁদেছিলেন রাজ্জাক। তাঁর সঙ্গে মিলনায়তনের উপস্থিত অনেকেই কেঁদেছিলেন। বছর ঘুরতে রাজ্জাকও চলে গেলেন চিরতরে। আজও তাঁকে স্মরণ করে কাঁদেন ছেড়ে যাওয়া সঙ্গী ও অনুরাগীরা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্মরণ করেন নানাভাবে। আমরাও তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করছি।(এ প্রতিবেদনের কিছু অংশ প্রথম আলোতে প্রকাশিত একই প্রতিবেদকের লেখা থেকে সংকলিত)