কাঁদছিলেন ‘আজ রবিবার’ নাটকের সেই ফুলি
শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার একটি মহড়াকক্ষে ঢুকতেই চোখে পড়ে ব্যস্ততা। ঘড়িতে রাত আটটার বেশি। নাট্যশালার বাইরে করিডরের চারপাশ প্রায় নিস্তব্ধ, কিন্তু কক্ষের ভেতরে সম্পূর্ণ উল্টো চিত্র। কান্নার শব্দ আর সংলাপে ভরে আছে পরিবেশ। এখানে পুরোদমে ঢাকা থিয়েটারের নতুন একটি মঞ্চনাটকের মহড়া চলছে।
সুপরিসর মহড়াকক্ষের মাঝখানে প্রথমেই নজরে আসে এক কান্নারত নারী। চিনতে কিছুটা সময় লাগে, এভাবে তাঁকে আগে কখনো দেখা হয়নি। বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয় ধারাবাহিক ‘আজ রবিবার’ নাটকের গৃহকর্মী ফুলির চরিত্রে অভিনয় করছেন তিনি, নাসরিন নাহার। কাছাকাছি বসে তাঁর অভিনীত দৃশ্যটি গভীর মনোযোগে পর্যবেক্ষণ করছেন সেই ধারাবাহিকেরই মতি মিয়া চরিত্রের অভিনেতা ফারুক আহমেদ। তবে এবার তিনি অভিনয়শিল্পীর সারিতে নন। ক্যারিয়ারে এই প্রথম মঞ্চনাটকের নির্দেশকের ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে তাঁকে। তাঁর নির্দেশিত ‘রঙমহাল’ নাটকের মহড়ায় কিছু সময়ের জন্য উপস্থিত আমরা।
নতুন একজন ফারুক আহমেদকে পেলাম মহড়াকক্ষে, একেবারে ভিন্ন মেজাজে। যাঁকে এত দিন ক্যামেরার সামনে কিংবা মঞ্চে অভিনয়ে অভ্যস্ত দেখা গেছে, এবার তিনি শিল্পীদের অভিনয়ের সূক্ষ্ম দিকগুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। তাঁকে ব্যস্ত দেখে মহড়ার সময় কথা বলার চেষ্টা করিনি। তাঁর পাশেই বসে আছেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ। তিনিও মনোযোগ দিয়ে সবার অভিনয় দেখছেন।
একপর্যায়ে মঞ্চে যাত্রাপালার একটি অংশের মহড়া শুরু হয়। যাত্রার নায়িকার প্রেমে পড়া এক ধনীর দুলালের প্রবেশের দৃশ্য। আগের মিউজিক তখনো শেষ হয়নি। এর মধ্যেই একটি চরিত্র মঞ্চে ঢুকে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে পাশ থেকে এক নারীকণ্ঠ ধমক দিয়ে বলেন, ‘আগে মিউজিক শেষ হতে দাও। তারপর এন্ট্রি।’ ভুল ধরিয়ে দেওয়া সেই কণ্ঠ শিমুল ইউসুফের। বুঝলাম, নাটকের সংগীত পরিকল্পনার দায়িত্ব তাঁরই।
আজ ১৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যা সাতটায় মহিলা সমিতি মিলনায়তনে নাটকটির প্রথম মঞ্চায়ন হবে।
মহড়ার ফাঁকে ফাঁকে ফারুক আহমেদ একের পর এক ভুল ধরিয়ে দিচ্ছেন। প্রতিটি দৃশ্য শেষে কোন প্রপস কোথায় যাবে, দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন হচ্ছে কি না, সবকিছুতেই তাঁর কড়া নজর। সংলাপে বাড়তি একটি শব্দ এলেও তা নিরুৎসাহিত করছেন। কেউ সংলাপ ভুলে গেলে সঙ্গে সঙ্গে ধরিয়ে দিচ্ছেন। বোঝা যায়, নাটকটি তাঁর নখদর্পণে। ছোটখাটো ভুল ছাড়া মহড়া এগিয়ে চলে সাবলীলভাবে। আশির দশকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র অবস্থায় মঞ্চনাটক নির্মাণ করেছিলেন ফারুক আহমেদ। আন্তবিশ্ববিদ্যালয় প্রতিযোগিতায় প্রথমও হয়েছিলেন। পরে ঢাকা থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বহু নাটকে অভিনয় করেছেন। তবে নির্দেশকের অভিজ্ঞতা এবারই প্রথম।
নতুন এ অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ঢাকা থিয়েটারের হয়ে নির্দেশনা দিচ্ছি। ১৯৮৩ সাল থেকে মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত। মাঝখানে কাজ না করলেও দলে ছিলাম। দল থেকেই আমাকে নাটকটির নির্দেশনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এটা আমার জন্য অনেক সম্মানের, আবার চ্যালেঞ্জেরও।’
ফারুক আহমেদ জানান, ‘রঙমহাল’ ঢাকা থিয়েটারের ৫৪তম প্রযোজনা। দীর্ঘদিন ধরেই নতুন এ নাটক নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটছে তাঁর। অভিনয়শিল্পী হওয়ার কারণে বিশেষভাবে নজর দিচ্ছেন শিল্পীদের অভিনয়ে।
ফারুক আহমেদ বলেন, ‘এই নাটকে অর্ধেকের বেশি নতুন ছেলেমেয়ে। কেউ হয়তো অভিনয়ের ওপর কিছু ওয়ার্কশপ করেছে, কেউ মাত্র শিখছে। আবার অভিজ্ঞ শিল্পীও আছেন দু-একজন। সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে এই গল্পে দাঁড় করানোই বড় চ্যালেঞ্জ। তবে তারা খুব মেধাবী। তাদের নিয়ে আমি খুশি। নানাভাবে চেষ্টা করছি ভালো একটি নাটক মঞ্চে আনার। আমার বিশ্বাস, দর্শক নাটকটি ভালোভাবে গ্রহণ করবে।’
টেলিভিশন নাটকে নিয়মিত না হলেও মঞ্চে নাসরিন নাহার দীর্ঘদিনের পরিচিত মুখ। ব্যক্তিজীবনে তিনি ফারুক আহমেদের স্ত্রী। তাঁরা একসঙ্গে অভিনয় করে আলোচনায় আসেন ‘আজ রবিবার’ নাটকে। এবার দীর্ঘদিন পর আবার একসঙ্গে মঞ্চে কাজ করছেন। নাসরিন নাহার প্রথম আলোকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন পর আমরা একসঙ্গে মঞ্চে কাজ করছি। সে আমাকে চেয়েছে বলেই এই নাটকে একসঙ্গে হওয়া। গল্পটাও আমার খুব ভালো লেগেছে।’
নতুন অভিজ্ঞতার কথাও জানান নাসরিন নাহার। ‘এর আগে যেসব নাটকে কাজ করেছি, তার বেশির ভাগই সেলিম আলদীনের লেখা, সিরিয়াস গল্প। এখানে তুলনামূলক সহজ-সরল গল্পে কাজ করছি, যেটা সবাই বুঝতে পারবে। এতে একধরনের চাপও আছে। অনেক নতুন ছেলেমেয়ে রয়েছে। তাদের সঙ্গে বন্ডিং ভালো রাখা, মনোযোগ দিয়ে কাজ করা—সব মিলিয়ে চ্যালেঞ্জ। নাটকের ছন্দটা যেন ঠিকভাবে দাঁড় করাতে পারি, সেই চেষ্টাই করছি।’ ‘রঙমহাল’ নাটকটি লিখেছেন রুবাইয়াৎ আহমেদ। নাসরিন নাহার ছাড়াও অভিনয় করছেন মিলু চৌধুরী, ফারজানা চুমকি, বদরুজ্জামান বাদল, মোস্তফা রতন, হাবিবা আজিজ, অনিক ইসলামসহ অনেকে। আজ ১৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যা সাতটায় মহিলা সমিতি মিলনায়তনে নাটকটির প্রথম মঞ্চায়ন হবে।