এ নাটক আসলে প্রেমের

‘বিবিধ শোক অথবা সুখ’ নাটকের দৃশ্য। ছবি : দলের সৌজন্যে

অনুস্বরের নতুন নাটকের নাম একটু জটপাকানো ‘বিবিধ শোক অথবা সুখ’। শোক আর সুখ কি হাত-ধরাধরি করে চলে? অথবা-র মতো একটি অনন্বয়ী অব্যয় কি এত ব্যয়বহুল হতে পারে? নাম শুনেই বুঝেছিলাম যে ইচ্ছে করেই জট পাকিয়েছেন নাট্যকার-নির্দেশক সাইফ সুমন। আধুনিক জীবন তো রংমিলান্তি খেলা নয় আদতে। যতই সহজ আরও সহজ হওয়ার নিদান দিন দ্রষ্টাকুল, যতই সহজ পাঠের গল্প ফাঁদা হোক, আজকালকের মানুষকে যে কত রকমের প্যাঁচ পয়জার কষে হরদম চলতে হয়, সে আমরাই জানি। সম্পর্কের মধ্যেও রকমারি চোরাবালি আছে। তাতে ঢুকে পড়ে রাজনীতি। নর-নারীর সম্পর্কে উঁকিঝুঁকি দেয় ঝকমারি সব সমীকরণ।

আরও পড়ুন

এই উপাত্ত নিয়ে বছর পাঁচেক আগে “রাত ভ’রে বৃষ্টি” (আপস্টেজ) নামিয়েছিলেন সুমন। সেবার আধার ছিল বুদ্ধদেব বসুর স্বনামধন্য উপন্যাস। এবার ডেভিড হেয়ারের ব্রিটিশ নাটক ‘ভার্টিক্যাল আওয়ার’। আবদুস সেলিম এই নাটকের বঙ্গীকরণ করেছিলেন ‘প্রলম্বিত প্রহর’ নামে, কিছুকাল আগে যার প্রযোজনা করেছিলেন নাট্যম রেপার্টরি, আইরিন পারভীন লোপার নির্দেশনায়। সাইফ সুমনের ‘বিবিধ শোক অথবা সুখ’ ওই আধারের ঘনীভূত রূপ। নিবিড় গাঢ় ও অতলান্ত।

রাজধানীর সেগুনবাগিচা চত্বরে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি থেকে ঢিলছোড়া দূরত্বে একটি নাতিপ্রাচীন দালানের তেতলায় অনুস্বর স্টুডিওতে ঘণ্টাখানেক মেয়াদের বিবিধ শোক অথবা সুখ দেখতে বসে মনে হচ্ছিল দ্রুত প্রাপ্তমনস্ক হচ্ছে ঢাকার থিয়েটার। মেধাবী মানুষের খোরাক জোগাতে পারে। সাবেক ধাঁচের প্রসেনিয়াম স্টেজে তার একরকম প্রকাশ, ২৫-৩০ জনের ইন্টিমেট স্পেসে আরেক রকম। তা একদিকে ম্যাকিয়াভেলি-ফ্রয়েড-ফুকোর মাধুকরী নিয়ে হেলেন ফিশারের শরণাগত হতে পারে, অন্যদিকে অন্তরে-বাহিরে ধারণ করতে পারে রবীন্দ্রসংগীতকে। বস্তুত এত রাবীন্দ্রিক নাটক অনেক দিন দেখিনি। এত ব্যক্তিগত? মনে পড়ে না শেষ কবে! সবিনয় বলি, ‘আঁধারের গায়ে গায়ে পরশ তব/ সারা রাত ফোটাক তারা নব নব’—এই অনুভবের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে বিবিধ শোক অথবা সুখ।

‘বিবিধ শোক অথবা সুখ’ নাটকের দৃশ্য। ছবি : দলের সৌজন্যে

অনুস্বরের স্টুডিও স্পেসে ঢুকে আবছায়ায় মুড়ে রাখা একটি ড্রয়িংরুমে মেঝের ওপরে নকশিকাঁথা জড়ানো আসবাব; বুকশেলফে দাঁড় করানো অ্যারিস্টটলের ‘পলিটিকস, মার্কাস অরেলিউসের ‘মেডিটেশনস’, ম্যাকিয়াভেলির ‘প্রিন্স’ কিংবা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ন্যাশনালিজম’ কিংবা শতেক বছরের প্রাচীন ফোনোগ্রামের মিনিয়েচার মডেল, শোলার তৈরি একটি পালতোলা নৌকা যে মেধাবিশ্বের ইশারা দিচ্ছিল। খানিক বাদে আবহে ভেসে এল ‘সে দিন আমায় বলেছিলে আমার সময় হয় নাই’, নারীকণ্ঠে। অচলা এবার সচলা হলেন। দেখতে পেলাম নাদিরা বশিরকে (ফৌজিয়া করিম অনু)। কলবেল বাজল। দর্শকদের মধ্য দিয়ে কেটে রাখা পথে দরজা খুলে দিতে ঘরে ঢুকলেন দারা (এস আর সম্পদ)। মিনিট দুয়েকের মধ্যে আমাদের বোঝা হয়ে গেল যে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এক অধ্যাপিকার কাছে এসেছেন এক তরুণ শিক্ষার্থী। উদ্দেশ্য যদিও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে একটি অ্যাসাইনমেন্ট পেপার খতিয়ে দেখার পর এক ‘বালক’-এর প্রতি এক স্বয়ংসিদ্ধার চাট্টি কেতাবি সলাপরামর্শ প্রদান, এ নাটকের বিধেয় আসলে বহুবিধ। এই বিবিধতার মধ্যে সুষমের খোঁজ আসলে এই তর্কসংকুল ও সংলাপমুখর নাটকের তুরুপের তাস।

কথার পিঠে কথা। সাজানো কাঠামোর মধ্যে ফেলা হলেও কোনোটিই অপ্রত্যাশিত নয়। বাবার হুকুম তামিল করতে ভার্সিটিতে পড়তে আসা তরুণ ভেতরে-ভেতরে বিদ্রোহ পুষে রাখবেন, প্রেমে পড়বেন অধ্যাপিকার, তালেগোলে কবুল করবেন—এর মধ্যে নতুন কী আছে? আছে ওই কথোপকথনের মধ্যে ডুবে থাকা অন্তর্লীন ইঙ্গিতে। সাম্রাজ্যবাদের দবদবা নিয়ে আলোচনার মধ্যে ঘাপটি মেরে সেই ইঙ্গিতে ইশারায় বয়ান হয় বড় ক্ষমতা আর ছোট ক্ষমতার চিরকালীন টানাপোড়েন। সেই টানাপোড়েনে পররাষ্ট্রনীতির খেই ধরে একে-একে জুড়ে যায় নিহিলিজম, ইড-ইগো-সুপারইগো, ডোপামিন ডিসচার্জ আরও কত কী!

যত এগোয় তত বুঝি এ নাটক আসলে প্রেমের। ভাবনাতরঙ্গে যতিচিহ্নের মতো ইউসুফ হাসান অর্ক-র আবহ পরিকল্পনায় মাউথ অর্গানে বাজে ‘ও যে মানে না মানা’, নায়িকা গেয়ে ওঠেন ‘সখী, ভাবনা কাহারে বলে’। ‘আমার পরান যাহা চায়’-এর সেই অভিমানী আর্তি ধরে শ্যামা-উত্তীয়ের অসম প্রেমের ধারাপাত হয় মনে। তাতে সংগত করে চলে অম্লান বিশ্বাসের ওস্তাদিতে তৈরি হয়ে চলা আলোর নকশা। কখনো তা চেতনাপ্রবাহের মতো স্টুডিওর দেয়ালে আলপনা কাটে, কখনো তা জাফরি-কাটা নকশার মধ্য দিয়ে মনের চোরাগলিকে আলোকিত করে।

ঘণ্টাখানেকের এই নাটক যে মাথার ওপর চেপে বসে না, তার কারণ নির্দেশক সাইফ সুমন অবকাশের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে জানেন। অতটুকু পরিসরের মধ্যেই কুশীলবদের চলেফিরে বেড়াতে দিতে পারেন। আর দুই মুখ্য নট—অনু ও সম্পদ—নিচু চাবির মেথড অ্যাক্টিংয়ের বর্ণমালা জানেন। তিলোত্তমাশিল্পের আর সব অঙ্গ যেন ওই দুজনের অভিনয়ের পাশে এসে দাঁড়ায়। অনুর আপাতশান্ত পাষাণমূর্তির মধ্যে যে আগ্নেয়গিরি আছে, সম্পদ পেরেছেন, তাতে অগ্নিশলাকা যোজনা করতে। অন্তরঙ্গে অসংখ্য অগ্ন্যুৎপাত দেখতে চান তো ‘বিবিধ শোক অথবা সু-এর ডাকে আপনাকে সাড়া দিতেই হবে।

অংশুমান ভৌমিক: পশ্চিমবঙ্গের নাট্যসমালোচক