শুভর ‘নীলচক্র’, শেষ কয়েক মিনিটেই কি গন্ডগোল

‘নীলচক্র’ সিনেমার গানের দৃশ্যে মন্দিরা ও শুভ। নির্মাতার সৌজন্যে

দুই বছরে অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ে ১৬ তরুণীর ব্যক্তিগত ভিডিও। এ ঘটনায় পাঁচজন আত্মহত্যা করে। পুরো ঘটনাই একটি সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্রের; উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ভিডিওগুলো। এর পেছনে কি বড় একটি চক্র রয়েছে? কী চায় তারা? এমন প্রশ্ন নিয়ে এগিয়ে গেছে মিঠু খানের ‘নীলচক্র’। সাইবার অপরাধ হালের বহুল চর্চিত বিষয়, ব্যক্তিগত ভিডিও ফাঁস, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানাভাবে প্রতারিত হওয়ার গল্প আজকাল পত্রিকা খুললেই দেখা যায়। এমন আলোচিত বিষয় নিয়ে সিনেমা, ‘নীলচক্র’ তাই হতে পারত রোমাঞ্চকর এক থ্রিলার। কিন্তু দুর্বল চিত্রনাট্য আর নির্মাণে সিনেমাটি কি সেটা পারল?

একনজরে
সিনেমা: ‘নীলচক্র’
ধরন: থ্রিলার
গল্প: নাজিম উদ দৌলা
চিত্রনাট্য: নাজিম উদ দৌলা ও মিঠু খান
পরিচালনা: মিঠু খান
অভিনয়: আরিফিন শুভ, মন্দিরা চক্রবর্তী, ফজলুর রহমান বাবু, শিরিন আলম, খালেদা আক্তার কল্পনা, শাহেদ আলী
দৈর্ঘ্য: ১ ঘণ্টা ৫৩ মিনিট

থ্রিলার হলেও সিনেমার শুরুটা পুরোপুরি পারিবারিক আবহে। শুরুর আধঘণ্টায় ফ্যামিলি ড্রামা হিসেবে ভালোই লাগছিল। গল্প বহিষ্কৃত গোয়েন্দা কর্মকর্তা ফয়সালকে (আরিফিন শুভ) নিয়ে। স্ত্রী নেই, একমাত্র মেয়ে জুঁই আর খালাকে নিয়ে সংসার। বহিষ্কারাদেশের পর বাড়িতে ভালোই সময় কাটছিল। কিন্তু ভিডিও ফাঁসের জেরে তরুণীর আত্মহত্যার মতো হাই প্রোফাইল কেস আসায় ফয়সালের ডাক পড়ে। কিন্তু তদন্তে নেমে একটু এগিয়েও আবার পিছিয়ে যেতে হয়; যখনই একটু আলোর দিশা আসে তখনই নতুন কোনো মরদেহ ফয়সালকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়।

সিনেমায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নেতিবাচক প্রভাবও দেখানো হয়েছে। টুটাং অ্যাপে লাইক পাওয়া আর নেট দুনিয়ায় প্রভাবশালী ইনফ্লুয়েন্সার হওয়ার নেশা যে কতটা মরিয়া হতে পারে, সেটাও দেখানো হয়েছে সিনেমায়। মোটাদাগে গল্প শুনতে খারাপ না, কিন্তু পর্দায় এর রূপান্তর ঘটেছে কমই।

‘নীলচক্র’ সিনেমায় অভিনয় করেছেন মন্দিরা ও আরিফিন শুভ। ফেসবুক থেকে

‘নীলচক্র’ আরও ভালোভাবে তৈরির অবকাশ ছিল। হলে আসার আগে টিজারে পূর্বাভাস দেখে সিনেমাটিকে মনে হয়েছিল অ্যাকশন-থ্রিলার। কিন্তু সিনেমার ৪০ মিনিট পরে একটা গড়পড়তা মানের চেজ দৃশ্য ছাড়া আর সেভাবে কোনো অ্যাকশনই নেই! বরং প্রথমার্ধের পারিবারিক ড্রামা বেশ জমাটি ছিল, বাবা-মেয়ের খুনসুটি দেখতে মন্দ লাগছিল না। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে এসে রহস্যের জাল ভেদ করতে গিয়ে মাঝেমধ্যেই খেই হারিয়েছে সিনেমা।

গোয়েন্দা কর্মকর্তা ফয়সাল চরিত্রে আরিফিন শুভ বেশ ভালো। ‘কিস্তিমাত’, ‘ঢাকা অ্যাটাক’, ‘মিশন এক্সট্রিম’, ‘ব্ল্যাক ওয়ার: মিশন এক্সট্রিম ২’ ছবিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যের চরিত্রে দেখা গেছে শুভকে। কপ সিনেমায় কী করতে হয় তা তাঁর ভালোই জানা। ডায়ালগ ডেলিভারিতেও তাঁর আগের চেয়ে উন্নতি হয়েছে। কিন্তু চিত্রনাট্যে সেভাবে দম না থাকলে তিনি আর কী করবেন। সব মিলিয়ে দুই বছর পর বড় পর্দায় তাঁর ফেরাটা ঠিক ফেরার মতো হলো না।

‘নীলচক্র’ ছবির ‘এই শহরের অন্ধকারে’ গানের শুটিংয়ের সময় বালাম ও সাফায়েত (বামে)
ছবি : পরিচালকের সৌজন্য

ছবিতে সেভাবে নায়িকা নেই, নাচের শিক্ষিক রাইমার (মন্দিরা চক্রবর্তী) সঙ্গে ফয়সালের একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠার ইঙ্গিত আছে মাত্র। গত বছর গিয়াসউদ্দিন সেলিমের ‘কাজলরেখা’ দিয়ে অভিষেক হয় মন্দিরার। সে সিনেমায়ও তাঁর অভিনয়ে আড়ষ্টতা ছিল, এক বছরের বেশি সময় পরে মুক্তি পাওয়া এ সিনেমায়ও সেটা রয়ে গেছে। ডায়ালগ ডেলিভারি, এক্সপ্রেশনে তাঁর আরও উন্নতি করার সুযোগ আছে। বরং তাঁর বোনের চরিত্রে প্রিয়ন্তী উর্বী বেশ প্রাণবন্ত ছিলেন। আত্মহত্যা করা এক তরুণীর বাবা সমীরের চরিত্রে ফজলুর রহমান বাবু বেশ ভালো। মুশকিল হলো, গরিব, দুঃখী আর অসহায় ব্যক্তির চরিত্রের কথা মনে হলে কেন তাঁকেই মনে পড়ে নির্মাতাদের?

‘সুড়ঙ্গ’ ছবিতে মনির আহমেদ শাকিল ভালো করেছিলেন। বছর কয়েক পরে এ ছবিতে জ্যাক চরিত্রে দেখা গেল তাঁকে। খলনায়কের চরিত্রে ভালো করেছেন তিনি। কপ সিনেমায় প্রধান চরিত্রের সহকারীর চরিত্রটি চাইলে উপভোগ্য করা যায়, যেমন গত ঈদে মুক্তি পাওয়া ‘চক্কর ৩০২’ সিনেমায় শাশ্বত দত্ত অভিনীত চরিত্রটির কথা বলা যায়। তবে এ সিনেমায় শুভর সহকারী হিসেবে শাহেদ আলী অভিনীত চরিত্রটি একেবারেই সাদামাটা।

আরও পড়ুন

রাজু রাজের চিত্রগ্রহণ চলনসই। তবে সম্পাদক চাইলেই ছবির দৈর্ঘ্য কমিয়ে দিতে পারতেন। ছবির গানের বিশেষ ভূমিকা নেই। তবে ওয়াহিদ বাবুর লেখা, ইমন সাহার সুরে মাশা ইসলামের গাওয়া ‘যেতে যেতে’ শুনতে ভালো লাগে, রাতের ঢাকায় গানটির চিত্রায়ণও বেশ ভালো। এবারের ঈদের সিনেমার অন্যতম সেরা গান এটি। তবে কেন যেন প্রচার পায়নি সেভাবে।

‘নীলচক্র’ শুরু হয় ছেলেবেলার দুই বন্ধুর গল্প দিয়ে, শেষেও মুখোমুখি হয় সেই দুই বন্ধু; যেন এক চক্র পূরণের মতোই। ছেলেবেলায় যে দৃশ্যটি থেকে ধাক্কা খেয়েছিল, যে ট্রমা তাদের জীবনভর তাড়া করে ফিরেছে, সে দৃশ্যটি দক্ষিণি নির্মাতা ত্যাগারঞ্জন কুমাররাজার ‘সুপার ডিলাক্স’ থেকে প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত।

‘নীলচক্র’ সিনেমার দৃশ্য। নির্মাতার সৌজন্যে

আর শেষে মূল খলনায়ক হিসেবে ফয়সালের ছেলেবেলার বন্ধুর চরিত্রে যে হাজির হয়; তাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার মতো কোনো অস্ত্রই দেননি নির্মাতা। তাই অতিথি চরিত্র কেবল চমক হয়েই রইল। তবে ক্ল্যাইমেক্সের চেয়ে ছবির শেষ কয়েক মিনিট আরও বেশি হতাশার। যেখানে ভয়েস ওভারে দেশ-জাতি নিয়ে ‘লেকচার’ শুনিয়েছেন নির্মাতা। সিরিয়াসলি? পুরো সিনেমায় ইন্টারনেটের ভয়াল থাবা নিয়ে এত জ্ঞান দেওয়ার পরও শেষ দৃশ্যে আবার কেউ এভাবে মুখে তুলে খাইয়ে দেয়!

আরও পড়ুন