লড়াই শেষে হলে ‘সাঁতাও’

‘সাঁতাও’ সিনেমার শুটিংয়ের একটি দৃশ্য
ছবি : সংগৃহীত

কথিত তারকা না থাকায় কোনো প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসেনি, তারপরও থেমে থাকেননি খন্দকার সুমন। গণ–অর্থায়নে নির্মাণ করেছেন নিজের প্রথম সিনেমা ‘সাঁতাও’। সিনেমাটি মুক্তি দিতেও হলে হলে ঘুরতে হয়েছে। এর মধ্যেই ঢাকা চলচ্চিত্র উৎসবে জিতে নিয়েছে সেরা ছবির পুরস্কার। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজ ঢাকাসহ দেশের পাঁচ সিনেমা হলে মুক্তি পাচ্ছে ‘সাঁতাও’।

২০১৬ সালে সিনেমার জন্য একটা গল্প ভেবেছিলেন লালমনিরহাটের তরুণ খন্দকার সুমন। রংপুর অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষের জীবন ও সংকটের গল্প। এ ধরনের স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাণ কতটা কঠিন, জানতেন সুমন, ‘আমি অন্য কোনো ধরনের সিনেমা নির্মাণ করতে পারতাম। কিন্তু যে সিনেমা মানুষের কথা বলে, জীবনের কথা বলে—সেই ধরনের সিনেমাই করতে চেয়েছি। এই সিনেমার পথে গেলে কঠিন পথ পাড়ি দিতে হবে, সেটাও জানতাম।’ তারপরও কঠিনকেই ভালোবেসেছিলেন সুমন, ‘হাল ছাড়িনি। যখনই বাধা পেয়েছি, সমাধানও পেয়েছি, কেউ না কেউ আমাকে উদ্ধার করেছেন।’
পদে পদে হোঁচট খেতে হয়েছে, আবার উঠে দাঁড়িয়েছেন। একটু একটু করে দম নিয়ে এগিয়ে গেছেন। নিজের জমানো টাকায় কুলিয়ে উঠতে না পেরে সাধারণ মানুষের শরণ নিয়েছেন। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানকে যেভাবে সিনেমার গল্প উপস্থাপন করতে হয়, তেমনি করে সাধারণ মানুষকে গল্প বুঝিয়েছেন। ১০০ থেকে ৫ হাজার, যে যেভাবে পেরেছে, সিনেমায় বিনিয়োগ করেছে।

‘সাঁতাও’ সিনেমার শুটিংয়ের একটি দৃশ্য
ছবি : সংগৃহীত

এরই নাম শুটিং
গণ–অর্থায়নে আশাব্যঞ্জক সাড়া পেয়ে সিনেমার শিল্পী নির্বাচনে নামেন খন্দকার সুমন। সিনেমার কৃষক চরিত্রে অভিনয় করেন অভিনেতা ফজলুল হক ও তাঁর স্ত্রীর ভূমিকায় রয়েছেন আইনুন পুতুল। এর আগে ‘রানওয়ে’ সিনেমায় অভিনয় করে পরিচিতি পান ফজলুল। আইনুন পুতুলকে দেখা গেছে ছোটপর্দায়। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে রংপুর, লালমনিরহাটে তিস্তা নদীর ধারে সিনেমার দৃশ্য ধারণ শুরু করেন নির্মাতা। কৃষকের সংগ্রামী জীবন, নারীর মাতৃত্বের সর্বজনীন রূপ ও সুরেলা জনগোষ্ঠীর সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নায় আবর্তিত হয়েছে সিনেমার গল্প।

সিনেমার সহকারী পরিচালক মাসুদ রানা বলেন, ‘সিনেমায় বৃষ্টি, বন্যাসহ বেশির ভাগ দৃশ্যের জন্যই আমাদের প্রকৃতির ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। ফলে একটি দৃশ্যের জন্য আমাদের অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে দিনের পর দিন। বন্যার দৃশ্যধারণের জন্য মাত্র ছয় ঘণ্টার নোটিশে শিল্পী–কলাকুশলীদের নিয়ে আমাদের তিস্তার পাড়ে যেতে হয়েছে। এর বাইরে নৌকাবাইচ, মাছ ধরার দৃশ্যগুলো আমাদের সিনেমার জন্যই আয়োজন করা হয়েছিল।’

‘সাঁতাও’ সিনেমার একটি দৃশ্য
ছবি : সংগৃহীত

শুধু প্রকৃতি নয়, প্রাণীর দৃশ্যধারণের জন্যও ঝরাতে হয়েছে অনেক ঘাম। গরুর বাছুর, মুরগির ছানা, ছাগলের ছানাসহ বহু প্রাণীর কাঙ্ক্ষিত দৃশ্যধারণের জন্য ওত পেতে থাকতে হয়েছে চিত্রগ্রাহককে। সিনেমায় একটা খেতে লাঙল দিয়ে ধানের চারা রোপণ করতে দেখা গেছে ফজলুলকে, সেই ধান কাটার দৃশ্যের জন্য মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হয়েছে। সেই খেতের ধান পাকতে শুরু করলে ধান কাটার দৃশ্য ধারণ করা হয়েছে। লালমনিরহাটের চর গোকুণ্ডা গ্রামে সিনেমার বেশির ভাগ দৃশ্য ধারণ করা হয়েছে। তিস্তার ভাঙনে গ্রামটি গত বছর নদীগর্ভে হারিয়ে গেছে, গ্রামের একটি তালগাছ এখনো নদীতে দেখা যায় বলে জানালেন পরিচালক।

আরও পড়ুন

শুধু অর্থ দিয়েই নয়, আরও নানাভাবে গ্রামের মানুষের সহযোগিতা পাওয়ার কথা বললেন নির্মাতা। সিনেমার নির্মাতা, কলাকুশলীদের নিজেদের বাড়িতে থাকতে দিয়েছেন, অনেক সময় ঢাকা থেকে টাকা পাঠাতে দেরি হলে বাজার দিয়ে গেছেন।
মাসুদ রানা জানান, দৃশ্যধারণের সময় খন্দকার সুমনের মা স্থানীয় এক হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন, দিনভর শুটিং শেষে রাতে মায়ের কাছে যেতেন। ভোরে আবার ক্যামেরা নিয়ে বের হয়ে পড়তেন তিনি।

গত বুধবার রাতভর ঢাকার কারওয়ান বাজার, নীলক্ষেত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পোস্টার সাঁটিয়েছেন নির্মাতা সুমন
ছবি : সংগৃহীত

হল পেতেও লড়াই
নির্মাণ শেষ হলেও সুমনের লড়াই শেষ হয়নি। সেন্সর বোর্ডে সিনেমাটি জমা দেওয়ার পর শুনলেন, এফডিসির অনাপত্তি সনদসহ বেশ কিছু কাগজপত্র লাগবে। সেই কাগজপত্র তুলতে গিয়ে জানলেন, সেখানে মোটা অঙ্কের খরচাপাতি আছে। একে তো এত টাকা নেই, তার ওপর সেখানে কেন টাকা দিতে হবে—তার উত্তর মিলছিল না। পরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি চিঠি লেখেন, শেষে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপে শুধু সরকারি ফি দিয়ে সনদ পেলেন সুমন।

সেন্সর ছাড়পত্র পাওয়ার পর মুক্তি দিতে গিয়ে মুদ্রার আরেক পিঠ দেখলেন খন্দকার সুমন। কথিত তারকা শিল্পী না থাকায় কোনো হলই সিনেমাটি চালাতে চাইছে না। এর মধ্যে ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশ প্যানারোমা বিভাগে সেরা সিনেমার পুরস্কার পেয়ে যায় ‘সাঁতাও’, পুরস্কার মঞ্চে হল না পাওয়া নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করেন সুমন। পরে চট্টগ্রামের সুগন্ধা সিনেমা কর্তৃপক্ষ নির্মাতার সঙ্গে যোগাযোগ করে সিনেমাটি চালাতে চান, আস্তে আস্তে ঢাকার বসুন্ধরা সিটিতে স্টার সিনেপ্লেক্স, যমুনা ফিউচার পার্কের ব্লকবাস্টার সিনেমাস, রংপুরের শাপলা সিনেমা হল, চট্টগ্রামের সিলভার স্ক্রিন কর্তৃপক্ষও এগিয়ে আসে। সিনেমাটি আজ থেকে এসব হলে চলবে।

আরও পড়ুন

নিজেদের সবটুকু দিয়ে সিনেমার প্রচারণায় নেমেছেন নির্মাতা, শিল্পী ও কলাকুশলীরা। গত বুধবার রাতভর ঢাকার কারওয়ান বাজার, নীলক্ষেত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পোস্টার সাঁটিয়েছেন নির্মাতা সুমন। গতকাল উত্তরা এলাকায় পোস্টার টানিয়েছেন তিনি। পোস্টারের পাশাপাশি রংপুর অঞ্চলে মাইকে সিনেমার প্রচারণা চলছে।
সিনেমার নামকরণ ‘সাঁতাও’ কেন? পরিচালক জানান, রংপুর অঞ্চলে টানা কয়েক দিনের বর্ষণকে ‘সাঁতাও’ বলা হয়; সিনেমায় টানা বর্ষণের দৃশ্যও রয়েছে।

পরিচালনার পাশাপাশি সিনেমার গল্প, চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেছেন খন্দকার সুমন। বিভিন্ন চরিত্রে পুতুল ও ফজলুল হক ছাড়াও অভিনয় করেছেন সাবেরা ইয়াসমিন, স্বাক্ষ্য শাহীদ, শ্রাবণী দাস, তাসমিতা শিমু, মিতু সরকার, ফারুক শিয়ার, আফরিনা বুলবুল, রুবল লোদী, আলমগীর কবীর, রবি দেওয়ান, দীনবন্ধু পাল। সিনেমার প্রধান সহকারী পরিচালক শ্যামল শিশির, সহকারী পরিচালক মাসুদ রানা ও সুপিন বর্মণ। গত বছরের শেষভাগে গোয়ায় অনুষ্ঠিত ‘ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অব ইন্ডিয়া’র ৫৩তম আসরে সিনেমাটি প্রদর্শিত হয়েছে।

আরও পড়ুন