বাবার পাওনা বুঝে নিতে এফডিসিতে হৃদয়

এফডিসির সাবেক পরিচ্ছন্নতাকর্মী প্রয়াত অধীর চন্দ্র সাহার অবসর ভাতার চেক নিতে মা ছিয়া রানীর সঙ্গে ছেলে হৃদয়ছবি : নাজমুল হক

রোববার খুব ভোরে ঘুম ভাঙে সাত বছর বয়সী হৃদয় চন্দ্র সাহার। ভোরের আলো ফোটার পর মায়ের সঙ্গে সাভার থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা করে। গন্তব্য বাবার কর্মস্থল বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি)। এখানে এর আগে অনেক আসা হলেও এবার হৃদয় এসেছে বাবাকে ছাড়াই। এফডিসির সাবেক পরিচ্ছন্নতাকর্মী প্রয়াত অধীর চন্দ্র সাহার অবসর ভাতার চেক নিতে মায়ের সঙ্গে তার আসা। বিএফডিসির ২৩ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারীর অবসর ভাতার চেক হস্তান্তর করা হয় আজ রোববার। এর মধ্য দিয়ে বাবার কর্মস্থল বিএফডিসির সঙ্গে লেনদেন শেষ হয় হৃদয়ের পরিবারের।

প্রায় ২৪ বছর ধরে বিএফডিসিতে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে চাকরি করেছেন অধীর চন্দ্র সাহা। ২০২৩ সালে ক্যানসারে মারা যান তিনি। যা সম্বল ছিল, ক্যানসারের চিকিৎসায় তা হারিয়ে দুই সন্তানকে নিয়ে অকূলপাথারে পড়েন তাঁর স্ত্রী ছিয়া রানী দাস। সন্তানদের পড়ালেখা বন্ধ হয়, স্বামীর অবসর ভাতার জন্য বিএফডিসির প্রশাসনিক ভবনে কর্মকর্তাদের দুয়ারে দুয়ারে কয়েক বছর ধরে ঘুরেছেন তিনি। এর মধ্যে বিএফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বদলেছে তিন দফায় কিন্তু স্বামীর অবসর ভাতা পাননি ছিয়া রানী। আজ তাঁর অপেক্ষার প্রহর ফুরায়, বিএফডিসি থেকে স্বামীর পাওনা টাকার সমপরিমাণ অর্থের চেক বুঝে পান তিনি।

আরও পড়ুন
এফডিসির নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুমা রহমান একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে চেক বিতরণ করেন। এর আগে আগত ব্যক্তিদের মিষ্টিমুখ করান, সঙ্গে ফুল দিয়ে বরণ করে নেন।
ছবি : প্রথম আলো

এফডিসির নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে চেক বিতরণ করেন। এর আগে আগত ব্যক্তিদের মিষ্টিমুখ করান, সঙ্গে ফুল দিয়ে বরণ করে নেন। আয়োজনের পুরোটা সময় বারবার চোখ মুছেছেন ছিয়া রানী।

প্রথম আলোকে ছিয়া রানী বলেন, ‘কত দিন এসেছি, কেউ কথা পর্যন্ত বলেনি। আমার দুই এতিম বাচ্চার এ–ই তো শেষ সম্বল। স্যার-ম্যাডামদের জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা।’
কখনো কাঁধে করে, কখনোবা হাত ধরে হৃদয়কে এফডিসির বিভিন্ন শুটিং স্পট দেখিয়েছেন বাবা অধীর চন্দ্র সাহা। কীভাবে শুটিং হয়, কোন গাড়িতে কোন তারকা ঢুকছেন, তা–ও দেখিয়েছেন বাবা।

প্রশাসনিক ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে ২ নম্বর ফ্লোরের দিকে ইশারা করে প্রতিবেদককে হৃদয় বলে, ‘ওই দিকে ঝরনা না?’ পাঁচ বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছে হৃদয়। বিএফডিসিতে বেশ কয়েকবার এলেও শেষবারের কথা মনে পড়ে হৃদয়ের। তার কথায়, ‘সব ঘুরে দেখেছি বাবার সঙ্গে। এখানে কত শুটিং হতো। ক্যানটিনে খেয়েছি, ঝরনার ওখানে গিয়েছি। আঙ্কেলরা অনেক আদর করতেন।’

আরও পড়ুন

ছিয়া রানীর মতো অনেকেই এসেছেন স্বামীর চেক নিতে, কেউবা বাবার। আবার বয়োজ্যেষ্ঠ অনেকেই প্রিয় কর্মস্থলে ছুটে এসেছেন হবিগঞ্জ, বরিশাল, খুলনা থেকেও। তাঁদের একজন ক্যামেরা সহকারী রুহুল আমিন। তাঁর জীবনের কয়েক যুগ কেটেছে বিএফডিসিতে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘কত স্মৃতি এখানে। কয় দিন বাঁচব, জানি না। হয়তো শেষবারের মতো এলাম। কত মানুষের সঙ্গে দেখা হলো।’

একেকজনের কষ্টের গল্প শুনে অশ্রুসিক্ত হয়েছে সবার। বিএফডিসির ব্যবস্থাপক মাসুমা রহমানও বারবার মুছেছেন চোখ। বক্তব্য দেওয়ার সময় তাঁর গলা ধরে এসেছে। মঞ্চ থেকে নেমে দর্শকসারিতে এসেই সবার হাতে তিনি চেক তুলে দেন। মাসুমা রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সবার প্রতি ক্ষমাপ্রার্থী, এত দিন সময় লেগেছে তাঁদের পাওনা পরিশোধে। দেখুন, চলচ্চিত্রের উন্নয়নের জন্যই তো এই প্রতিষ্ঠান, কিন্তু ঋণ রেখে কি উন্নয়ন সম্ভব? চেষ্টা করব বাকিদের পাওনাও যাতে খুব দ্রুত পরিশোধ করতে পারি।’
বিএফডিসির অর্থ শাখা সূত্রে জানা গেছে, আজ ২৩ জনের মধ্যে ৩ কোটি ৫৮ লাখ টাকা হস্তান্তর করা হয়েছে। আরও ৩৮ জনের টাকা পাওনা রয়েছে। চলতি বছরের শেষে আরও ১২ জন যুক্ত হবেন এ তালিকায়।