মানুষ কী বলবে, এ–ই ভেবে আমরা নিজের ইচ্ছাগুলো পূরণ করতে পারি না: স্বস্তিকা মুখার্জি

প্রায় দেড় দশক পর ঢাকায় এসেছেন ভারতীয় অভিনেত্রী স্বস্তিকা মুখার্জি। গত বুধবার ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে দর্শকের সঙ্গে ‘বিজয়ার পরে’ সিনেমা দেখেছেন তিনি। তাঁর দেখা পেতে ভিড় করেছেন ঢাকার অনুরাগীরা। উপহার পাওয়া ফুল, চকলেট আর সুখস্মৃতি নিয়ে গত শুক্রবার দুপুরের ফ্লাইটে উড়াল দিয়েছেন তিনি। শুক্রবার সকালে ঢাকার হোটেল ইন্টারকনটিনেন্টালে প্রথম আলোকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে সিনেমা ও জীবন নিয়ে অকপট স্বস্তিকা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মকফুল হোসেন

স্বস্তিকা মুখার্জি
ছবি: ইনস্টাগ্রাম
প্রথম আলো:

ঢাকায় আপনার এত অনুরাগীদের খবর জানতেন?

জানতাম। এখানকার কেউ কলকাতায় গেলে তারা একধরনের চিত্র জানিয়েছে। অনেকের সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ায় কথা বলি। পরিচিত ব্যক্তিদের কাছ থেকেও খবর পেতাম। কিন্তু এখানে এসে যে উন্মাদনা, ভালোবাসা দেখলাম, তা একদমই প্রত্যাশা করিনি। অনেকে দূরদূরান্ত থেকে এসেছে, কেউ কেউ ৬০ কিলোমিটার দূর থেকেও এসেছে। আমাকে দেওয়ার জন্য বহু মানুষ উপহার নিয়ে এসেছে। কেউ শাড়ি নিয়ে এসেছে, কেউ নিজের হাতে আঁকা ছবি নিয়ে এসেছে; কেউ গয়না, ফুলের তোড়া নিয়ে এসেছে। আমি ভেবেছিলাম, এত দিন ধরে কাজ করছি, বছরের পর বছর আমাকে দেখছে আর কত দেখতে চাইবে। নতুন নতুন অভিনেত্রীরা এসেছে। মানুষের ভালোলাগা হয়তো কমে গেছে। এবার ঢাকার ট্রিপটা আমার ধারণাটা একদম পাল্টে দিয়েছে।

স্বস্তিকা মুখার্জি
ছবি: নেটফ্লিক্স
প্রথম আলো:

অভিনয়ের পাশাপাশি নারী অধিকার নিয়ে আপনার বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর আপনাকে আলাদা করেছে। আপনি মানেন?

এটা ঠিক। আমার অভিনয়সত্ত্বা যথেষ্ট পাওয়ারফুল। অনেক বছর ধরে নারীকেন্দ্রিক ছবি করছি। নারীকেন্দ্রিক ছবি না হলেও আমিই আমার ছবির হিরো হই। নানা ধরনের চরিত্র নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করি। ছবিতে বড় মাপের শিল্পীরা থাকলেও আমার চরিত্রটা তাঁদের মতো কিংবা তাঁদের চেয়ে বেশি বলিষ্ঠ হয়। আমার কাজ মানুষ ভালোবাসে। কিন্তু শুধু কাজ নিয়েই কথা বললে তো হবে না। মারা যাওয়ার পর বলার মতো আরও অনেক কিছু তো থাকতে হবে। ধরুন, আর ১০ কিংবা ২০ বছর কাজ করব, তারপরও তো মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, আমি খুব অসাধারণ কথা বলি না। আমি সব সময় রেভল্যুশনারি স্টেটমেন্ট দিই না। কিন্তু আমি হয়তো এমন কথা বলি, যেটা বাকি ৯ জন বলছে না। সবাই কথা বললে আমার কথাগুলো অসাধারণ লাগবে না। সমস্যা হচ্ছে, ১০ জনের মধ্যে আমি একাই কথা বলি। আমাদের চেহারা, শরীর, মন, মনন, দুঃখ, যন্ত্রণা, মানসিক স্বাস্থ্য সব সময় লুকিয়ে হবে, কেউ জানলে যদি আমাকে জাজ করে, ট্রল হয়—এই ভয়ে লুকোতে লুকোতে আমরা কোনটা আসল, সেটাই ভুলতে বসেছি। আমার জীবনের অভিজ্ঞতা, সম্পর্ক, সম্পর্কের ভাঙাগড়া, বিষণ্নতা—এগুলো আমার জীবনের অংশ। এগুলোকে মেনে নেওয়ার সাহস করতে হবে। মানুষ খারাপ কথা বললে, মিডিয়া চারটে ফলাও করে হেডলাইন লিখলেও আমি কথা বলি। কারণ, এতে অনেক সাধারণ নারী সাহস পাবেন। আমার হাত মোটা বলে আমি একসময় স্লিভলেস ব্লাউজ পরতাম না, এটা নিয়ে আমি খুব উদ্বিগ্ন ছিলাম। পরে ভাবলাম, মায়েদেরও তো হাত মোটা ছিল, তাঁরা তো স্লিভলেস ব্লাউজ পরত। অন্যরা কী বলবে, আমার হাত মোটা ছবি উঠবে—এসব ভেবে আমরা ভয়ে থাকি। ভাবলাম, অন্যদের এত সাহস জোগানোর চেষ্টা করে আমি নিজেই কেন ভয় পাচ্ছি। তারপর আমি হাতাকাটা ব্লাউজ পরে বের হই। চারটা লোক সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখে, ‘আমার হাত মোটা লাগছে’। সেখানে আরও ৪০ জন নারী লেখে, ‘আমার এত ইচ্ছা ছিল, হাত মোটা বলে হাতাকাটা ব্লাউজ পরতে সাহস পাচ্ছিলাম না।’ মানুষ কে কী বলবে, এই ভেবে আমরা নিজের ইচ্ছাগুলো পূরণ করতে পারি না। আমার একটাই জীবন, পরের জীবনে কী হবো, জানি না। যেভাবে বাঁচতে ইচ্ছা করছে, সেভাবেই বাঁচব। এই বাঁচা নিয়ে চারটা লোক কথা বলবে, কিন্তু আরও চৌদ্দটা লোক অনুপ্রাণিত হবে, সাহস পাবে। তারা আমাকে মনে রাখবে।

স্বস্তিকা মুখার্জি
ছবি: শিল্পীর সৌজন্যে
প্রথম আলো:

নিজেকে প্রকাশের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কতটা ভূমিকা রাখছে?

আগে মিডিয়া যেভাবে আমাকে উপস্থাপন করত, মানুষ তাই বিশ্বাস করত। মিডিয়ার বাইরে আমাকে জানার উপায়ও ছিল না। কারও সঙ্গে কফি খেতে গিয়েছি, মিডিয়া লিখছে, নতুন প্রেম করছি। প্রেম ভেঙেছে, তা নিয়ে কুৎসা রটিয়েছে। আমাদের বলার জায়গা ছিল না। সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেকে প্রকাশের জায়গা পেয়েছি। মিডিয়া চারটে বাজে কথা লিখলে, আসলটা কী, সেটা সোশ্যাল মিডিয়ায় বলা যায়। আমি যেমন, আমার সেই চেহারা যদি লোকের সামনে রাখি, তাহলে আমার ব্যক্তিত্বের প্রতি মানুষের বিশ্বাস ও আস্থা বেড়ে যায়। আমি কতগুলো ইমেজ নিয়ে বাঁচব? মিডিয়ায় একরকম, সিনেমায় একরকম, সোশ্যাল মিডিয়া–বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আরেক রকম। অনেক খাটনি বেড়ে যায়। আমি একা মানুষ, মা–বাবা নেই। মেয়ে বাইরে থাকে। কলকাতায় আমার সংসার আছে, বোম্বেতে সংসার আছে। একা হাতে সব সামলাতে হয়। বাড়তি তিন–চারটা মুখোশ পরে থাকার সময় নেই, অবকাশও নেই। আমি যেমন, তেমনটা থাকলেই ভালো।

‘তাসের ঘর’–এ সুজাতা চরিত্রে স্বস্তিকা
ছবি: হইচই
প্রথম আলো:

আপনি দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ব্যোমকেশ’-এ আবেদনময়ী, ‘দিল বেচারায়’ আবার মায়ের চরিত্রে। ‘তাসের ঘর’ থেকে ‘পাতাল লোক’—এ বৈচিত্র্যময় চরিত্রে দেখা দেখে আপনাকে। পর্দায় গ্ল্যামারহীন, ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ চরিত্রে অভিনয়ের আত্মবিশ্বাস কীভাবে পান?

আমি অভিনয় করতে ভালোবাসি। আমার খুব খিদে, আরও অনেক চরিত্র করতে চাই। ‘ব্যোমকেশ’–এ সুশান্ত সিং রাজপুতের সঙ্গে আমার রোমান্টিক সম্পর্ক ছিল। চার বছরের ব্যবধানে আবার ‘দিল বেচারা’ সিনেমায় সুশান্তের শাশুড়ির চরিত্র করেছি। ৩৮ বছর বয়সে আমি ‘মোহমায়া’ সিরিজে মায়ের চরিত্র করেছি, সিরিজে বড় ছেলের বয়স ছিল ২৮ বছর। আমি মেকআপ করিনি, পান চিবিয়েছি। শরীরের ভঙ্গিমা পাল্টিয়েছি, মা-মাসিরা যে রকম করে হাঁটতেন, কথা বলতেন, সেটা নিজের মধ্যে আনার চেষ্টা করেছি। ২০১৪ সালে ৩৩ বছর বয়সে ‘অনুব্রত ভালো আছো’ সিনেমায় ৬০ বছর বয়সী নারীর চরিত্র করেছি। আমার যেটুকু বয়স, সেটুকু চরিত্রই করলে শিখব কোথা থেকে? কাজের মধ্যেই আমাকে শিখতে হবে। আমার দক্ষতা মানুষকে তো দেখাতে হবে। (হাসি) আমি সব সময় বলি, আমাকে মা, বৌদি, দিদিমা, ঠাকুরমার চরিত্র দাও; আমার কিছু যায়-আসে না। ‘বিজয়ার পরে’ সিনেমায় হিরোইন মমতা শঙ্কর। এতে আমার দুই-তিনটা ছয় মারার জায়গা ছিল, সেই দুই–তিনটা জায়গার জন্যই আমি ছবিটা করেছি। মমতা শঙ্কর, দীপঙ্কর দে সিনিয়র শিল্পী, তাঁদের সঙ্গে কাজের সুযোগ পেয়েছি। তাঁদের সঙ্গে কাজ করার আকাঙ্ক্ষা ছিল আমার।

মন্দিরা বিশ্বাস চরিত্রে স্বস্তিকা মুখার্জি
ছবি: ইনস্টাগ্রাম
প্রথম আলো:

‘শিবপুর’ সিনেমায় মাফিয়া কুইন ‘মন্দিরা বিশ্বাস’ ভয়ংকর; শাড়ি পরে মারপিট করেছেন—বাংলা সিনেমায় এমন চরিত্র খুব একটা দেখা মেলে না।

নারী গ্যাংস্টার নিয়ে বাংলায় ছবি হয়নি। ছবি হলেও মেয়েরা চামড়ার প্যান্ট পরে মারপিট করছে। শাড়ি পরে মারপিট করা খুব চ্যালেঞ্জিং ছিল। আমি শাড়ি পরতে ভালোবাসি, শাড়ি পরে উত্তরাখন্ডে ট্রেকিংও করেছি। ভাবলাম, শাড়ি পরেই মারপিটের দৃশ্য করব। সিনেমাটির শুটিংয়ে রোজই আমি উত্তেজিত থাকতাম। আজকে মারপিটের দৃশ্য আছে, আজ রিভলবার চালাব। যার ওপর যত রাগ আছে, সেটা বের করে দেব। অভিনয়শিল্পী হিসেবে আমরা এক জীবনে বহু জীবন বাঁচি। এক জীবনে ১০০ সিনেমা করলে ১০০ জন নারীর জীবনে আমি বাঁচি। কত অভিজ্ঞতা হয়, এটা অনেক বড় প্রাপ্তি।

স্বস্তিকা মুখার্জি
ছবি: ইনস্টাগ্রাম
প্রথম আলো:

আবার কখনো কখনো চরিত্রের মাঝে শিল্পীদের জীবনও থাকে। ‘পাতাল লোক’ সিরিজের ডলি মেহরা চরিত্রে আপনার ছায়া আছে। আর কোনো চরিত্রের সঙ্গে আপনার মিল রয়েছে?

‘শাহজাহান রিজেন্সি’ সিনেমার কমলিনী গুহ। আত্মবিশ্বাসী এক নারী চরিত্র। নিজের চয়েস নিয়ে লজ্জা নেই। নিজে যেমন, তেমনভাবে প্রকাশ করে। সব সময় সে বলেছে, আমি এসকট। নিজে থেকে এই পেশা চুজ করেছি, তাহলে বলতে লজ্জা পাব কেন? নিজের চয়েসের প্রতি কমলিনীর আত্মবিশ্বাসী মনোভাবের সঙ্গে আমার মিল রয়েছে। এটা আমাকে মনোবল জোগায়।

প্রেম নিয়ে আমি অনেক ব্যথা পেয়েছি, একাকিত্ব থেকে অনেককে আকড়ে ধরার চেষ্টা করি। যেই লোকগুলো ভুল, তারা থাকতে চায় না। তবুও আকড়ে ধরে রাখার চেষ্টা করি, সেটা আমাদের ভ্রান্তি। অনেক নয়, একটি–দুটি অভিজ্ঞতা তো হয়েছে। আমার জীবনে প্রেম খুবই কম হয়েছে। মানুষ এমনভাবে বলে যে আমি ৪০টা প্রেম করেছি।

স্বস্তিকা মুখার্জি
ছবি: ইনস্টাগ্রাম
প্রথম আলো:

পিএইচডি?

আমাকে নিয়ে যত লেখা হয়েছে, পিএইচডি না, আমার মেডেল পাওয়া উচিত (হাসি)। আমার প্রেমের কথা আমি নিজেই বলেছি, এর সঙ্গে আমার সম্পর্ক, একে আমি ভালোবাসি। সেটা হাতে গোনা চার-পাঁচটা হবে। কফি খেতে গেলেও লেখে, আমি প্রেম করছি; তাহলে আমি কী করব?

স্বস্তিকা মুখার্জি
ছবি: শিল্পীর সৌজন্যে
প্রথম আলো:

কারও সঙ্গে প্রেম ভেঙে গেলে অনেকে মুখ দেখাদেখিও বন্ধ করে দেন। আপনার দেড় দশকের পুরোনো সাবেক পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ‘শিবপুর’-এ কাজ করেছেন। সাবেকদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক বরাবরই ভালো, এর টোটকা কী?

যখন ছাড়াছাড়ি হয়, সম্পর্ক ভাঙে, তখন ওটাই মনে হয় সব শেষ। তার মুখ দেখতে চাই না। তার মুখ দেখলে আমার কষ্ট হয়। তেমন সময় আমারও গেছে। পরমব্রত বা সৃজিতের সঙ্গে সম্পর্ক ভাঙার পর কাগজও দেখতাম না। কাগজে তাদের ছবি বেরোবে, রাগ না, দুঃখে আমি মরে যাব। ওই জন্য আমি দেখতে চাইনি। তারপর সময় পেরিয়েছে, সময় যত যায়, মানুষ সম্পর্কের ভালোটাই মনে রাখে, খারাপটা মাথা থেকে মুছে ফেলে।

তাদের সঙ্গে কথা বলছি, তাদের ভালো কাজ দেখছি। ফোন করে বলেছি, কাজটা খুব ভালো হয়েছে। তাদের সঙ্গে সম্পর্কটা সত্যি ছিল, তাদের ভালোবেসেছি। খারাপ লাগাটা কখনোই ভালোবাসার থেকে বেশি হয় না। তারপর তাদের সঙ্গে কাজ করেছি। একসঙ্গে কাজ করতে গিয়ে প্রথম দুয়েক ঘণ্টা হয়তো অস্বস্তি লেগেছে। পরে ভেবেছি, আমার চরিত্রের ওপর যেন ব্যক্তিগত বিষয় প্রভাব না ফেলে। তাদের জীবনে তারা এগিয়েছে, তাদের সম্পর্ক হয়েছে। বিয়ে করেছে। কাউকে ভালোবাসলে আমরা চাইব, তারা ভালো থাকুক।

হইচইয়ের একটা পার্টিতে পরমের সঙ্গে দেখা হয়েছে, পরমকে জড়িয়ে ধরে বললাম, ভালো থাকিস। তোর বউকে আমার বেশি ভালো লাগে। পিয়াকে আমি সোশ্যাল মিডিয়ায় অনুসরণ করি। তোদের বিয়ের সময় এত কাণ্ড ঘটল, আমি তোদের নিয়ে প্রতিবাদ করেছি। আমার মনে হয়েছে, অন্যায়কে অন্যায় বলতে হবে। সেটা আমার সাবেক হোক আর ফিউচার হোক। যাদের আমি ভালোবাসি, তাদেরকে দেখলে আমার খুব মায়া লাগে।

স্বস্তিকা মুখার্জি
ছবি: ইনস্টাগ্রাম
প্রথম আলো:

এই ‘নির্বাণ’ লাভ করলেন কীভাবে?

কী জানি, আমার দেখলে খুব মায়া হয়। সৃজিতের সঙ্গে আমি এখন কাজ করছি। শুটিংয়ে ও বলে, আমার বাড়িতে গিয়ে একা একা থাকতে হবে। আমার ভালোবাসাটা কখনোই ওই জায়গাটাই পৌঁছাবে না যে তাঁকে আমি একটু আদরযত্ন করে রাখতে পারব। সেটা কিন্তু পেরিয়ে এসেছি। ওই জায়গায় আমার মনটা কখনোই যাবে না। ওই একইভাবে তার প্রতি তো আমার ভালোবাসা থাকবে না। তার কাজটাকে শ্রদ্ধা করি, কাজ করতে ভালো লাগে। সে যখন বলে, আমার বাড়িতে গিয়ে একা থাকতে হবে। আমার কষ্ট হয়, মায়া লাগে। মায়াটা লাগবে, তার সঙ্গে হয়তো ফেরত যাব না। কিন্তু আমার মায়া লাগে। আগে বইয়ে পড়তাম, মানুষকে ভালোবাসলে ভালোবাসাটা থেকেই যায়। ভাবতাম, দূর, এসব লেখকেরা লিখে যান, এসব জীবনে কী আর প্রযোজ্য? পরে দেখেছি, না; এটাই হয়। কারণ দেখুন, একটা মানুষকে আপনি এত ভালোবাসবেন, তারপর কারও সঙ্গে সম্পর্ক হবে, তাকেও অতটা ভালোবাসেন। আপনার ভালোবাসা একটু একটু করে তাদের মাঝে চলে যাচ্ছে। যখন সম্পর্কটা ভাঙে আমি তখন পুরো হৃদয়টাতো আর ফেরত পাচ্ছি না। ভালোবাসলেন; সম্পর্ক ভেঙে গেল—ভালোবাসাটা তাহলে কোথায় যাবে? ওটা থাকবে।

স্বস্তিকা মুখার্জি
ছবি: শিল্পীর সৌজন্যে
প্রথম আলো:

আপনার জীবন ক্লাইম্যাক্সে ভরপুর; সিনেমার চেয়েও কোনো অংশেই কম নয়। আপনার তো বায়োপিকও হতে পারে।

বাইরে থেকে ওই রকম মনে হলেও আমি আসলে খুবই সাধারণ মানুষ। সাধারণ জীবন যাপন করি। অনেক মানুষ আমার চেয়ে এক শ গুণ বেশি লড়াই করছে। ওদের কথা শুনলে মনে হয়, আমি কত সুখে আছি। আমরা নিজেদের দুঃখ-কষ্টকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাবি। ভাবি এর চেয়ে আর খারাপ হতেই পারে না। কিন্তু আরও মানুষ কঠিন সংগ্রাম করছে। তখন মনে হয় ঈশ্বরের অনেক আশীর্বাদ, ভালো আছি।

মেয়ে অন্বেষা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে স্বস্তিকা, যুক্তরাজ্যে পড়াশোনা করছে অন্বেষা
ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে
প্রথম আলো:

মাত্র ১৮ বছর বয়সে বিয়ে, মেয়ে অন্বেষার জন্মের পরপরই বিচ্ছেদ। একা মা হিসেবে লড়াইয়ের অনুপ্রেরণাটা কোথায় পেলেন?

আমি কখনোই নিজেকে একা মা মনে করিনি। মানিকে (অন্বেষা) আমার মা ও বোন দেখেছে। পরে বোনের বিয়ে হয়ে গেল, মা মারা যাওয়ার পর থেকে মেয়ের সবটা আমি করেছি। আমি অনেক ছোটবেলায় মা হয়েছি। আমি বলি, আমরা মা-মেয়ে একসঙ্গে বড় হয়েছি। মা–বাবা ছায়া দিয়ে আমাদের আগলে রেখেছিলেন। বাবা আমাকে সব সময়ই সমর্থন করেছেন।

২০০৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের এক বড় সংবাদমাধ্যমে বিকিনি পরে শুট করেছিলাম। আত্মীয়রা মাকে ফোন করে বলেছিলেন, কাগজটা লুকিয়ে রাখো। বাবা ঘুম থেকে উঠে দেখলে লজ্জার ব্যাপার হবে। বাবা ঘুম থেকে উঠার পর আমিই তাঁকে ছবিটা দেখিয়েছিলাম। বাবা বলেছিলেন, ‘ছবিটা নান্দনিক উঠেছে। বাঁধিয়ে রাখ। ’ শরীর, মন, সম্পর্ক, জীবনযাপন নিয়ে আমি যে এত বলিষ্ঠ, সেটা অনেকটাই বাবার জন্য। বাবা সব সময় আমাকে স্রোতের উল্টো দিকে যাওয়ার কথা বলেছেন।

ভারতীয় অভিনেতা সন্তু মুখোপাধ্যায়ের মেয়ে স্বস্তিকা, শৈশবে বাবার সঙ্গে তোলা ছবিটি এখন শুধুই স্মৃতি
ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে
প্রথম আলো:

২০১০ সালের পর আর্ট সিনেমা ও বাণিজ্যিক সিনেমার মিশেলে টালিউডের সিনেমায় একধরনের বাঁকবদল ঘটেছে। ক্যারিয়ারের শুরুতে ‘মাস্তান’-এর মতো বাণিজ্যিক সিনেমা করেছেন; সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ‘শাহজাহান রিজেন্সি’, ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’-এর মতো সিনেমায় পাওয়া গেছে আপনাকে। নিজেকে কীভাবে বদলালেন?

শিল্পী হিসেবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাকেও পাল্টাতে হবে। নতুন কিছু শিখতে হবে, পুরোনো কিছু বর্জন করতে হবে। সারা বিশ্বেই এখন অভিনয়ের সংজ্ঞাটা পাল্টে গেছে। দুই দশক আগে যে রকম অভিনয় হতো, এখন সে রকম হয় না। টেলিভিশনের পর বাণিজ্যিক সিনেমায় কাজ করেছি, তারপর দেখলাম ছবির গতিটা পাল্টাচ্ছে। আমিও নিজেকে পাল্টেছি। বড় বড় শিল্পীদের কাজ দেখি, তাঁদের কাছ থেকে শেখার চেষ্টা করি। শুধু অভিনয়টা জানলে হবে না, আমাকে বই পড়তে হবে, গান শুনতে হবে, মিউজিয়ামে যেতে হবে।

সব রকমের চরিত্র করতে হবে। আমি মায়ের চরিত্র করব না, চুলে পাক দেখাব না, সব সময় সুন্দর থাকতে হবে, তা হয় না। মানুষ কোনো নায়িকার সৌন্দর্য সর্বোচ্চ ১০ মিনিট দেখে, তারপর তাঁকে চরিত্রটা হয়ে উঠতে হয়। ২৩ বছর ধরে আমি অভিনয় করছি। আমাকে যদি মানুষ শুধুই বলত, মেয়েটা কী সুন্দর দেখতে, তাহলে হতো না। আমার মতো কিংবা আমাদের চেয়েও সুন্দর অন্তত ২০ জন নায়িকা আছে। চেহারার চেয়ে কাজ, ব্যক্তিত্ব দিয়ে মানুষের মধ্যে পৌঁছানো দরকার।

স্বস্তিকা মুখার্জি
ছবি: শিল্পীর সৌজন্যে
প্রথম আলো:

বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বিদ্যা বালানকে আপনার প্রেরণা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি আপনাকে কতটা ও কীভাবে প্রভাবিত করেছেন?

এখন তো বডি পজিটিভিটি নিয়ে সবাই কথা বলে। বডি শেমিং নিয়ে অনেকেই প্রতিবাদ করে। কিন্তু তখন সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না, তখন বিদ্যা বালান সংগ্রাম করে গেছেন। চেহারা, শরীর নিয়ে বারবার কটাক্ষের শিকার হয়েছেন। লোকের কথায় নিজের স্টাইল পরিবর্তন করেননি। উনি শাড়ি পরতে ভালোবাসেন, শাড়িই পরেন। উনি নিজের শরীর নিয়ে খুবই আত্মবিশ্বাসী। আমি ওনাকে খুব অনুসরণ করি। অভিনেত্রী হিসেবেও ওনার কাজ আমার খুব ভালো লাগে। ওনার ছবি দেখে আমি অনেক কিছু শিখেছি।

প্রথম আলো:

ঢাকায় নতুন কোনো কাজ করছেন?

নতুন করে কোনো কাজের কথা হয়নি। আগামী এপ্রিলে ‘ওয়ান ইলেভেন’ সিনেমার শুটিংয়ের জন্য ঢাকায় আসব। পাশাপাশি তাপসের (কৌশিক হোসেন) সঙ্গে অনেক দিন ধরে ফোনে যোগাযোগ ছিল। এবার ঢাকায় এসে দেখা হলো। একসঙ্গে নিশ্চয়ই কিছু করব।

প্রথম আলো:

বলিউড ও টালিউডে আপনার কী সিনেমা আসছে?

বলিউডে ‘সেকশন এইটটি ফোর’ সিনেমায় কাজ করেছি, এতে মিস্টার অমিতাভ বচ্চন রয়েছেন। আরও দুটি স্বাধীন সিনেমা করেছি। সব মিলিয়ে চারটির মতো হিন্দি সিনেমা মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে। টালিউডে সৃজিত মুখার্জির সঙ্গে ‘টেক্কা’ সিনেমা করেছি। পূজাতে আসবে। হইচইয়ের নিখোঁজ সিরিজের দ্বিতীয় মৌসুম এই বছরই আসবে।

আরও পড়ুন