এফডিসির একাল–সেকাল ৩: দায় নিচ্ছে না কেউ, ‘রমরমা’ কি ফিরবে

এ গেটের সামনেই একসময় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বহু উৎসুক মানুষ তাঁদের প্রিয় নায়ক–নায়িকাকে একনজর দেখার জন্য অপেক্ষায় থাকতেন
ছবি: প্রথম আলো

২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের কথা। সেই সময়ের তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান বলেছিলেন, ‘এফডিসি তো গার্বেজ (ভাগাড়)। কেন এমনটা হলো? কারা দায়ী? এফডিসিকে সিন্ডিকেটমুক্ত করেন...!’

নায়ক ও প্রযোজক শাকিব খানের প্রযোজনা সংস্থা এসকে ফিল্মসের বড় পরিসরে যাত্রা ও ‘বীর’ ছবির মুক্তি উপলক্ষে রাজধানীর ঢাকা ক্লাবে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মুরাদ হাসান এসব কথা বলেছিলেন।

শুধু সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী নন, এফডিসি বেহাল হওয়ার পেছনে দায় কার—এ প্রশ্ন চলচ্চিত্র–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মনেও ঘুরপাক খাচ্ছে। তাঁরা বলছেন, তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত এফডিসির ‘গার্বেজ’ হওয়ার দায় মন্ত্রণালয় কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।

তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধিভুক্ত সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডসহ ১১টি সংস্থার নামে প্রতিবছর বাজেটে বরাদ্দ দেওয়া হয়। শুধু বিএফডিসির জন্য কোনো বরাদ্দ নেই। নিজস্ব আয়ে চলার কথা প্রতিষ্ঠানটির।

এফডিসিতে ১০০ থেকে ১৫০টি সিনেমার কাজ হতো, একই সঙ্গে এই পরিমাণ ছবি মুক্তি পেত, অর্থাৎ চলমান একটি প্রক্রিয়া ছিল। বর্তমানে এফডিসির যে অবস্থা, তার জন্য প্রযোজক, হলমালিকদেরও দায় আছে। অশ্লীল চলচ্চিত্র তৈরির ফলে দর্শক হলবিমুখ হয়ে পড়েন।
আলমগীর, নায়ক ও পরিচালক

সম্প্রতি বিএফডিসিতে চার দিন সরেজমিনে গিয়ে এমনও দেখা গেছে, শুটিং ফ্লোরসহ কোনো কোনো কক্ষের তালা চেষ্টা করেও খুলতে পারছিলেন না কর্মীরা। কেননা, তালাগুলোয় অনেক মরিচা পড়েছে। কর্মীরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, একসময় কক্ষের তালা লাগানোরই ফুরসত পাওয়া যেত না। প্রায় ২৪ ঘণ্টাই কাজ হতো।

বিএফডিসির ২০১১-১২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৫-০৬ অর্থবছর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি মুনাফা অর্জন করেছিল।

নষ্ট হওয়া যন্ত্রপাতির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে কর্মীদের আবেগ।
ছবি: মানসুরা হোসাইন

এরপর থেকে সংস্থাটি বাজেট ঘাটতিতে চলছে অর্থাৎ আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হচ্ছে। এর পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে, চলচ্চিত্র নির্মাণ কমে যাওয়া। চলচ্চিত্র নির্মাণ কমে যাওয়ায় আয় কমেছে, দুর্নীতি গ্রাস করলেও আমলে নেয়নি কর্তৃপক্ষ।

অ্যানালগ ৩৫ মিলিমিটার ফরম্যাটে বিদেশ থেকে বিভিন্ন ধরনের কাঁচা ফিল্ম, যেমন সাউন্ড নেগেটিভ, পিকচার নেগেটিভ ও পজিটিভ আমদানি করে চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কাছে বিক্রি করার একচেটিয়া প্রতিষ্ঠান ছিল বিএফডিসি।

‘দায় ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের’

এফডিসির প্রধান ব্যক্তি ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। তিনি পরিচালনা পর্ষদ ও সেন্সর বোর্ডের সদস্যসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন।

এফডিসি বেহাল হওয়ার পেছনে দায় কার—এমন প্রশ্নের উত্তরে জ্যেষ্ঠ পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার দেলোয়ার জাহান ঝন্টু বললেন, ‘এর দায় এফডিসি কর্তৃপক্ষকেই নিতে হবে। এফডিসি কর্তৃপক্ষের অবস্থা হচ্ছে—এখানে কাজ করলে করো, না করলে নাই। সরকারি প্রতিষ্ঠান বলেই এটি এভাবে চলতে পারছে।’

ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যাঁরা দায়িত্ব পালন করেছেন, তাঁদের পুরো দায় নিতে হবে বলে মন্তব্য করেন জ্যেষ্ঠ চলচ্চিত্র পরিচালক সোহানুর রহমান সোহান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এ পদে যাঁরা আসেন, তাঁদের বেশির ভাগ শুধু ‘পাহারাদার বা দোকানদারের’ ভূমিকা পালন করেন। দোকানের জিনিস বিক্রি বা নষ্ট হলেই বা কী, না হলেই বা কী!

১৯৫৭ সালে এফডিসির প্রথম ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন আবুল খায়ের। এরপর বিভিন্ন মেয়াদে এ পদে ৪৬ জন দায়িত্ব পালন করেন। নুজহাত ইয়াসমিন ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি থেকে প্রথমে অতিরিক্ত দায়িত্ব এবং এরপর ওই বছরের ৬ অক্টোবর থেকে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন।

একসময় ‘এক্সট্রা’দের ভিড় থাকত এখানে
ছবি: খালেদ সরকার

অবশ্য এফডিসি বেহাল বলে মানতে রাজি নন নুজহাত ইয়াসমিন। তাঁর মতে, এফডিসিতে কিছু সংকট চলছে। আগামী দুই বছরের মধ্যে এফডিসি আবার ঘুরে দাঁড়াবে।

গত বছর চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনে নুজহাত ইয়াসমিনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ তুলেছিলেন চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট ১৭ সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। দ্রুত তাঁর অপসারণ চেয়ে প্রশাসনিক ভবনের সামনে সমাবেশও করেন তাঁরা।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এফডিসিতে যাঁরাই ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে এসেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করে দায়িত্ব শেষ করেছেন। বিদায় নেওয়ার সময় বলে যান, তাঁরা এফডিসির উন্নয়নে কাজ করার চেষ্টা করেছেন।

আরও পড়ুন

আবুল খায়েরের পর থেকে এ এম সানাউল হক, খায়রুল কবির, এ এইচ এম সাদেকুর রহমান, এ কে এম মোহিববুর রহমান, এস এম আবুল হোসেন, দাউদ খান মজলিস, এস এম হাশিম, এস আই বাহাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, জয়নুল আবেদীন, জিন্নাত আলী, কলিম উল্যাহ ভূঁইয়া, লে. কর্নেল (অব.) মাহমুদ হোসেন, কাজী নূরুল ইসলাম, সৈয়দ বজলে হোসেন, কর্নেল (অব.) সৈয়দ শাহাবুদ্দিন আহমেদ, গ্রুপ ক্যাপ্টেন (অব.) সাইফুল আলম, সৈয়দ ইউসুফ হোসেন, মুস্তাফা মনোয়ার, মো. হাবিবুর রহমান, শাহরিয়ার জেড আর ইকবাল, গ্রুপ ক্যাপ্টেন (অব.) এ বি এম জাকারিয়া, রফি আহমেদ চৌধুরী, কাজী আব্দুল বায়েস, খান আমীর আলী, জালাল উদ্দিন আহমেদ, জিয়াউদ্দিন আহমেদ, গোলাম মুর্তাজা, মোহাম্মদ মুসা, সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী, মো. ওয়াসিমুল বারী রাজীব, মো. খলিলুর রহমান সিদ্দিকী, আ ত ম ফজলুল করিম, আ ন ম বদরুল আমিন, মমতাজ–আলা শাকুর আহমেদ, মো. ফরহাদ হোসেন, ম হামিদ (২০১১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর থেকে ২০১২ সালের  ১১ মার্চ), এস এম হারুন অর রশীদ, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, তপন কুমার ঘোষ, মো. আমির হোসেন, লক্ষণ চন্দ্র দেবনাথ, মো. আবদুল করিম ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

এফডিসির ভেতরে ১২তলা বিএফডিসি কমপ্লেক্স হচ্ছে—এই ‘মুলা’ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে, এ ভবন দিয়ে চলচ্চিত্রের কী উন্নয়ন হবে, তা বুঝি না। এফডিসিতে অন্য রকম কিছু করতে হবে, সে পরিকল্পনা নেই। ক্যামেরাগুলো ব্যবহার না করতে করতে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
সোহানুর রহমান সোহান, পরিচালক

ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হন পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি ২০১২ সালের ২৪ এপ্রিল থেকে ২০১৪ সালের ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।

যন্ত্রপাতি কেনা বাবদ উন্নয়ন প্রকল্পে সরকারের ৩ কোটি ৪৬ লাখ ৫৮ হাজার ৫২০ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে—এমন অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলার এজাহারে বলা হয়েছিল, ক্রয় প্রক্রিয়ায় তখনকার ব্যবস্থাপনা পরিচালক পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়সহ এফডিসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা পেশাগত দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেছেন, প্রাক্-জাহাজীকরণের বিধিমালা মানেননি।

তাঁরা মনগড়া বিশ্লেষণের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তে চীনের তৈরি মালামাল জাহাজীকরণের অনুমতি দেন। এ ছাড়া মালামাল গ্রহণ কমিটির সুপারিশ আছে বলে মিথ্যা তথ্য দিয়ে চুক্তিবহির্ভূতভাবে চীনের তৈরি মালামাল গ্রহণ ও মূল্য পরিশোধ করেন। এসব অনিয়ম করার বিষয়ে মালামাল সরবরাহকারী খন্দকার শহীদুল ইসলাম আসামিদের উৎসাহিত করেছেন। প্রকল্প পরিচালক মো. শফিকুল ইসলামের এসব অনিয়মকে পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় সমর্থন করেন।

মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়া পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় মামলা প্রসঙ্গে কথা বলতে চান না জানিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, এফডিসির সার্বিক বেহালের পেছনে পরিকল্পনার ঘাটতি আছে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নেও সমস্যা আছে। তিনি তাঁর সময়ে এফডিসির উন্নয়নে কিছু কাজ করার চেষ্টা করেছিলেন বলে জানান।

চলচ্চিত্র–সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এফডিসি পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের প্রতিষ্ঠানটির উন্নয়নে মাথাব্যথা না থাকায় নতুন স্টুডিও নির্মাণ, ফিল্ম ইনস্টিটিউট তৈরি, চলচ্চিত্রবিষয়ক প্রশিক্ষণ কোর্স চালু, ফিল্ম প্রডিউসার করপোরেশন চালু, সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে কাঁচা ফিল্ম আমদানি না করে দেশে ফিল্ম তৈরির কারখানা স্থাপন—এগুলো আলোর মুখ দেখেনি।

‘অশ্লীল চলচ্চিত্রে হলবিমুখ দর্শক’

এফডিসিতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন এমন কয়েকজন কর্মী জানান, অভিনেতা মো. ওয়াসিমুল বারী রাজীবও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে আলোচিত ছিলেন। তিনি ২০০২ সালের ১০ জানুয়ারি থেকে ২০০৪ সালের ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত (মৃত্যুর আগপর্যন্ত) দায়িত্ব পালন করেন।

২০১৪ সালে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ থেকে প্রকাশিত মো. রাজিবুর হাসানের লেখা ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পে এফডিসির ভূমিকা: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’ গবেষণাগ্রন্থে বলা হয়েছে, ওয়াসিমুল বারী রাজীব কম টাকায় প্রযোজকদের ছবি নির্মাণের সুযোগ করে দেন।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কম বাজেটে এফডিসির পিয়ন থেকে শুরু করে অভিজ্ঞতা নেই—এমন ব্যক্তিরাও বাণিজ্যিক ছবির নামে অশ্লীল ছবি নির্মাণ শুরু করেন। দর্শক কমতে শুরু করে। সিনেমা হলে কাটপিস নামে অশ্লীল দৃশ্য ও গান দেখানো শুরু হয়। এতে সহায়তা করেন এফডিসির ল্যাবের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা। এফডিসিতেই এসব অশ্লীল দৃশ্যের শুটিং হতো।

শেষ কবে ঝাড়পোছ করা হয়েছিল, বোঝা কঠিন। অবহেলায় পড়ে আছে অ্যানালগ যুগের যন্ত্রপাতি
ছবি: প্রথম আলো

২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তথ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আ ন ম বদরুল আমিন। র‍্যাবের সহায়তায় টাস্কফোর্স গঠনের মাধ্যমে তিনি অশ্লীলতা বন্ধে উদ্যোগ নেন। এ ছাড়া তেমন আর কোনো উদ্যোগের কথা জানা যায়নি।

নায়ক আলমগীর অতীতের স্মৃতিচারণা করে বলেন, এফডিসিতে ১০০ থেকে ১৫০টি সিনেমার কাজ হতো, একই সঙ্গে এই পরিমাণ ছবি মুক্তি পেত, অর্থাৎ চলমান একটি প্রক্রিয়া ছিল। বর্তমানে এফডিসির যে অবস্থা, তার জন্য প্রযোজক ও হলমালিকদেরও দায় আছে।

অশ্লীল চলচ্চিত্র তৈরির ফলে দর্শক হলবিমুখ হয়ে পড়েন। এসব সিনেমা তো আর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দেখা যায় না। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সরকার পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় ও ওয়াসিমুল বারী রাজীবকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব দিল। তাতে এফডিসির কোনো উন্নয়ন হয়নি।

প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও অদক্ষতায় এফডিসি এমন বেহাল। এখন শুধু এফডিসির প্রাণটা আছে, তা–ও কবে নিভে যাবে কে জানে! এফডিসির এখন আর কোনো ভিশন নেই। এফডিসিতে গবেষণার জন্য কোনো ইউনিট আজ পর্যন্ত হলো না।
মির্জা তারেকুল কাদের, গবেষক

প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও অদক্ষতায় এমন অবস্থা

এফডিসির সর্বশেষ প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনে (২০১৭-২১) উল্লেখ করা হয়েছে, বিভিন্ন কারণে বিএফডিসিতে চলচ্চিত্র নির্মাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাওয়ায় প্রতিষ্ঠানটি চরম আর্থিক সংকটে পড়েছে। সরকারের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা ও আর্থিক সহযোগিতা প্রয়োজন। নিজস্ব আয় কমে যাওয়ায় কর্মীদের বেতন-ভাতা দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে। প্রতিষ্ঠানটিকে রাজস্ব বাজেটের আওতায় আনা প্রয়োজন।

জ্যেষ্ঠ পরিচালক সোহানুর রহমান সোহান ব্যবস্থাপনা পরিচালক কর্নেল (অব.) সৈয়দ শাহাবুদ্দিন আহমেদ (১৯৮২-৮৪) এফডিসিকে আমূল পাল্টে দিয়েছিলেন বলে উল্লেখ করলেন। তাঁর মতে, এফডিসির উন্নয়নের জন্য ভালো প্রশাসক নিয়োগ দিতে হবে, যিনি চেয়ারে বসবেন, তাঁকে এফডিসিকে ভালোবাসতে হবে। উন্নয়ন করার জন্য মন থাকতে হবে। কিন্তু বেশির ভাগের ক্ষেত্রেই এসব অনুপস্থিতি।

এফডিসির সার্বিক অবস্থা প্রসঙ্গে সোহানুর রহমান সোহান বলেন, প্রজেকশন হলের ভাড়া আড়াই হাজার টাকা ছিল, তা বাড়িয়ে ২৫ হাজার টাকা করা হয়েছে। কে আসবে এখানে কাজ করতে? প্রযুক্তির পরিবর্তন হয়েছে, অথচ এফডিসিতে তার কোনো ছাপ নেই। এফডিসির ভেতরে ১২ তলা বিএফডিসি কমপ্লেক্স হচ্ছে—এ ‘মুলা’ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এ ভবন দিয়ে চলচ্চিত্রের কী উন্নয়ন হবে, তা বুঝি না! এফডিসিতে অন্য রকম কিছু করতে হবে, সে পরিকল্পনা নেই। ক্যামেরাগুলো ব্যবহার না করতে করতে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

ফ্লোরগুলোতে চলে টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের শুটিং
ছবি প্রথম আলো

এ পর্যন্ত ৩৫টি চলচ্চিত্র পরিচালনা করা সোহানুর রহমান সোহান জানান, তিনি ২০১০ সালের পর সেই অর্থে এফডিসিতে কোনো কাজ করেননি। কেননা, এফডিসিতে কাজের পরিবেশ নেই, এফডিসি এখন আর সেভাবে টানেও না।

সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র পেতে লাগে এফডিসির অনাপত্তিপত্র। ‘সাঁতাও’ সিনেমার নির্মাতা খন্দকার সুমন এফডিসি থেকে অনাপত্তিপত্র পেতে যে ভোগান্তির শিকার হয়েছিলেন, তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বরাবর চিঠিও লিখেছিলেন। তাঁর সিনেমাটি মুক্তি পায় গত ২৭ জানুয়ারি।

খন্দকার সুমন প্রথম আলোকে বলেন, এফডিসি থেকে অনাপত্তিপত্র পেতে সদস্য হওয়া, সিনেমা হলে মুক্তির তারিখ পাওয়াসহ আনুষাঙ্গিক খরচ হিসেবে চলচ্চিত্র প্রযোজক পরিবেশক সমিতিকে দিতে হয়েছে ১ লাখ ১৮ হাজার টাকা। অথচ সরকারি প্রতিষ্ঠান এফডিসি কোনোভাবেই বেসরকারি একটি সমিতির সদস্য হতে বাধ্য করতে পারে না। এ থেকে সরকার কোনো রাজস্বও পাচ্ছে না। এফডিসিতে সিনেমার কোনো কাজ না করার জন্য দিতে হয়েছে ১৫ হাজার টাকা। এর বাইরে ছিল সেন্সর বোর্ডের ফি।

চলচ্চিত্র–সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এফডিসি পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের প্রতিষ্ঠানটির উন্নয়নে মাথাব্যথা না থাকায় নতুন স্টুডিও নির্মাণ, ফিল্ম ইনস্টিটিউট তৈরি, চলচ্চিত্রবিষয়ক প্রশিক্ষণ কোর্স চালু, ফিল্ম প্রডিউসার করপোরেশন চালু, সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে কাঁচা ফিল্ম আমদানি না করে দেশে ফিল্ম তৈরির কারখানা স্থাপন—এগুলো আলোর মুখ দেখেনি। এফডিসির অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল চলচ্চিত্রের বাজার সম্প্রসারণের জন্য নতুন প্রেক্ষাগৃহ স্থাপন বা এ ব্যাপারে সহায়তা দেওয়া। এফডিসি এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা রাখেনি।

বিএফডিসির সর্বশেষ প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনে (২০১৭-২১) উল্লেখ করা হয়েছে, বিভিন্ন কারণে বিএফডিসিতে চলচ্চিত্র নির্মাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাওয়ায় প্রতিষ্ঠানটি চরম আর্থিক সংকটে পড়েছে। সরকারের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা ও আর্থিক সহযোগিতা প্রয়োজন। নিজস্ব আয় কমে যাওয়ায় কর্মীদের বেতন-ভাতা দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

বিদেশে বাংলাদেশি সিনেমার বাজার সৃষ্টিতেও ভূমিকা রাখেনি। ১৯৭৪ সালের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ঢাকায় একটি ও চট্টগ্রামে একটি সাব-স্টুডিও প্রতিষ্ঠার কথা বলা হলেও সেগুলো বাস্তবায়িত হয়নি।

১৯৯৩ সালে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্প’ গবেষণাগ্রন্থের লেখক মির্জা তারেকুল কাদের প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও অদক্ষতায় এফডিসি এমন বেহাল হয়েছে। এখন শুধু এফডিসির প্রাণটা আছে, তা–ও কবে নিভে যাবে কে জানে!

এফডিসির এখন আর কোনো ভিশন নেই। এফডিসিতে গবেষণার জন্য কোনো ইউনিট আজ পর্যন্ত হলো না।’ আক্ষেপ করে এই গবেষক বললেন, ‘গবেষণায় এফডিসির বিভিন্ন দুর্নীতির কথা তুলে ধরায় এফডিসিতে আমার যাওয়াই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এ প্রতিষ্ঠানের গৌরব ফিরিয়ে আনতে হলে সরকারকে তার গুরুত্ব বুঝতে হবে। কিন্তু সে সময় আর আছে বলে তো মনে হয় না।’

‘নেতিবাচক শিরোনামে’ এফডিসি

মির্জা তারেকুল কাদেরের ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্প’ গবেষণাগ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৬৭ সালে এফডিসির প্রসঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদে উত্থাপিত হয়। ওই সময় সাবেক স্বতন্ত্র সদস্য আবদুল মতিন লস্কর এফডিসিকে ‘ফেয়ার ডিপো অব করাপশন’ বলে অভিহিত করেছিলেন। ১৯৭৬ সালের মার্চ মাসে তৎকালীন সামরিক সরকার এফডিসির অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি নিয়ে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে। এ কমিটির প্রতিবেদন ১৯৭৬ সালের অক্টোবর মাস থেকে ‘সাপ্তাহিক পূর্বাণী’তে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে অযোগ্য ব্যক্তির নিয়োগ ও তাঁদের সীমাহীন দুর্নীতিতে চরম প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনার কথাও এ গবেষণায় উল্লেখ করা হয়।

গবেষণাগ্রন্থটিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৯২ সালের জুন মাস পর্যন্ত সরকারের কাছে এফডিসির ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৯ কোটি ৮২ লাখ টাকা। আইন অমান্য করে ব্যাংক গ্যারান্টি বা সম্পত্তি বন্ধক ছাড়াই বিভিন্ন ব্যক্তি বা কোম্পানিকে ঋণ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

১৯৯১ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রার এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বিএফডিসির কালার ল্যাব থেকে আট লাখ ফুট পরিস্ফুটিত ফিল্ম খোয়া গেছে। প্রায় ৩৪ লাখ টাকা খোয়া গেছে হিসাব বিভাগ থেকে। ‘প্রফেসর’ ছবির ৪০০ ফুট নেগেটিভ নষ্ট হওয়ায় এফডিসিকে প্রায় লক্ষাধিক টাকা ভর্তুকি দিতে হয়। অর্থাৎ নানা অনিয়মের খবর আগে থেকেই প্রকাশিত হচ্ছিল।

চলছে বিএফডিসি কমপ্লেক্সের নির্মাণকাজ
ছবি: খালেদ সরকার

সাম্প্রতিক সময়ে প্রথম আলোসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিএফডিসি–সংক্রান্ত কিছু খবরের শিরোনাম এমন—‘এফডিসিতে কোরবানি দিয়ে সবাইকে চমকে দিলেন চিত্রনায়িকা পরীমণি’, ‘এফডিসি থেকে অরুণা বিশ্বাসের ফোন, ক্রেডিট কার্ড, জাতীয় পরিচয়পত্র চুরি’, ‘সম্মান হারানোর ভয়ে এফডিসি যাই না: বাপ্পারাজ’। আর এর বাইরে ‘এফডিসিতে বিভিন্ন সমিতির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কাদা ছোড়াছুড়ির’ শিরোনাম তো আছেই।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, বিএফডিসি পরিচালিত হয় একটি পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমে। পরিচালনা পর্ষদে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা পোহাতে হয়। এফডিসির ২০১১-১২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৫৭ সালের আইন অনুযায়ী আট সদস্যের এ পর্ষদে তিনজন পরিচালক সংস্থার শেয়ারহোল্ডারদের মধ্য থেকে নির্বাচিত হওয়ার কথা। তবে এফডিসি যাত্রা শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত এর শেয়ার ছাড়া হয়নি এবং নির্বাচিত পরিচালকও নেই।

আরও পড়ুন

‘আমরা আগের সেই রমরমা দেখতে চাই’

বিএফডিসি চলচ্চিত্র প্রযোজনাতেও পিছিয়ে পড়ে। ১৯৭৮ সালে নির্মিত আমজাদ হোসেনের ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ ছিল বিএফডিসি প্রযোজিত প্রথম চলচ্চিত্র। ১১টি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া ছবিটির পর আরও বেশ কয়েকটি সিনেমা প্রযোজনা করে সরকারি প্রতিষ্ঠানটি। ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য প্রযোজনায় সরকারি অনুদান পাওয়ার মধ্য দিয়ে বিএফডিসি প্রায় ৩৫ বছর পর আবারও দুটি চলচ্চিত্র প্রযোজনা শুরু করে।

২০১৭ সাল থেকে বিএফডিসি ও ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের (এনএফডিসি) যৌথ প্রযোজনায় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বাজেটের চলচ্চিত্র নির্মাণের একটি চুক্তি হয়েছে। এর আওতায় ৭০ কোটি রুপি বা ৮৩ কোটি টাকা ব্যয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী নিয়ে ‘মুজিব—একটি জাতির রূপকার’ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন ভারতের চলচ্চিত্র পরিচালক শ্যাম বেনেগাল।

২০২০ সালের ১৪ জানুয়ারি ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশের পক্ষে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ এবং ভারতের তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী প্রকাশ জাভেদকর চুক্তিতে সই করেন। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে মুম্বাইয়ের দাদাসাহেব ফিল্ম সিটিতে চলচ্চিত্রটির দৃশ্যধারণ শুরু হয়েছিল। মুম্বাই ফিল্ম সিটিতে ৫৪ দিন শুটিং হয়েছে। বাংলাদেশে শুটিং হয়েছে ২৮ দিন, এর মধ্যে এফডিসিতে শুটিং হয়েছে চার দিন।

‘মুজিব—একটি জাতির রূপকার’ চলচ্চিত্রটির পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ হচ্ছে ভারতে। ৭৫তম কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে চলচ্চিত্রটির ট্রেলার উদ্বোধন করা হয়। এখন মুক্তির অপেক্ষায় আছে।

কর্মচাঞ্চল্য নেই। ফলে ব্যবহার নেই খাতার।
ছবি: মানসুরা হোসাইন

চলতি বছরের মে মাসে কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের ৭৬তম আসরের ‘ছবির বাজারে’ স্টল নিশ্চিত করেছিল বিএফডিসি কর্তৃপক্ষ। নানা অব্যবস্থাপনায় উৎসবের শেষ দিন পর্যন্ত ওই স্টল ফাঁকাই ছিল; কর্মীরা কেউ সেখানে পৌঁছাতেই পারেননি।
এফডিসির সহযোগিতায় এ পর্যন্ত তিন হাজারের বেশি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে।

একপাশে লোগোসহ বাংলায় ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন’ ও অন্য পাশে ইংরেজিতে ‘বাংলাদেশ ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন’ লেখা গেটটি এখন বিএফডিসি কমপ্লেক্স নির্মাণকাজের জন্য প্রায় ভেঙে ফেলা হয়েছে। এ গেটের সামনেই একসময় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বহু উৎসুক মানুষ অপেক্ষায় থাকতেন।

চলতি বছরের মে মাসে কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের ৭৬তম আসরের ‘ছবির বাজারে’ স্টল নিশ্চিত করেছিল বিএফডিসি কর্তৃপক্ষ। নানা অব্যবস্থাপনায় উৎসবের শেষ দিন পর্যন্ত ওই স্টল ফাঁকাই ছিল; কর্মীরা কেউ সেখানে পৌঁছাতেই পারেননি।

তাঁরা অপেক্ষায় থাকতেন তাঁদের প্রিয় নায়ক বা নায়িকা, খলনায়ক বা অন্য অভিনেতা–অভিনেত্রীকে যাওয়া–আসার পথে একনজর দেখার জন্য। এখন সেই গেটের সামনে খাঁ খাঁ করে। পরিস্থিতি এমন যে কেউ কেউ সেখানে প্রস্রাবও করেন। এ প্রতিবেদক দুই দিন এমন দৃশ্য দেখেছেন।

আগের সেই উৎসুক মানুষের ভিড়ের সাক্ষী ইদ্রিস আলী। তিনি এফডিসির গেটের কাছেই দীর্ঘদিন ধরে অটোমোবাইলের ব্যবসা করেন। তিনি প্রথম আলোকে বললেন, ‘এফডিসির গেট দিয়ে কত নায়ক–নায়িকাকে ঢুকতে আর বের হতে দেখেছি, তার হিসাব নেই। এখন তো গেটই নেই; খাঁ খাঁ করে! আবার আমরা আগের সেই রমরমা অবস্থা দেখতে চাই।’

বহু বছর সিনেমা হলে গিয়ে চলচ্চিত্র দেখেন না উল্লেখ করে ইদ্রিস আলী বললেন, ‘এখন সিনেমায় গল্প নেই, সেই নায়ক–নায়িকা নেই। সিনেমা দেখলে আগের মতো চোখে পানিও আসে না।’