এ আর রাহমানের গিটারিস্ট নীলাঞ্জনা বললেন, আমি বাংলাদেশেরই মেয়ে

কলকাতার বেজ গিটারিস্ট নীলাঞ্জনা ঘোষ দস্তিদার। কলকাতায় জন্ম হলেও মা-বাবার সূত্রে তাঁর শিকড় বাংলাদেশে। বর্তমানে বেজ গিটার বাজান অস্কারজয়ী সুরকার এ আর রাহমানের সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলেছেন নাজমুল হক

প্রথম আলো:

বেজ গিটারের প্রতি আগ্রহ জন্মাল কীভাবে?

নীলাঞ্জনা ঘোষ দস্তিদার : আমার বাবা বেজ গিটার বাজাতেন। তাই এই ইনস্ট্রুমেন্টের সঙ্গে আমার শৈশব থেকেই পরিচয়। প্রতিটা জিনিস বাবা আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শেখাতেন। আর যখন গান করতাম, অন্য বাদ্যযন্ত্রের থেকে আমার কানে বেজের আওয়াজটাই যেন বেশি আসত। ২০১৮ সালের শুরুতে বাবাকে বেজ শেখার ইচ্ছার কথা জানাই। তবে তখন বাবা এটা খুব ইতিবাচকভাবে নেননি। এটা অনেক ভারী, তারগুলো অনেক মোটা, আমি পারব না; আমার জন্য কষ্ট হবে...এসব বলতে লাগলেন। এরপর তাঁকে রাজি করালাম। বাসায় একটা বেজ গিটার পড়ে ছিল, এটা দিয়েই শুরু করি। আমার মনে আছে, প্রথম এক সপ্তাহে আমার আঙুল দিয়ে রক্ত বের হয়েছিল। তখন মনে হয়েছিল, কষ্ট তো এই! আর তো কিছু নয়। এরপর আমার জন্য একজন ওস্তাদ রাখা হলো। উনিই আমাকে সবকিছুর তালিম দিলেন। তাঁর নাম ছিল তারক। তিনি এখন প্রয়াত।

প্রথম আলো :

এ আর রাহমানে টিমে যুক্ত হওয়ার গল্প শুনতে চাই

নীলাঞ্জনা ঘোষ দস্তিদার : বিভিন্ন গান কভার করে ফেসবুকে ভিডিও আপলোড করতাম। তখন বেশ সাড়া পাচ্ছিলাম। এ আর রাহমানের ড্রামার রঞ্জিত বারতের একজন ছাত্রের সঙ্গে তখন আমার পরিচয় হয়। ২০২১–এর ডিসেম্বরে তাঁর মাধ্যমেই রঞ্জিত আঙ্কেল আমাকে প্রস্তাব দেন। আমার আগ্রহ আছে কি না, জানতে চান। এটা শুনে আমি যেন আকাশ থেকে পড়ি! সে সময় রাহমান স্যারের দিল্লি ও দুবাইতে দুটি শো করার কথা ছিল। পরে তাঁর টিম থেকে যখন আমার উত্তর জানতে চেয়ে বার্তা পাঠানো হয়, তখন আমি বাক্‌রুদ্ধ হয়ে যাই। বারবার মনে হচ্ছিল, ভুয়া না তো! এরপর রঞ্জিত আঙ্কেল আমাকে আবার কল করেন। একটা গানের তালিকা দিয়ে সেগুলো তৈরি রাখতে বলেন। আমি তখন তাঁকে বললাম, ‘এটা কি সত্যি?’ তিনি আমাকে বলেন, ‘সত্যি। তুমি প্র্যাকটিস শুরু করো।’

নীলাঞ্জনা ঘোষ দস্তিদার। শিল্পীর সৌজন্যে
প্রথম আলো:

প্রথম দিনের স্মৃতি কি মনে পড়ে?

নীলাঞ্জনা ঘোষ দস্তিদার : আসলে প্রথম দিন প্রচণ্ড নার্ভাস ছিলাম। এটাই স্বাভাবিক নয়? নতুন জায়গা, সিনিয়র ও গুণী মানুষদের সঙ্গে দেখা। কিন্তু সেখানে গিয়ে অবাক হয়েছি, সবাই এত আন্তরিক! আমাকে একবারের জন্যও মনে করতে দেননি আমি নতুন। মনে হচ্ছিল, যেন আমি তাঁদের অনেক চেনা। অনুষ্ঠানের আরেক দিন প্র্যাকটিস করছিলাম সবাই। ৪০টির মতো গানে সেদিন বাজিয়েছিলাম। প্রচণ্ড ক্লান্ত লাগছিল, চেয়ারে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। এমন সময় দেখি, স্যার আমার দিকে আসছেন। আমাকে অভিনন্দন জানান, আশীর্বাদ করেন। তারপর বলেন, ‘ওয়েলকাম টু দ্য টিম।’

এ আর রাহমানের সঙ্গে নীলাঞ্জনা ঘোষ দস্তিদার। শিল্পীর সৌজন্যে

প্রথম আলো :

এ আর রাহমানের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা কেমন?

নীলাঞ্জনা ঘোষ দস্তিদার : স্যারকে প্রথম দিন যেমন দেখেছিলাম, সর্বশেষ শোতেও তেমনই দেখেছি। তিনি প্রচণ্ড নিবেদিতপ্রাণ আর বিনয়ী একজন মানুষ। মনেই হয় না তিনি এ আর রাহমান, মনে হয় যেন পাশের বাড়ির কাকু। সব সময় উনি জানতে চান, প্রশ্ন করেন সবাইকে। এখনকার প্রজন্মের কাজগুলোও দেখেন, বিশ্লেষণ করেন। এই প্রজন্ম কী চায়, তা বোঝার চেষ্টা করেন। তিনি একটা প্রতিষ্ঠান।

প্রথম আলো:

জীবনে কোনো বড় পরিবর্তন এল?

নীলাঞ্জনা ঘোষ দস্তিদার : মানুষের শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা প্রচুর পাই। তবে সত্যি বলতে, আমার জীবনের খুব বেশি পরিবর্তন আসেনি। আমিই আসতে দিইনি। মনে হয়, বদলে গেলে কাজ থেকে মনোযোগ হারিয়ে ফেলব; সেই ভয় কাজ করে। আমি এখনো রাস্তায় আগের মতো হাঁটি, ট্যাক্সিতে চড়ি, আমার দিন আগের মতোই আছে।

এ আর রাহমানের সঙ্গে নীলাঞ্জনা ঘোষ দস্তিদার। শিল্পীর সৌজন্যে
প্রথম আলো:

আপনার পরিবার তো বাংলাদেশের, বাংলাদেশ–যোগ সম্পর্কে জানতে চাই

নীলাঞ্জনা ঘোষ দস্তিদার : আসলে আমি বাংলাদেশেরই মেয়ে। আমার বাবা–মা দুজনের পরিবারই সেখানের। তাঁদের শিকড় ঢাকা ও বরিশালে। আমার শাশুড়ির মায়ের বাড়িও কুমিল্লা। তাই আমার কাছে বাংলাদেশে জায়গাটা অন্য রকম। একটি কনসার্টে অংশ নিতে বাংলাদেশে এসেছিলাম। মনে হচ্ছিল যেন আমি খুব চেনা একটা জায়গায় আছি। সেবার বাড়ি ফিরে মাকে যখন এখানের গল্পগুলো বললাম, মায়ের সে কী কান্না। কেন তাঁকে নিয়ে যাইনি, তা নিয়ে অনেক অভিমান করেছিলেন সেদিন।

নীলাঞ্জনা ঘোষ দস্তিদার। শিল্পীর সৌজন্যে
প্রথম আলো:

বাংলাদেশের কোনো সংগীতশিল্পীর সঙ্গে পরিচয় হয়েছে?

নীলাঞ্জনা ঘোষ দস্তিদার : ফেসবুকের কল্যাণে বাংলাদেশের অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। সবচেয়ে ভালো পরিচয় ফুয়াদ আল মোক্তাদিরের সঙ্গে। তিনি বলতে গেলে আমার ভাইয়ের মতো। অনেক কথা হয় আমাদের। অনেক কিছু নিয়ে আমরা আলোচনা-বিশ্লেষণ করি। তাঁর একটা প্রজেক্টে কাজও হয়েছে আমার।

আরও পড়ুন

প্রথম আলো :

বাংলাদেশের কার গান শোনা হয়

নীলাঞ্জনা ঘোষ দস্তিদার : ছোটবেলা থেকেই বাংলাদেশের গান শুনে বড় হয়েছি। বাবা মাইলসের গান প্রচুর শুনতেন। শৈশব থেকেই এই ব্যান্ডের গানের সঙ্গে আমার সখ্য। শাফিন আহমেদ বেজ বাজিয়ে গান গাইতেন, তা দেখে অবাক হতাম। বেজ বাজিয়ে গান! আমি জানি, তা কতটা কঠিন। এতটাই কঠিন, যা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। ঢাকার শোতে আমাদের আগে মাইলস পারফর্ম করেছিল। তবে দুর্ভাগ্য আমার, দেখা হয়নি তাদের সঙ্গে।

প্রথম আলো:

শাড়ি পরে বেজ গিটার বাজানো...

নীলাঞ্জনা ঘোষ দস্তিদার : আসলে এটা আমার কমফোর্ট জোন। আর অবশ্যই বাঙালিয়ানা। আমি যদি পশ্চিমা পোশাক পরে বাজাতে পারি, তবে শাড়ি কেন নয়? আমি প্রচুর শাড়ি কিনি, বাসায় সেগুলো জমে যায়, আর মা তা নিয়ে চেঁচামেচি করেন। তাই সেগুলো পরে শেষ করি (হাসি)। পূজার সময় শাড়ি পরে একটা গান কভার করে ফেসবুকে ভিডিও আপলোড করেছিলাম। এরপর সেখানে অনেকের মন্তব্য পাই। ভালো–খারাপ মিলিয়ে পাওয়া সেসব মন্তব্যে মঞ্চে শাড়ি পরার আগ্রহ জন্মায়। ব্যক্তিগতভাবে আমার মতে, শাড়ি তো আমাদের বাঙালি নারীদের একটা প্রতীক। তাই আমি একটা বার্তা দিতে চাই, আমরা মেয়েরা ঘর যেমন সামলাতে পারি, স্টেজও সামলাতে পারি। এভাবেই শুরু। দেশের বাইরে বিভিন্ন শোতে মানুষ শাড়ি দেখে অবাক হন। তা নিয়ে জানতে চান। আমারও তা ভালো লাগে।