টম ক্রুজ কি পারলেন পৃথিবীকে বাঁচাতে
প্রায় তিন দশক ধরে দৌড়ঝাঁপ করে কি তিনি ক্লান্ত? ‘মিশন: ইমপসিবল-দ্য ফাইনাল রেকনিং’-এর পোস্টারে ক্লান্ত, আহত টম ক্রুজকে দেখে মনে হয়, ৬৩ বছরের এই ‘তরুণ’ হয়তো সত্যিই এবার ক্লান্ত। অথবা স্টান্টের অতিমানবীয় টম এবার সত্যই রক্তমাংসের মানুষ হয়ে পর্দায় আসবেন।
একনজরে
সিনেমা: ‘মিশন: ইমপসিবল-দ্য ফাইনাল রেকনিং’
ধরন: অ্যাকশন, অ্যাডভেঞ্চার
পরিচালনা: ক্রিস্টোফার ম্যাককুয়ারি
অভিনয়: টম ক্রুজ, হেইলি অ্যাটওয়েল, সাইমন পেগ, ভিং রেমস, এসাই মোরালেস, পম ক্লেমনতিফ
দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ৫০ মিনিট
‘মিশন: ইমপসিবল’ শুধুই একটি অ্যাকশন ফ্র্যাঞ্চাইজি নয়, প্রায় তিন দশক ধরে চলতে থাকা সিরিজটি অনেকের কাছেই আবেগের জায়গা। ‘মিশন: ইমপসিবল’ নামটির সঙ্গেই তো মিশে আছে শৈশবের নস্টালজিয়া। ক্রিস্টোফার ম্যাককুয়ারি পরিচালিত সিনেমাটি ঢাকার প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে গত ২৩ মে। ২০২৩ সালে মুক্তি পাওয়া ‘মিশন: ইমপসিবল-দ্য ডেড রেকনিং পার্ট ওয়ান’ সিনেমার এটি দ্বিতীয় ও শেষ কিস্তি। রহস্যময় এআই দ্য এনটিটির বিরুদ্ধে যে লড়াই ইথান হান্ট শুরু করেছিল, এ পর্বে সেটারই পরিণতি দেখানো হয়।
ইথান খুঁজছেন ডুবে যাওয়া রুশ সাবমেরিন সেভাস্তোপোল, যার ভেতরে লুকানো রয়েছে ভয়ংকর এআই প্রোগ্রাম দ্য এনটিটির সোর্স কোড। এই কোডকে ‘পয়জন পিল’-এ সংক্রমিত না করতে পারলে সেটা ডেকে আনতে পারে গোটা মানবজাতির ধ্বংস। এই কোডের দখল পেতে চান গ্যাব্রিয়েল (এসাই মোরালেস)। ইথানের সরকারও চায় কোড। আরও একবার পৃথিবী রক্ষার মিশনে নামে ইথান হান্ট।
শেষ দিকের প্লেনে অ্যাকশন দৃশ্যটি দুর্দান্ত। প্যারাসুট জ্বলে যাওয়ার দৃশ্যে সবচেয়ে শক্ত নার্ভের মানুষও নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হবেন। দুটি দুর্দান্ত স্টান্ট সিনেমার মেরুদণ্ড। সিনেমায় কিছু টান টান মুহূর্তও আছে। যেমন বেনজি (সাইমন পেগ) ফুসফুস অকেজো হয়ে পড়ার মধ্যেও বোমা নিষ্ক্রিয় করেন। দেখতে দেখতে পর্দার দর্শকদেরও ফুসফুস থেমে যাওয়ার জোগাড়।
এই ফ্র্যাঞ্চাইজির প্রথম সিনেমা ‘মিশন: ইমপসিবল’ মুক্তি পায় ১৯৯৬ সালে। তবে সিরিজের আগের ছয়টি সিনেমা যাঁরা দেখেননি, তাঁদেরও ‘দ্য ফাইনাল রেকনিং’ দেখতে খুব একটা সমস্যা হবে না। তবে ‘দ্য ডেড রেকনিং পার্ট ওয়ান’ না দেখলে আগের গল্পটি কোথায় শেষ হয়েছিল, ধরা একটু মুশকিল।
‘দ্য ফাইনাল রেকনিং’-এ ‘মিশন: ইমপসিবল’-এর আগের সাতটি ছবির মুহূর্তগুলো ফ্ল্যাশব্যাক হিসেবে ফিরে আসে, যেন গ্রেটেস্ট হিটস সংকলন। অনেকের কাছে এ অংশটুকু মনে হতে পারে, স্মৃতির পাতা থেকে তুলে আনা কিছু মণিমুক্তা।
‘দ্য ফাইনাল রেকনিং’ মেজাজে ধীর। তবে গতি ধীর হলেও শুরু থেকেই দর্শকদের মনোযোগ ধরে রাখে দুটি কারণ। এক. ১০০ ঘণ্টার কম সময়ের মধ্যে এনটিটিকে থামাতে হবে, না হলে পারমাণবিক বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে যাবে পৃথিবী। দুই. গ্যাব্রিয়েল (এসাই মোরালেস) যেন এনটিটিকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে না পারে, তা নিশ্চিত করা। দুই কাজ কীভাবে ঠিকঠাক হবে, সেটা দেখাটাই তো রোমাঞ্চকর ব্যাপার। দলের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সদস্যদের নিয়ে মাঠে নামেন ইথান। বেনজি (সাইমন পেগ), লুথার (ভিং রেমস), গ্রেস (হেইলি অ্যাটওয়েল) তো আছেনই, নতুন করে যোগ হন প্যারিস (পম ক্লেমনতিফ)। শুরু হয় এনটিটিকে থামানোর লড়াই। এনটিটিকে থামিয়ে পৃথিবীকে কি পারবেন বাঁচাতে ইথান?
সিনেমায় ড্রামার একটা বড় অংশ আছে। লম্বা সময় ধরে কথা বলা, প্ল্যানিং, ফ্ল্যাশব্যাক চলতে থাকে। অ্যাকশন সিনেমার চেয়ে এটিকে বরং ড্রামা সিনেমাই বানাতে চেয়েছেন নির্মাতা। যদিও ‘মিশন: ইমপসিবল’ ফ্র্যাঞ্চাইজি মানেই ধুন্ধুমার অ্যাকশন, দুর্দান্ত ধাওয়া আর চোখধাঁধানো স্টান্ট। ‘দ্য ফাইনাল রেকনিং’-এ সবই আছে, কিন্তু সিনেমার মেজাজ বড্ড গম্ভীর।
সাগরের গভীরে দুর্ঘটনায় পতিত সাবমেরিনের ইথানের ঢোকার দৃশ্যটি সিনেমার সবচেয়ে আশ্চর্য দৃশ্য বললেও ভুল হয় না। ২০ মিনিটের প্রায় সংলাপহীন দৃশ্যটিতে একধরনের রোমাঞ্চকর গাম্ভীর্য আছে, যা ‘থান্ডারবল’-এর জলের নিচের দৃশ্যগুলোকে মনে করিয়ে দেয়। সাবমেরিনটি ইথানের ভারে ধসে পড়ে, পানি ভেতরে ছড়িয়ে পড়ে—দৃশ্যটি জাদুকরি মুহূর্ত তৈরি করে।
শেষ দিকের প্লেনে অ্যাকশন দৃশ্যটি দুর্দান্ত। প্যারাসুট জ্বলে যাওয়ার দৃশ্যে সবচেয়ে শক্ত নার্ভের মানুষও নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হবেন। দুটি দুর্দান্ত স্টান্ট সিনেমার মেরুদণ্ড। সিনেমায় কিছু টান টান মুহূর্তও আছে। যেমন বেনজি (সাইমন পেগ) ফুসফুস অকেজো হয়ে পড়ার মধ্যেও বোমা নিষ্ক্রিয় করেন। দেখতে দেখতে পর্দার দর্শকদেরও ফুসফুস থেমে যাওয়ার জোগাড়।
কিন্তু বেঞ্জি এ সিনেমায় যেন থেকেও নেই। বেঞ্জি-ইথানের কমেডি বা গ্রেস-ইথানের দুষ্টু-মিষ্টি বোঝাপড়ার যে দৃশ্যগুলো ফ্র্যাঞ্চাইজির আগের সিনেমাতে দেখা যায়, এ সিনেমায় সেসব একেবারেই অনুপস্থিত। দীর্ঘ সংলাপে অনেক সময় মনোযোগে ভাটা পড়ে। পুরো সিনেমায় মনে রাখার মতো অ্যাকশন দৃশ্য কম। আছে কেবল আগের ‘মিশন: ইমপসিবল’ সিনেমার একটার পর একটা রেফারেন্স। সেটা ‘মিশন: ইমপসিবল ২’-এর ব্ল্যাক ভল্ট হ্যাকিংই হোক বা ‘মিশন: ইমপসিবল ৩’-এর র্যাবিটস ফুট।
সবকিছু ছাপিয়ে সিনেমাটিকে আলাদা করে তুলেছে টম ক্রুজের অভিনয়। তিনি বারবার ভেঙে পড়েন, শরীর-মন সায় দেয় না; তবু নিজের লক্ষ্যে অবিচল থাকেন। তিনি কখনোই তাঁর দলের কাউকে ফেলে যান না। এ ছবিতে তিনি কেবল স্টান্টম্যান নন; বরং রক্তমাংসের মানুষ হিসেবেই দেখানো হয়েছে বেশি।
হেইলি অ্যাটওয়েল ও ভিং রেমসের (লুথার চরিত্রে) অনবদ্য অভিনয়ও মনে রাখার মতো। বিশেষ করে লুথারের বিদায়ী সংলাপে অজান্তেই চোখের কোণে জল জমে। এমন নিঃসঙ্গ ইথানকে খুব কমই দেখা গেছে।
চতুর্থবারের মতো এ ফ্র্যাঞ্চাইজির সিনেমা পরিচালনা করেছেন ক্রিস্টোফার ম্যাককুয়ারি, যিনি মূলত সংলাপ আর দৃশ্যকল্প তৈরির দিকেই বেশি মন দিয়েছেন। যদিও লার্জার দ্যান লাইফ অ্যাকশন দেখতেই অভ্যস্ত এ ফ্র্যাঞ্চাইজির দর্শক।
‘মিশন: ইমপসিবল-দ্য ফাইনাল রেকনিং’ সিনেমার বাজেট ছিল ৪০০ মিলিয়ন ডলার। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বাজেটের সিনেমার একটি। কিন্তু সিনেমা শেষ করার পর দু-একটি দৃশ্য ছাড়া তেমন কিছুই মনে থাকে না। এআইকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখানো হলেও এআই কেন এত গুরুত্বপূর্ণ, সেটার গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা নেই। অথচ বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এআইকে কেন্দ্র করে অনেক কিছুই দেখানো যেত। তেমনি খল চরিত্রে গ্যাব্রিয়ালকেও তত শক্তিশালী মনে হয়নি। হয়তো চরিত্রদের একে অন্যের থেকে দূরে সরে কাজ করার কারণে এ শূন্যতা তৈরি হয়েছে।
শেষ প্রশ্ন, নামের সঙ্গে ফাইনাল রেকনিং আর পর্দাজুড়ে টম ক্রুজকে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানানো কি এই ফ্র্যাঞ্চাইজির শেষের ইঙ্গিত? সেটা হয়তো নিশ্চিত করে বলা যাবে না। ছবির প্রিমিয়ারে যেভাবে টম নিজেই বলেছেন, ‘শেষ বলে কিছু নেই!’
আজ ৬৩-তে পা দিলেন টম। তাঁর অভিনীত ছবিটি বড় পর্দায় দেখতে দেখতে বারবার আপনি আবেগতাড়িত হবেন, টমের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জেগে উঠবে। কিন্তু সিনেমা শেষে যদি প্রশ্ন করা হয়, এটি কি এই ফ্র্যাঞ্চাইজির সবচেয়ে মনে রাখার মতো সিনেমা? উত্তরটা ‘না’ হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।