জীবনের চেয়ে বড় কোনো সিনেমা নেই

সেন্সর বোর্ডে প্রায় দুই বছর আটকে থাকার পর আজ প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাচ্ছে ‘অন্যদিন...’। গতকাল চলচ্চিত্রটি নিয়ে নির্মাতা কামার আহমাদ সাইমনের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো

প্রথম আলো :

‘অন্যদিন…’ সিনেমার পটভূমিটা একটু জানতে চাই।

কামার আহমাদ সাইমন: শুনতে কি পাও! শেষ করেই অন্যদিন… ছবির চিন্তাটা এসেছিল। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাঝি বা অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম–এর মতো উপন্যাসগুলো আমরা ছোটবেলায় পড়ে বড় হয়েছি, উপন্যাসের সেই চরিত্রগুলোকে সিনেমার পর্দায় আনার চেষ্টা ছিল। কিন্তু শুনতে কি পাও! শেষ করে মনে হচ্ছিল, জনপদের যে গল্পটা বলতে চাচ্ছিলাম, সেটা ঠিক বলা হলো না। সে থেকেই একটা জলত্রয়ী বা ওয়াটার ট্রিলজির কথা ভাবতে শুরু করি। অন্যদিন… সেই জলত্রয়ীর দ্বিতীয় পর্ব।

আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

ছবিটা দেখে দর্শকের মনে হবে, ছবিতে কোনো চরিত্র নেই, যাত্রাপথে যাকে যেখানে পেরেছেন ক্যামেরায় ধরেছেন।

কামার আহমাদ সাইমন: প্রায় সাত বছরের চেষ্টায় ছবিটা বানানো হয়েছে, হঠাৎ করে এখানে প্রায় কিছুই ঘটেনি। একই চরিত্রের শুটিং কোথাও টানা পাঁচ-ছয় দিন হয়েছে, আবার কোনো চরিত্র ছয় মাস ধরে শুধু গ্রুমিং করা হয়েছে। একদম শেষে যে ক্রিটিক্যাল সিকোয়েন্সটা আছে (দর্শক দেখলেই বুঝতে পারবেন), সেটা অনেক দিনের পরিকল্পনা ও টেকনিক্যাল ডিজাইনে করা হয়েছে। চ্যালেঞ্জ ছিল, দর্শকদের কীভাবে বিশ্বাস করাব—এটা সত্যিই ঘটছে। চ্যালেঞ্জটা আমি নিয়েছি।

প্রথম আলো:

এ ধরনের সিনেমা নির্মাণ তো চ্যালেঞ্জিং?

কামার আহমাদ সাইমন: একজীবনে এ ধরনের কাজ দ্বিতীয়বার করা যায় না। চরিত্র বাছাই, সেট ব্যবস্থাপনা, ক্যামেরা—প্রতিটি জায়গায়, প্রতিটি দিন মনে হয়েছে আর সম্ভব না। শুধু লাইভ সাউন্ডের কথা যদি ভাবেন, দেখবেন এই সেটে সেটা প্রায় অসম্ভব ছিল। কিন্তু যতবার আটকে গেছি, ততবার আবার নতুন করে শুরু করেছি। সবচেয়ে বড় বাধা এল দেশে ছবিটা মুক্তি দেওয়া নিয়ে, সেন্সর বোর্ডের আপত্তিতে হার মেনে নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, আর কোনো দিন ছবিই বানাব না। জুলাই এসে সব ওলটপালট করে দিল।

‘অন্যদিন…’ সিনেমার দৃশ্যে
নির্মাতার সৌজন্যে
প্রথম আলো:

সিনেমায় আওয়ামী লীগ সরকার আমলে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, নির্বাচনী পরিবেশ, রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ঝুঁকিটা কেন নিয়েছিলেন?

কামার আহমাদ সাইমন: অন্যদিন… একটা রূপক ছবি, ভেসে বেড়ানো একটা দেশের গল্প। নির্মাতা হিসেবে সময়টাকে শুধু ফ্রেম করেছিলাম। ভূমিকম্প আগে টের পায় কাক। কবিদের সময়ের অসময়কে তুলে ধরার কথা ছিল। কিন্তু আমরা একটা অদ্ভুত কালচারে ঢুকে গিয়েছিলাম, শিল্পী-সাহিত্যিক আর নির্মাতাদের একমাত্র কাজ যেন ছিল, রাজার গুণগান গাওয়া আর ফরমায়েশ খাটা। ব্যাপারটা খুব আঁতে লেগেছিল, কোটি কোটি ভূমিপুত্রের বিপরীতে দাঁড়িয়েছিল অতি ক্ষুদ্র একটা ‘নাগরিক সমাজ’ বা পলিটিক্যাল এলিট। সেই সুবিধাবাদী সমাজের একজন প্রতিনিধি হিসেবে খুব লজ্জা লাগছিল।

আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

শেষ পর্যন্ত ছবিটা সেন্সর বোর্ডে আটকে ছিল। কী কী দৃশ্য কর্তন করতে বলেছিল বোর্ড?

কামার আহমাদ সাইমন: ২০০ ঘণ্টার ফুটেজ থেকে এডিট করে ছবিতে মাত্র দুই ঘণ্টা রাখা হয়েছে, এখানে প্রতিটি শট আমি প্রয়োজনীয় মনে করেছি বলেই রেখেছি। আমার তরফ থেকে এখানে কাটার মতো কোনো শট ছিল না। তা ছাড়া সেন্সর বোর্ডও নির্দিষ্ট কোনো দৃশ্য কাটতে বলেনি, প্রায় পুরা ছবি নিয়েই সরকার বিরোধিতার ঢালাও অভিযোগ করেছিল; দুই পাতার একটা ‘প্রেমপত্র’ দিয়েছিল। সেটা মেনে নিলে প্রায় পুরো ছবিই ফেলে দিতে হতো। দর্শকেরা ছবিটা দেখলেই বুঝবেন, আমি সরকার নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলিনি। অন্যদিন… একটা পলিটিক্যাল স্যাটায়ার, গোটা সিস্টেমের একটা মেটাফোরিক্যাল ক্রিটিক।

প্রথম আলো:

আওয়ামী সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের সার্টিফিকেশন বোর্ড ছবিটিকে ছাড়পত্র দিয়েছে। আটকে থাকা ছবির মুক্তির অভিজ্ঞতা কেমন?

কামার আহমাদ সাইমন: একটা ছবি আটকে দেওয়া মানে কিন্তু একজন নির্মাতাকেই গায়েব করে দেওয়া। সেই অর্থে অভিজ্ঞতাটা অনেকটা গুমঘর থেকে মুক্তি পাওয়ার মতো। অন্যদিন… মুক্তির আশা আমি প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম। পরের ছবি শিকলবাহার প্রিমিয়ারও করলাম ২০২৪ সালের জুনে সাংহাই চলচ্চিত্র উৎসবের গোল্ডেন গবলেট কম্পিটিশনে। নভেম্বর নাগাদ দেশে মুক্তি দেওয়ার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু এর আগেই জুলাই চলে এল।

আরও পড়ুন
‘অন্যদিন…’ সিনেমার পোস্টার
নির্মাতার সৌজন্যে
প্রথম আলো:

কোন ভাবনা থেকে ছবিটি জুলাইকে উৎসর্গ করলেন?

কামার আহমাদ সাইমন: জুলাই একটা অনেক বড় ঘটনা, এর প্রভাব আগামী কয়েক দশকের সমাজ ও রাজনীতিতে থাকবে। ২০২৪ সালের জুলাইয়ের ঘটনায় অনেকেই অন্যদিন…–কে প্রফেটিক হিসেবে দেখেছেন। হয়তো সে কারণেই জুলাইয়ের আগে নিষেধাজ্ঞা ছিল, আবার জুলাই এল বলেই ছাড়পত্র পেল—এসব ভাবনা থেকেই অন্যদিন… জুলাইকে উৎসর্গ করা। যদিও প্রতিকূল আবহাওয়া এবং বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা কোনোটাই ছবি মুক্তির জন্য ভালো সময় নয়। তবু ভাবলাম, জুলাইয়ের আগে যেই ছবি প্রায় গুম হয়ে গিয়েছিল, সেই ছবি জুলাইতেই মুক্তি দেওয়া উচিত। সেই চিন্তা থেকে সীমান্ত স্কয়ারের স্টার সিনেপ্লেক্সে, মাত্র সাত দিনের জন্য মুক্তি পাচ্ছে অন্যদিন...।

জুরিখ চলচ্চিত্র উৎসবে ‘অন্যদিন…’ নির্মাতা কামার আহমাদ সাইমন ও প্রযোজক সারা আফরীন
নির্মাতার সৌজন্যে
প্রথম আলো:

পরের সিনেমার কাজ কত দূর এগিয়েছে?

কামার আহমাদ সাইমন: জলত্রয়ীর তৃতীয় ছবি আরও কিছু জীবন–এর কাজ হয়তো আগামী বছর শুরু করব। কিন্তু এর আগে শিকলবাহা মুক্তি দিতে হবে। আমার চলচ্চিত্রযাত্রার প্রথম চিত্রনাট্য শিকলবাহা, অথচ সেটাই এখনো মুক্তি দিতে পারিনি। আসলে পরিকল্পনা করে তেমন কিছু হয় না, যেই কাজটা সবচেয়ে বেশি জোর দিয়ে করতে চাই, সেটাতেই বাধা বেশি আসে। আবার অনেক কাজ তেমন একটা ভেবে শুরু করিনি, কিন্তু হয়ে গেছে—যেমন নীল মুকুট। তাই একটা কথা প্রায়ই মনে হয়, জীবনের চেয়ে আসলে বড় কোনো সিনেমা নেই।