এফডিসি ধুঁকছে কেন

সিনেমার নির্মাণ কমে যাওয়ায় আয় তলানিতে নেমেছে; আর্থিক সংকটের কারণে ব্যয়ভার মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে এফডিসিছবি: খালেদ সরকার
একসময় লাভজনক প্রতিষ্ঠান ছিল বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি)। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানটি এখন নিজস্ব অর্থায়নে কর্মীদের বেতন–ভাতাও দিতে পারে না। কেন এমন হলো?

‘এফডিসির এখন মাসে আয় ৩০ লাখ টাকা। তার বিপরীতে কর্মীদের প্রতি মাসে বেতনই দিতে হয় ৯৮ লাখ টাকা। এফডিসির তহবিলে পর্যাপ্ত অর্থ না থাকায় নিয়মিত বেতন পরিশোধ করা যায় না। এমনকি অবসরে যাওয়া কর্মীদের যথাযথ পাওনাও বকেয়া রয়েছে।’ সপ্তাহ দুয়েক আগে নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন এফডিসির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
নিয়মিত বেতনের জন্য এখন সরকারি অনুদানের দিকে তাকিয়ে থাকেন এফডিসির ৩২৩ কর্মী। মাঝে তিন মাসের বেতন বকেয়া ছিল; কয়েক দফা দাবি উত্থাপনের পর ঈদের আগে জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চের বকেয়া বেতন হাতে পেয়েছেন কর্মীরা। তবে সামনে নিয়মিত পাবেন কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েই গেছে।
আগেও কয়েক দফা সময়মতো কর্মীদের বেতন পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছে এফডিসি। প্রতিষ্ঠানটির দাবি, সিনেমার নির্মাণ কমে যাওয়ায় আয় তলানিতে নেমেছে; আর্থিক সংকটের কারণে ব্যয়ভার মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, ২০১২ সালে জাজ মাল্টিমিডিয়ার হাত ধরে ঢালিউডে ডিজিটাল সিনেমার যাত্রা শুরু। এরপর ডিজিটাল সিনেমা নির্মাণের হিড়িক পড়ে যায়, অ্যানালগ (৩৫ মিমি ফরম্যাট) সিনেমা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে থাকেন নির্মাতা, প্রযোজকেরা। অ্যানালগ প্রযুক্তির এফডিসিতে কাজের সংখ্যা দ্রুত কমতে থাকে।

এই সংকটের সূচনা কবে
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ২০১২ সালে জাজ মাল্টিমিডিয়ার হাত ধরে ঢালিউডে ডিজিটাল সিনেমার যাত্রা শুরু। এরপর ডিজিটাল সিনেমা নির্মাণের হিড়িক পড়ে যায়, অ্যানালগ (৩৫ মিমি ফরম্যাট) সিনেমা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে থাকেন নির্মাতা, প্রযোজকেরা। অ্যানালগ প্রযুক্তির এফডিসিতে কাজের সংখ্যা দ্রুত কমতে থাকে।

সুনসান এফডিসি
ছবি: খালেদ সরকার

পাশের দেশ ভারতে ২০০৬ সালে ডিজিটাল সিনেমা নির্মাণ শুরু হয়েছে। তার পর থেকে বাংলাদেশেও আলোচনায় ছিল ডিজিটাল সিনেমা। এফডিসিকে ডিজিটাল করতে ২০১১ সালেই বিএফডিসি সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়নে ৫৯ কোটি ১৮ লাখ টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয় সরকার। তবে কর্তৃপক্ষের অদূরদর্শিতার কারণে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে এফডিসি। তিন বছর পর ২০১৪ সালে এফডিসিতে প্রথম ডিজিটাল ক্যামেরা আসে। তত দিনে ডিজিটাল সিনেমার বাজার দখলে নেয় জাজ মাল্টিমিডিয়া।
তারপরও ২০১৬ সাল পর্যন্ত ডিজিটাল সিনেমার প্রতিযোগিতায় টিকে ছিল এফডিসি। ডিজিটাল সিনেমা থেকে আয়রোজগারও ভালোই ছিল। তখনো নিজেদের আয়ে কর্মীদের বেতন–ভাতা পরিশোধ করতে পেরেছে এফডিসি। তবে ২০১৬ সালের পর মুখ থুবড়ে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি। তার পর থেকেই নিজেদের আয়ে ব্যয় নির্বাহের সক্ষমতা হারিয়ে সরকারি অনুদানে চলছে এফডিসি। অথচ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেদের আয়েই এফডিসির ব্যয় নির্বাহের বিধি রয়েছে।

‘ডিজিটাল যন্ত্রপাতি কেনার প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে অনেক বিলম্ব করেছে এফডিসি। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েছে। ফলে অনেক প্রযোজককে আর এফডিসিতে ফেরানো যায়নি।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন এফডিসির এক অবসরপ্রাপ্ত

প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়ল কেন
নাম প্রকাশ না করার শর্তে গত ১১ এপ্রিল এফডিসির এক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন, ‘ডিজিটাল যন্ত্রপাতি কেনার প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে অনেক বিলম্ব করেছে এফডিসি। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েছে। ফলে অনেক প্রযোজককে আর এফডিসিতে ফেরানো যায়নি।’
যন্ত্রপাতি কিনতে বিলম্বের কারণ হিসেবে এফডিসির সম্পাদনাপ্রধান মামুনূর রশীদ ১১ এপ্রিল মুঠোফোনে জানান, সরকারি প্রতিষ্ঠানে কোনো কেনাকাটা করতে একটি প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। তা করতে গিয়ে বিলম্ব হওয়াটা স্বাভাবিক। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো সরকারি প্রতিষ্ঠান দ্রুত কাজ করতে পারে না।

শুধু এফডিসিতে নয়, গত কয়েক বছরে ঢাকায় সিনেমা নির্মাণই অনেকটা কমে এসেছে। তবে তারপরও সরকারি অনুদান ও বেসকারি প্রযোজনায়ও বছরে অর্ধশতাধিক সিনেমা নির্মিত হচ্ছে। এর মধ্যে কয়েকটি সিনেমার জন্য এফডিসি থেকে ক্যামেরা নেওয়া হয়। সিনেমার পাশাপাশি বিজ্ঞাপন ও রিয়েলিটি শোর দৃশ্য ধারণ করা হয়। তবে বেশির ভাগ কাজই এখন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দখলে চলে গেছে।

এফডিসির প্রশাসনিক ভবন
ছবি: খালেদ সরকার

‘সরকারি প্রতিষ্ঠান পারে না’

বলা হচ্ছে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অত্যাধুনিক ডিজিটাল যন্ত্রপাতির সুবিধা পাওয়ার কারণেই প্রযোজকেরা সেদিকে ঝুঁকছেন। এফডিসির সম্পাদনাপ্রধান মামুনূর রশীদ বলছেন, ‘৯ বছরে এফডিসির কেনা ক্যামেরার চেয়ে আরও ভালো রেজল্যুশনের আধুনিক ক্যামেরা বের হয়েছে। এরপর আর ক্যামেরা কেনা হয়নি। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি কিনতে পারে। সরকারি প্রতিষ্ঠান পারে না।’
এফডিসিতে সিনেমার দৃশ্যধারণ এখন আগের তুলনায় চার ভাগের এক ভাগে নেমেছে। অথচ সত্তর থেকে নব্বইয়ের দশক কিংবা শূন্য দশকেও রমরমা ছিল এফডিসি। এফডিসির কোনো প্রতিযোগী ছিল না। চিত্রধারণ, সম্পাদনা থেকে রেকর্ডিং—সব কাজেই একচেটিয়া ছিল এফডিসি।

১১ এপ্রিল এফডিসির অবসরপ্রাপ্ত ল্যাবপ্রধান শেখ মহিউদ্দিন আহমেদ জানান, তখন এফডিসির বাইরে সিনেমার কোনো কাজ হতো না। সেই সময়ে এফডিসি প্রচুর লাভ করেছে, সেই লাভের ওপর সরকারকে আয়করও দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘প্রযোজকেরা সাড়ে ৪ লাখ টাকা জমা দিয়ে ৫০ হাজার ফুট নেগেটিভ পেতেন। সেই নেগেটিভ শুট করে এফডিসিতেই জমা দিতেন। রাশপ্রিন্ট দেখে দেখে ডাবিং করা হতো। ডাবিং, রেকর্ডিং—সবই এফডিসিতে হতো। সিনেমা মুক্তির আগে সব বিল পরিশোধ করতেন প্রযোজকেরা।’

ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুজহাত ইয়াসমিন জানান, এফডিসির আর্থিক সংকট নিরসনের চেষ্টা চলছে। বর্তমানে এফডিসির একটি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন, অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে আরও দুটি প্রকল্প। সেগুলো সম্পন্ন হলে এফডিসির আয় বাড়বে।

এফডিসির আয় বাড়বে কি
বিষয়টি নিয়ে ১১ এপ্রিল এফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুজহাত ইয়াসমিন জানান, এফডিসির আর্থিক সংকট নিরসনের চেষ্টা চলছে। বর্তমানে এফডিসির একটি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন, অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে আরও দুটি প্রকল্প। সেগুলো সম্পন্ন হলে এফডিসির আয় বাড়বে।

এফডিসিতে সিনেমার দৃশ্যধারণ কমে এসেছে
ছবি: খালেদ সরকার
আরও পড়ুন


১৭ তলাবিশিষ্ট বিএফডিসি কমপ্লেক্স নির্মাণে ৩২২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। বছর দুয়েকের মধ্যেই কাজটি শেষ হবে। এটি নির্মিত হলে এফডিসির আর্থিক সংকটও কাটতে পারে বলে মনে করছেন এফডিসির সম্পাদনাপ্রধান মামুনূর রশীদ। কীভাবে? ‘এই ভবনে সিনেপ্লেক্স, হোটেল, কনভেনশন হল থেকে গাড়ির পার্কিংয়ের ব্যবস্থা—সবই থাকবে। এসব ভাড়া দিয়ে এফডিসি আয় করতে পারবে।’

আরও পড়ুন

অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকা প্রকল্পের একটি হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ফিল্ম সিটি (পর্যায়-২)। এটি একনেকে অনুমোদন পেলে পূর্ণাঙ্গ রূপ পাবে বঙ্গবন্ধু ফিল্ম সিটি। প্রকল্পের আওতায় গাজীপুরে শুটিং স্পট ও ফ্লোর নির্মাণ, পোস্টপ্রোডাকশন স্টুডিও স্থাপন করা হবে। আরেক প্রকল্পের অনুমোদন মিললে অত্যাধুনিক ক্যামেরাসহ দৃশ্যধারণের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনা হবে, সঙ্গে চট্টগ্রামে মাল্টিপ্লেক্সও নির্মাণ করা হবে।
তিন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা গেলে এফডিসির বিপুল আয়ের সংস্থান হতে পারে বলে মনে করছেন এফডিসির কর্মকর্তারা।

আরও পড়ুন