বেতন পাচ্ছেন না, এফডিসির কর্মীদের মানবেতর জীবন
‘তিন মাস ধরে বেতন পাইনি। ভাড়া বাসায় থাকি, ভাড়া দিতে পারছি না। বাড়িওয়ালা বাসা ছেড়ে দিতে বলেছেন। হাতেপায়ে ধরে আর কত দিন থাকা যায়, অপমানিত হয়েও থাকছি। ’ প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে বললেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএফডসি) চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী মোহাম্মদ বদরুজ্জামান।
কর্মকর্তা থেকে মালি, ক্লিনার, নিরাপত্তারক্ষীসহ এফডিসির ২১২ কর্মী গত তিন মাস ধরে (নভেম্বর, ডিসেম্বর ও জানুয়ারি) বেতন–ভাতা না পেয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন।
গত ২৩ জানুয়ারি এফডিসিতে মোহাম্মদ বদরুজ্জামানসহ বেশ কয়েকজন কর্মীর সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। ২০০২ সাল থেকে এফডিসিতে কাজ করছেন বদরুজ্জামান, ২০১৬ সাল থেকে তাঁর চাকরি স্থায়ী হয়েছে। বর্তমানে জুনিয়র চিত্রগ্রহণ সহকারী (চলতি দায়িত্ব) হিসেবে কাজ করছেন তিনি।
ঢাকায় একা থাকেন বদরুজ্জামান, মগবাজারের দিলু রোডের এক মেসে ভাড়া থাকেন তিনি। বদরুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। দোকানে বাকি পরিশোধ করতে না পারায় দোকানি আর বাকি দিতে চাচ্ছেন না। সবজি বাকি পাওয়া যায় না। গতকাল আমি দুইবার বাজারে গিয়ে খালি হাতে ফিরে এসেছি। শুধু আধা কেজি আলু কিনেছি, অন্য তরকারি কিনতে পারিনি। ’
তাঁর গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায়। গ্রামে তাঁর স্ত্রী ও দুই ছেলে রয়েছে। সন্তানেরা স্কুলে পড়াশোনা করেন, লেখাপড়ার খরচ সামলাতেও হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। “মানুষ বলে, “কিসের সরকারি চাকরি করো, মাস গেলে বেতন পাও না। ”, আক্ষেপ নিয়ে বললেন তিনি।
বকেয়া বেতন–ভাতা পরিশোধের জন্য এফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুজহাত ইয়াসমিনকে একাধিকবার চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন কলাকুশলী ও কর্মচারী লীগ (সিবিএ)। গত ১০ জানুয়ারি পাঠানো চিঠির একটি অনুলিপি এসেছে প্রথম আলোর কাছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘বেতন–ভাতা না পাওয়ায় আমরা পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছি। ’
এফডিসির কর্মকর্তা ও নিরাপক্ষারক্ষী বাদে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ১৬০ কলাকুশলী ও কর্মচারী লীগের সদস্য। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আহসান হাবিব প্রথম আলোকে জানান, ১৫ ফেব্রুয়ারির আগে বেতন–ভাতা না পেলে ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে কর্মবিরতিতে যাচ্ছেন এফডিসির কর্মীরা।
স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে এফডিসির নিজস্ব তহবিল থেকেই কর্মীদের বেতন-ভাতা পরিশোধের বিধি রয়েছে। তবে লোকসানের মুখে প্রায় দেড় দশক ধরে ধুঁকছে ঢাকাই সিনেমার প্রাণকেন্দ্র এফডিসি। চলচ্চিত্রের শুটিং কমে যাওয়া, অব্যবস্থাপনাসহ নানা জটিলতার জেরবারে নিজস্ব তহবিল থেকে কর্মীদের বেতন পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে বছর বছর সরকারের অনুদানের ওপর নির্ভর করে চলছে প্রতিষ্ঠানটি।
এফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুজহাত ইয়াসমিন গতকাল বুধবার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এফডিসির নিজস্ব তহবিলে অর্থ না থাকায় বকেয়া বেতন পরিশোধের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে আমরা অর্থ চেয়েছি। ওটা পেলে বকেয়া বেতন দেওয়া যাবে। ’
অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ না মিললে বেতন দেওয়ার মতো আর্থিক সংগতি নেই এফডিসির। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে কবে অর্থ মিলবে, তাও নিশ্চিত করতে পারেননি নুজহাত ইয়াসমিন। ফলে বেতন নিয়ে কর্মীদের মাঝে ক্রমেই অসন্তোষ বাড়ছে।
ঢাকাই সিনেমার রমরমা সময়ে নিজেদের আয়েই চলেছে এফডিসি। লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কর্মীদের বেতন–ভাতা পরিশোধ করে কোনো কোনো বছর ৮০ লাখ টাকার মতো আয়করও দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
২০০৬ সাল থেকে লোকসান শুরু হলেও এফডিসির কর্মীদের বেতন–ভাতা নিজস্ব তহবিল থেকে পরিশোধ করা হয়েছিল। তার প্রায় এক দশক পর ২০১৫ সাল থেকে কর্মীদের বেতন পরিশোধে প্রায় পুরোপুরিই অনুদানের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
এফডিসিতে চলচ্চিত্রের কাজ কমে যাওয়ায় আয়ের বিকল্প উপায় খুঁজছে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানটি। এফডিসিকে আবার স্বাবলম্বী করতে সরকার ৩২২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘বিএফডিসি কমপ্লেক্স নির্মাণ’ প্রকল্প হাতে নিয়েছে; কমপ্লেক্সটির নির্মাণকাজ শেষ হলে এফডিসির আয় বাড়ার আশায় দিন গুনছেন কর্মীরা। এর নির্মাণকাজ শেষ হতে আরও বছর দুয়েক লাগতে পারে।