হ‌ুমায়ুন ফরীদি বলতেন ‘শত্রুকে বধ করার জন্য আমার “হাসি টুকু” অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করি’

হুমায়ুন ফরীদি
ছবি: প্রথম আলো

বিভিন্ন সাক্ষাৎকার কিংবা ব্যক্তিগত আলোচনায় জীবন নিয়ে নিজের উপলব্ধির কথাগুলো অনায়াসে বলতেন হ‌ুমায়ুন ফরীদি। তাঁর কথাগুলো কে কীভাবে নেবেন, সেসব চিন্তা করতেন না। তিনি কখনোই কারও সঙ্গে নিজেকে মেলাতেন না। তিনি ছিলেন স্বতন্ত্র, যেন নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। কালক্রমে প্রিয় অভিনেতার জীবনযাপন, প্রেম–ভালোবাসার সম্পর্কের সেসব কথায় থাকত জীবনকে বদলে দেওয়ার মতো অনেক উপাদান। ভক্তরা এখনো তাঁকে সেসব উক্তি দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। নিরলস পরিশ্রমী ও জীবনের সঙ্গে আপসহীন এই তারকার আজ মৃত্যুবার্ষিকী। চলে যাওয়ার ১১ বছর।

‘আমি যখন যাঁকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছি, সে আমাকে ফেলে গেছে। আমাদের জীবনেও প্রায়ই এমনটা হয়। যাঁদেরকে আমরা একান্তই খুব কাছের মানুষের মতো প্রাধান্য দিই। নিয়তির দোষে তাঁদের সঙ্গেই আমাদের বেশি ছাড়াছাড়ি হয়। তারপরও জীবন চলে যায় তার নিয়মে।’
হ‌ুমায়ুন ফরীদি

বললে মোটেও বাড়াবাড়ি হবে না, হ‌ুমায়ুন ফরীদির মতো অভিনেতা কালেভাদ্রে জন্ম নেন। তাঁরা বেঁচে থাকেন কাজ দিয়ে, ভালোবাসা ও জীবনের দার্শনিক চিন্তা দিয়ে। ক্যারিয়ারে তুমুল আলোচনায় থাকলেও জীবনের শেষ দিনগুলো তিনি দর্শক, সহকর্মীদের থেকে কিছুটা দূরে ছিলেন। অভিনয়ে কিছুটা অনিয়মিত ছিলেন। তবে নিজের মতোই সময়গুলো কাটাতেন। এই সময় তিনি উপলব্ধি করেছেন যাঁদের বেশি ভালোবেসেছিলেন, তাঁরাই একসময় দূরে সরে গিয়েছেন। কিন্তু কখনোই তিনি জীবনে হোঁচট খাননি। এসব মানসিক আঘাত তাঁকে কোনো কিছু থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেনি। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যখন যাঁকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছি, সে আমাকে ফেলে গেছে। আমাদের জীবনেও প্রায়ই এমনটা হয়। যাঁদেরকে আমরা একান্তই খুব কাছের মানুষের মতো প্রাধান্য দিই। নিয়তির দোষে তাঁদের সঙ্গেই আমাদের বেশি ছাড়াছাড়ি হয়। তারপরও জীবন চলে যায় তার নিয়মে।’

হুমায়ুন ফরীদি
ছবি: সংগৃহীত
‘আমি আমার শত্রুকে বধ করার জন্য আমার “হাসি টুকু” অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করি। মানুষ পেছনে অনেক কিছু বলে, এটাই নিয়তি।’ এ ছাড়া প্রায়ই তাঁকে শুনতে হতো আপনি মানুষ হিসেবে বদলে গিয়েছেন। সেসব প্রসঙ্গে প্রিয় তারকার উল্টো প্রশ্ন ছিল, ‘আমি বদলায়নি তবে আমি কি মানুষ নই?’
হ‌ুমায়ুন ফরীদি

ব্যক্তিগত জীবনে আলোচনা–সমালোচনা থাকলেও সেগুলো নিয়ে অগোচরে দর্শক ও সহকর্মীরা নানা কথা বলতেন। সেসব কথা হ‌ুমায়ুন ফরীদির কানে আসত। সেগুলো নিয়ে তিনি হাসিমুখে বলতেন, ‘আমি আমার শত্রুকে বধ করার জন্য আমার “হাসি টুকু” অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করি। মানুষ পেছনে অনেক কিছু বলে, এটাই নিয়তি।’ এ ছাড়া প্রায়ই তাঁকে শুনতে হতো আপনি মানুষ হিসেবে বদলে গিয়েছেন। সেসব প্রসঙ্গে প্রিয় তারকার উল্টো প্রশ্ন ছিল, ‘আমি বদলায়নি তবে আমি কি মানুষ নই?’

শেষের দিকে অভিনয় কম করলেও তিনি ব্যস্ত থাকতেন বই নিয়ে। নিয়মিত বই পড়তেন। শৈশব থেকে বইয়ের প্রতি ভালোবাসা ছিল এই তারকার। এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, প্রথম প্রেমের অনুভূতি পেয়েছেন বই পড়ে। শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র পড়ে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সেই প্রেম-জীবনের অনুভূতিগুলো বদলে গেছে। নানা ঘাতপ্রতিঘাতে তিনি স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছেন। এসব মিলিয়েই যেন তিনি জীবনকে উপভোগ করে গিয়েছেন। এই অভিনেতা প্রায়ই বলতেন, ‘আমি জীবনকে উপভোগ করতে চাই এবং আমি জীবনকে উপভোগ করেছি। ভবিষ্যতেও উপভোগ করব। আমার কাছে জীবনটা অনেক বিশাল মনে হয়। এটা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এটা অনুভূতির ব্যাপার। আমি জীবনে কখনোই আপস করিনি। আপস করে ভিতু মানুষ। আপস করে মেরুদণ্ডহীন প্রাণীরা। আমার মেরুদণ্ড আছে।’

‘আমি জীবনে কখনোই আপস করিনি। আপস করে ভিতু মানুষ। আপস করে মেরুদণ্ডহীন প্রাণীরা। আমার মেরুদণ্ড আছে।’
হ‌ুমায়ুন ফরীদি

তবে তিনি এটাও বলতেন, ‘কিছু কিছু পরিবর্তন মানুষ আপনা-আপনিই করে। কিছু পরিবর্তন মানুষের জীবনে অজান্তেই চলে আসে। যেখানে নিজের হাত নেই।’

চির উজ্জ্বল অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি । ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

বরাবরই রোমান্টিক মানুষ ছিলেন হুমায়ুন ফরীদি। স্কুলে পড়াশোনার সময়ই প্রেমে পড়েছিলেন। জীবনে বারবার প্রেমে পড়েছেন। খুঁজে পেয়েছেন জীবনের নানা উপলব্ধি। প্রেম–ভালোবাসা নিয়ে বিভিন্ন সময় সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘প্রেমে পড়ার মতো এত আনন্দদায়ক কিছু কি আছে পৃথিবীতে? আমি এখনো একটা মেয়েকে অসম্ভব ভালোবাসি, অসম্ভব।’ কিন্তু কখনোই বলেননি কে সেই মেয়ে। বললে সেই মেয়েটির ক্ষতি হবে। নীরবে ভালোবাসলেও সরবে বলে যাওয়ার মতো মানুষ তেমন একটা নেই। এখানেই যেন ব্যতিক্রম ছিলেন এই তারকা। সেই প্রেমে কখনো বাধাও এসেছে। কাউকে দিনের পর দিন ভুলতে পারেননি। সেসব নিয়ে নীরবেই উচ্চারণ করেছেন, কাউকে ভালোবাসার অনেক পথ আছে, কিন্তু তাঁকে ভোলার কোনো পথ নেই!’ কথাগুলো এখনো ভক্তদের মনে গেঁথে রয়েছে। শুধু প্রেমই নয়, তাঁর জীবনবোধ নিয়ে এমন অনেক উক্তি এখনো ভক্তরা নিয়মিত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল করেন। সেখানে জীবন্ত হয়ে ওঠেন হুমায়ুন ফরীদি।

‘প্রেমে পড়ার মতো এত আনন্দদায়ক কিছু কি আছে পৃথিবীতে? আমি এখনো একটা মেয়েকে অসম্ভব ভালোবাসি, অসম্ভব।’
হ‌ুমায়ুন ফরীদি
হুমায়ুন ফরীদি
ছবি: সংগৃহীত

প্রেম নিয়েও হুমায়ুন ফরীদি ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ‘প্রেম স্বর্গীয়। মানুষের ভেতরে প্রেমের যে অনুভূতি এটা পবিত্র ও স্বর্গীয়। প্রেমের চেয়ে ভালো বিষয় মানব ইতিহাসে নেই। আমি শুধু মানুষে মানুষে প্রেমের কথা বলছি না। একটা মানুষ একটা বৃক্ষের সঙ্গে প্রেম করতে পারে, একটা মানুষ তাঁর জানালার পাশে বসা দোয়েল পাখির প্রেমে পড়তে পারে। আমরা প্রেম বলতে বুঝি একটা ছেলে একটা মেয়ে, কিন্তু ব্যাপারটা সেই রকম নয়। এই জন্যই আমার কাছে জীবনটা ছোট নয়।’
মঞ্চনাটক, সিনেমা বা টেলিভিশন—সব মাধ্যমেরই নিজস্বতার স্বাক্ষর রেখে গিয়েছেন হুমায়ুন ফরীদি। ইতিবাচক নেতিবাচক সব চরিত্রেই তিনি দাপুটে অভিনেতার পরিচয় দিয়েছেন। কখনো রমজান ডাকু, কখনো কানকাটা রমজান, সেরাজ তালুকদারসহ অসংখ্য চরিত্রে তিনি দর্শকদের মাতিয়েছেন। সেসব কাজ এখনো দর্শকদের বিনোদন দেয়।

‘একা থাকা অনেক ভালো, কারণ, একাকিত্ব কখনো-বিশ্বাসঘাতকতা করে না।’
হুমায়ুন ফরীদি

এই অভিনেতা ২০১২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারির আজকের এই দিনে মারা যান। শেষ সময়টায় তিনি অনেকটাই একা থাকতেন। এটাও তিনি উপভোগ করতেন। এক সাক্ষাৎকার তিনি জানিয়েছিলেন, ‘একা থাকা অনেক ভালো, কারণ, একাকিত্ব কখনো-বিশ্বাস ঘাতকতা করে না।’ সর্বশেষ হুমায়ুন ফরীদি চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন রেদওয়ান রনির ‘চোরাবালি’ সিনেমায়। কিন্তু সিনেমার শুটিংয়ের কদিন আগেই তিনি মারা যান।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন