কমেডি ঘরানা থেকে সরে এসে আপনাকে রোমান্টিক আর গল্পনির্ভর নাটকে বেশি মনোযোগ দিতে দেখা যাচ্ছে...
আরশ খান : আমার ক্যারিয়ারের শুরুর কাজগুলো যদি দেখেন, গল্পনির্ভর কাজ দিয়েই শুরু করেছিলাম। পরবর্তী সময়ে যেটা হলো, একদমই নতুন থাকার কারণে তখন আমার সিদ্ধান্ত বলে কিছুই ছিল না। সচ্ছলতার জন্য কাজের ক্ষেত্রে আমার হাতে অপশন থাকত দুটি—হয় আমি সেটা করব বা করব না। কিন্তু এ রকম না করে ওরকম করতে চাই, সিদ্ধান্তের জায়গাটা বা সেই জোরটা ওই মুহূর্তে ছিল না। যে কারণে জীবনের একটা লম্বা সময় আমাকে এমন অনেক কাজ করে যেতে হয়েছে, যে কাজগুলো করার পর পর্দায় নিজেকে দেখে নিজেরই মন খারাপ হয়ে যেত। কারণ, আমি কখনোই নিজেকে ওভাবে দেখতে চাইনি। পরবর্তী সময়ে আমার কিছু দর্শক তৈরি হলো। তত দিনে নিজেও বুঝে যাই কোন ধরনের প্রজেক্ট করলে আমার দর্শক দেখবেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা ইউটিউবের মন্তব্যের ঘরে দর্শকেরা মন্তব্য করতে লাগলেন, ‘আরও নাটক চাই, আপনাকে দেখতে চাই’—তখন আমি বুঝলাম যে ঠিক আছে, এখন হয়তো আমার আইডিয়া শেয়ারিংয়ের জায়গাটা তৈরি হয়েছে। বড় ভাইদের সঙ্গে বসে তাঁদের অনুরোধ করলাম, বুঝিয়ে বললাম আমি আসলে এ ধরনের কাজ করতে চাই। আমিও খুবই ভাগ্যবান, তাঁরাও সাধুবাদ জানিয়েছেন। তাঁরা যদি এটা না করতেন, একা এই পরিবর্তনটা হতো না।
প্রথম আলো :
কোন চরিত্র ধারণের আগে আপনার মনস্তাত্ত্বিক প্রস্তুতি কেমন হয়?
আরশ খান : শৈশব থেকে এখন পর্যন্ত জীবনের নানা অভিজ্ঞতা আমাদের মস্তিষ্কে ছোট ছোট স্মৃতি হিসেবে জমা থাকে। আমরা হয়তো তা সব সময় ভাবি না, কিন্তু কোনো শব্দ কানে এলে বা কোথাও পড়লে মস্তিষ্কে এর ছবি তৈরি হয়। যেমন আমি যদি বলি, ‘চকলেট আইসক্রিম’, আপনি সঙ্গে সঙ্গে একটা ইমেজ দেখেন মনে। ঠিক তেমনি, কোনো চরিত্রের নাম শুনলেই আমাদের মস্তিষ্ক সেই চরিত্রের একটা অবয়ব কল্পনা করে—হয়তো সে আমার কোনো বন্ধু, কিংবা গতকাল দেখা কোনো রিকশাওয়ালা। প্রথম ইমেজটা তৈরি হওয়ার পর আমরা বাস্তবে আশপাশে সে ধরনের মানুষ খুঁজতে শুরু করি, তাদের চালচলন পর্যবেক্ষণ করি। তবে নাটকে অল্প সময়ের মধ্যে সেই চরিত্র পুরোপুরি ধারণ করা কঠিন। সবাই পারে না। কিছু সিনিয়র অভিনেতা—যেমন মোশাররফ করিম, চঞ্চল চৌধুরী, আফরান নিশো ভাই—চরিত্রে দারুণভাবে ডুবে যান, নানা রকম রূপে নিজেদের উপস্থাপন করেন। তাঁরাই সত্যিকারের ভার্সেটাইল অভিনেতা। আমি এখনো সে পর্যায়ে পৌঁছাতে পারিনি। চেষ্টা করি, খুঁজি—কখনো সফল হই, কখনো ব্যর্থ। কিন্তু প্রতিবারই নতুন চরিত্র খুঁজে বের করার এই প্রক্রিয়াটাই আমাকে এগিয়ে যেতে শেখায়।
দেশ-বিদেশে অন্যদের কাজগুলো যখন দেখেন, নতুন কিছু শিখতে বা ভাবতে তা কতটা অনুপ্রাণিত করে?
আরশ খান : যখন বাইরের কোনো কাজ দেখি, তখন আসলে আমি শুধুই বিনোদন নিই। বিনোদন নিতে গিয়ে যে কাজগুলো দেখি, ওগুলো মাঝেমধ্যে আমার জীবনে কাজে লেগে যায়। আবার দেশের কোনো কাজ যখন দেখি, তখন খুব আবেগের জায়গা থেকে দেখি। ভালো লাগে। একটা সিনেমার টিকিট কেটেছি মানে দেশের দর্শক হিসেবে একটা দায়িত্ব পালন করেছি। যখন ভালো কিছু দেখি, আমি অনুপ্রাণিত হই। মনে হয় যে আমি আরও জোর দেব। আমিও এ রকম একটা প্রজেক্ট করব বলে নিজের মধ্যে তাড়না অনুভব করি।
প্রথম আলো :
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ব্যবহার নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনা হচ্ছে। ভবিষ্যতে এটি কি অভিনেতাদের সৃজনশীলতাকে চ্যালেঞ্জ করবে বলে মনে করেন?
আরশ খান : আমার হিসেবে তো এআই একটা সময় মানবজাতির জন্য ভয়ংকর হবে। কারণ, এটা মূলত মানুষের কাজ কেড়ে নিচ্ছে। আগে যে কাজ এক হাজার মানুষ মিলে দীর্ঘ সময় ধরে করতেন, এখন একা একজন এআই ব্যবহার করে কয়েক মিনিটেই সেটা করে ফেলছেন। এতে কাজের গতি বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হারিয়ে যাচ্ছে—এটা কেউ ভাবছে না। যদি কোনো প্রজেক্টে মিউজিকটা এআই দিয়ে করি, তাহলে এত বছর ধরে যে সংগীতশিল্পীর সঙ্গে কাজ করতাম, তিনি কী করবেন? তাঁর যোগ্যতা তো কমে যায়নি। অনেকেই বলেন, এআই কাজ দ্রুত ও সাশ্রয়ী করে; কিন্তু কাল যদি সেই এআই-ই আমাকে রিপ্লেস (সরিয়ে দেয়) করে, আমরা কি সেটা মেনে নেব? যদি পৃথিবীতে সবাইকে নিখুঁত পুতুলের মতো বানানো যায়, দেখতে হয়তো সুন্দর লাগবে, কিন্তু তা মানুষ থাকবে না। তবে শেষ পর্যন্ত আমি প্রযুক্তির পক্ষে। সে আমার হিসেবে এআই আমাদের সহায়ক হতে পারে, বিকল্প নয়।
এআইয়ের ওপর নির্ভর না হয়ে সহযোগিতার কথা বলছেন?
আরশ খান : কিন্তু আমরা তো নির্ভর হয়ে যাচ্ছি। আমরা এআইকে বলি, ‘এআই, আমাকে একটা স্ক্রিপ্ট দাও।’ কিছু কিছু প্রোডাকশন হাউসে গিয়ে দেখবেন, তাদের কাছে দেড় হাজার গল্প আছে। সে এআই থেকে দেড় হাজার গল্প নামিয়ে রেখেছে, পরিচালকদের সেই গল্পটাই দিয়ে দেয়। আমাদেরও সেই গল্পটাই দিয়ে বলে, ‘দেখো তো এখানে ১০টা–২০টা গল্প আছে, কোনটা করবে?’ যে লেখক ২০-২৫ বছর ধরে ইন্ডাস্ট্রিতে সংগ্রাম করছেন, দিনের পর দিন নিজের ব্যক্তিজীবন সবকিছু বিসর্জন দিয়ে লিখে যাচ্ছেন, তাঁর পরিবারের দায়িত্ব কি আপনি নেবেন? আজকে এআই দিয়ে যদি একটা চরিত্র বানানো হয়, সেই চরিত্রটা নিশ্চিত শাহরুখ খানের থেকেও সুন্দর হবে। ওর শক্তি শাহরুখের চেয়ে বেশি হবে। ও একাই জাম্প দিয়ে ১০০ তলা ছাদ থেকে নিচে পড়ে দাঁড়িয়ে যাবে। আদৌ এটা কি ঠিক?
প্রথম আলো :
সম্প্রতি কালচারাল জার্নালিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ (সিজেএফবি) অ্যাওয়ার্ডে সমালোচক ক্যাটাগরিতে রাইসুল তমাল পরিচালিত ‘শীতল মেঘের প্রেম’ নাটকে অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছেন। মায়ের হাত থেকে পুরস্কার নিলেন, আবেগঘন পরিবেশ তৈরি হয়েছিল...
আরশ খান : এই ছোট ক্যারিয়ারেই অনেক ধাক্কা খেয়েছি। হয়তো আমারই কোনো কমতি ছিল, তাই প্রত্যাশিত গ্রহণযোগ্যতা পাইনি। তবে ধীরে ধীরে এখন কিছুটা পাচ্ছি। কোনো কাজের স্বীকৃতি পাওয়া সত্যিই ভালো লাগে। বিশেষ করে যখন দেখলাম, মা আমার পাশে আছেন—ওটা এক অন্য রকম অনুভূতি। পরিবারের সামনে কেউ আপনার প্রশংসা করলে, মনে হয় জীবনটা ঠিক পথে এগোচ্ছে। পুরস্কার গ্রহণের মুহূর্তে মায়ের উপস্থিতি অনেক আপ্লুত করেছে, সেই অনুভূতি ভাষায় বোঝানো যায় না। আমার সুখ-দুঃখের সাক্ষী তিনিই। কারণ, আমরা একসঙ্গেই থাকি। আমার যে রকম হাসিটা মা দেখেন, আমার কষ্টটাও মা অনুভব করেন। এ জন্য ওই দিন কেঁদে দিয়েছিলেন। আমি জানি, একটা অ্যাওয়ার্ড ভাগ্য বদলায় না, কাউকে দেশের সেরা বানায় না। যাঁদের সঙ্গে মনোনয়ন ছিল, তাঁরা সবাই যোগ্য, অনেকেই আমার চেয়ে বেশি। ওই দিনটা হয়তোবা আমার ছিল, এ জন্য অ্যাওয়ার্ডটা আমি পেয়েছি। কিন্তু এরপরও স্বীকৃতি, এই সম্মান—এটা ভালো লাগে।