কেমন আছেন?
নওশাবা: আমি ও আমার মেয়ে কয়েক দিন ধরে অসুস্থ। এখন কিছুটা ভালো। আজ (মঙ্গলবার) রাতে আমাকে রংপুর যেতে হবে, ওখানে আগুনির মহড়া হবে।
প্রথম আলো :
প্রদর্শনী তো ঢাকায়, তাহলে মহড়া ওখানে কেন?
নওশাবা: আমরা তো সারা দেশের জুলাই আন্দোলনে আহত যোদ্ধাদের নিয়ে নাটকটা করছি। ঢাকার বাইরের যারা, তাদের ট্রাভেল করে ঢাকায় আসা কষ্টসাধ্য। তারা সবাই একবারে শোর সময় আসবে। আবার ঢাকায় যারা আহত, তাদের রংপুরে যাওয়া কষ্টসাধ্য। আমি ২০১৮ সাল থেকে বাক্, শ্রবণপ্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করছি। এভাবে সারা বাংলাদেশে আমাদের ছোট ছোট দল তৈরি হয়েছে। রংপুরে যে দলটা আছে, তারা ভীষণ সাপোর্টিভ। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, জুলাই আন্দোলনের একটা বড় অংশ কিন্তু ওখানেই হয়েছে, আবু সাঈদের মৃত্যুর পর এই স্ফুলিঙ্গটা ছড়িয়ে পড়ে। আমি ওখানে অনেক বেশি জুলাই যোদ্ধার সাড়া পেয়েছি।
তার মানে ‘আগুনি’তে বিভিন্ন জেলা ও থানার জুলাই যোদ্ধা আছেন?
নওশাবা: একদম তাই। ঢাকার মিরপুর, যাত্রাবাড়ীর যোদ্ধারা যেমন আছে; তেমনি নোয়াখালী, রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, বগুড়া ও রাজশাহীরও। ৫০ জনের মতো জুলাই যোদ্ধা এই নাটকে কাজ করছে।
প্রথম আলো :
৫০ জনকে আলাদা মহড়ায় তৈরি করছেন?
নওশাবা: ৩১ জনকে ঢাকার বাইরে, বাকিদের ঢাকায়।
প্রথম আলো :
তাঁরা আসতে পারছেন না, এটাই কি কারণ?
নওশাবা: আসতে না পারার একটা বিষয় তো আছে। তা ছাড়া ঢাকায় এনে আমি তাদের রাখব কোথায়? ফাইন্যান্সিয়াল ইস্যুও তো আছে। আমি পৃষ্ঠপোষক খুঁজেছি অনেক দিন।
এটা আপনার ব্যক্তিগত উদ্যোগ?
নওশাবা: প্রথমে ব্যক্তি উদ্যোগে শুরু করেছিলাম। ১১ মাস পর শিল্পকলা একাডেমি আমাকে বলেছে, যে উৎসব শুরু হবে, সে উৎসবে একটা নাটক হিসেবে আমারটাও থাকবে। কিন্তু আমার তো এটা শুধু একটা নাটক নয়, একটা থেরাপি, যেটাকে বলছি আর্টথেরাপি। ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় আটক ছিলাম। নিজে একটা বড় সমস্যার ভেতর দিয়ে গেছি, আর্টথেরাপি আামাকে শক্তি-সাহস দিয়েছে। এটা আগে দৃষ্টি ও বাক্প্রতিবন্ধীদের সঙ্গে নিয়ে করেছি। একই জিনিস জুলাই আন্দোলনে আহত ব্যক্তিদের সঙ্গেও চেষ্টা করেছি। এটার আউটকামই আমার এই থিয়েটার। এখানে থিয়েটার আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য নয়, মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে শারীরিক ও মানসিকভাবে আহত ব্যক্তিদের হিলিং। সবাই একসঙ্গে থাকা। এখানে মানসিক স্বাস্থ্য প্রধান ইস্যু। আমাকে সবচেয়ে বেশি ট্রিগার করে, যখন বিভিন্ন খবরে দেখছিলাম, জুলাই যোদ্ধারা অবসাদে কাঁদছে। কেউ কেউ বিভিন্ন ধরনের মানসিক অবসাদে পড়েছে। আমি তো এটার ভেতর দিয়ে গেছি, আমার তখন মনে হয়েছে, আমার তো একটাই হাতিয়ার, সেটা হচ্ছে আমার শিল্পমাধ্যম। সেটা নিয়ে তাদের জন্য চেষ্টা করে দেখি। সেই চেষ্টা আরকি।
প্রথম আলো :
‘আগুনি’তে অংশগ্রহণকারীরা মূলত কোন ধরনের আঘাতের?
নওশাবা: সবচেয়ে বেশি আছে চোখ হারিয়েছে যারা। এর বাইরে যাদের সারা মাথায়, হাতে, পায়ে স্প্লিন্টার আছে এবং যাদের অপারেশন হয়েছে, বলতে পারেন সব ধরনের জুলাই যোদ্ধা আছে।
কী চিন্তা থেকে এটা করেছেন?
নওশাবা: যে চিন্তা থেকে আগে কাজ করতাম, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী অথবা অটিস্টিক, ক্যানসার রোগীদের নিয়ে—এখানেও তা–ই। আমি মনে করি, তারা যদি একসঙ্গে কিছুটা সময় একটা গল্পের ভেতরে থাকে, একটা দলের সঙ্গে কবিতা আবৃত্তি করে, নৃত্যপাঠ করে, রবীন্দ্রনাথ–নজরুলের কবিতা পাঠ করে, তখন তাদের মানসিক অবসাদ দূরে চলে যায়, যেটা আমার নিজের হয়েছে। তাই আমি কিন্তু থিয়েটারটা শুরুই করেছি মূলত আমার নিজেকে ফিরে পাওয়ার জন্য। এটা একটা শক্তিশালী মাধ্যম। আমি সেই জায়গা থেকে তাদের এই জাদুমন্ত্রটার মধ্যে নিমন্ত্রণ করেছি।
প্রথম আলো :
কত দিন ধরে তাঁদের নিয়ে কাজ করছেন?
নওশাবা: রিসার্চ শুরু করেছি অনেক দিন, কাজ শুরু করেছি ঈদের পর।
এই যে আপনি তাঁদের সঙ্গে কাজ করছেন, তাঁরা মহড়া করছেন, তাঁদের মধ্যে কোনো ধরনের পরিবর্তন কি দেখতে পাচ্ছেন?
নওশাবা: আমার তো ভীষণ ভীষণ পজিটিভ মনে হয়। আমি এত দিন অপেক্ষা করছি তাদের আউটকামটা কেমন আসে দেখতে। খুব অভাবনীয় না হলেও বেশির ভাগই বলেন আগে রাতে ঘুমাতাম না, এখন ঘুমাই। ওরা এখন আর ওই অবসাদের কথা না বলে কবিতা আবৃত্তি করে আমাকে ভিডিও পাঠায়। একটা নির্দিষ্ট সময় তাদের ঘুম থেকে ওঠানো যেত না। এখন একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তারা আসে, খায়, গল্প করে, নিজেদের কথা বলে, নিজেরাই কাঁদে, আবার নিজেরাই হাসে। আমি একটা পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি।
প্রথম আলো :
এই পরিবর্তন দেখতে কেমন লাগছে?
নওশাবা: ব্যাপারটা হচ্ছে কি, ২০১৮ সালের পর তো অনেক ধরনের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমাকে যেতে হয়েছে। একজন নারীর পারিবারিক যুদ্ধ তো আছেই, এর বাইরে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং ক্যারিয়ারও ছিল। ওরাও একই ধরনের। সবচেয়ে বড় কথা, আমি তো হাত হারাইনি বা পা হারাইনি, ওরা তো আমার তুলনায় আরও বেশি হারিয়েছে। সেই জায়গা থেকে আগুনি এবং আহতদের, আহতদের পরিবারের সঙ্গে যে সময়টা কেটেছে আর গবেষণার সময়টা আমার জন্য অসাধারণ অভিজ্ঞতা। এটুকু বলতে পারি, আমার জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে। যখন প্রথম শুরু করেছিলাম, তখন আমার টিমের মাত্র তিনজন সঙ্গে ছিল। সবাই প্রথমে বলছে, সম্ভব নয়, তুই অনুমতি পাবি না। আমি যখন চলা শুরু করেছি, তখন দেখেছি, আমার সঙ্গে অলমোস্ট ৫০-এর বেশি মানুষ আছে।
প্রথম আলো :
প্রোডাকশনটা কত মিনিটের?
নওশাবা: ১ ঘণ্টা ১০ মিনিটের।
আগেও তো আপনার পাপেট থিয়েটার মঞ্চে এসেছে...
নওশাবা: আমি আগেও মিউজিক্যাল পাপেট থিয়েটার করেছি এবং সব সময় ডিজঅ্যাবলড পারসনদের নিয়ে করেছি। এবার প্রথম জুলাই যোদ্ধাকে নিয়ে করছি। এটা আমার পঞ্চম প্রোডাকশন।
প্রথম আলো :
এটা দিয়ে আপনি মানুষকে কী বার্তা দিতে চান?
নওশাবা: সিম্পল, আমার খুব বেশি কিছু বলার নেই। খুবই সাধারণ একজন শিল্পীর জায়গা থেকে কাজটা করছি। আমার মনে হয়, শিল্পের যে শক্তি অথবা সংস্কৃতির যে শক্তি এবং আমাদের বাংলা সংস্কৃতির যে শক্তি, আমরাই পারি ঐক্যবদ্ধতা আনতে। জুলাই মানে কিন্তু ঐক্য ছিল। আমি আরেকটা জিনিস বারবার উল্লেখ করতে চাই, আমার এই গল্পটা কিন্তু শুধু জুলাইকে কেন্দ্র করে নয়। গল্পটা আমরা বেছেছি এবং এমনভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করছি, বাঙালির যে যোদ্ধা মনোভাব, তারা যে বারবার ঘুরে দাঁড়ায় সেটাকে ট্রিবিউট করা, শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানো এবং সেটা মানে শুধুই জুলাই ন্যারেটিভ নয় কিন্তু।