মুক্তিযুদ্ধের ছবি, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের ছবি

‘একটি না বলা গল্প’ সিনেমার দৃশ্যে রওনক হাসান ও রুনা খানছবি: সংগৃহীত
গত শুক্রবার অনেকটা নীরবেই ঢাকাসহ দেশের ৮টি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে ‘একটি না বলা গল্প’। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও আশির দশকের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনকে একটি কাহিনি কাঠামোয় এনে ছবিটি নির্মাণ করেছেন নির্মাতা পংকজ পালিত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবিটি নিয়ে চলছে ইতিবাচক আলোচনা।

পংকজ পালিত তখন চিত্রগ্রাহক হিসেবে কাজ করেন। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে প্রথম আলোর সাহিত্য পাতা ‘অন্য আলো’য় ‘মৃত্যু যেভাবে বাঁচায়’ নামে একটা গল্প পড়েন। সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক বিশ্বজিৎ চৌধুরীর লেখা গল্পটি তাঁর হৃদয়ে এতটাই নাড়া দিয়েছিল যে তখনই ভেবেছিলেন, সেটি নিয়ে সিনেমা বানাবেন।


‘কোন প্রেক্ষাপটে গল্পটি লিখেছিলেন?’ এমন প্রশ্নের জবাবে বিশ্বজিৎ চৌধুরী জানান, ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠের কাছে নেত্রী শেখ হাসিনার গাড়িবহরে গুলি চালিয়েছিল পুলিশ। ঘটনাস্থলেই কয়েকজন মারা যান, সেদিন জনসভার পথে স্বৈরাচারবিরোধী মিছিলে তিনিও (বিশ্বজিৎ চৌধুরী) ছিলেন। কাছ থেকে দেখা সেই ঘটনার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধকে জুড়ে দিয়ে গল্পটি লিখেছেন তিনি।


বিশ্বজিৎ চৌধুরীর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে সেই গল্প অবলম্বনেই পরে একটা চিত্রনাট্য লিখে অনুদানের জন্য জমা দেন পংকজ। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে সরকারি অনুদান পেয়েই নেমে পড়েন নির্মাণে, এটিই তাঁর নির্মিত প্রথম কোনো সিনেমা।


মমিনুল ও আরিফা নামে দুই চরিত্রের জীবনের ‘না বলা গল্প’ নিয়েই একটি না বলা গল্প। দুই চরিত্রে অভিনয় করেছেন রওনক হাসান ও রুনা খান। একাত্তরে সদ্য তরুণ ও আশির দশকের শেষ ভাগে মধ্যবয়সী চরিত্রে পাওয়া গেছে তাঁদের।

সিনেমায় আরিফা চরিত্রে অভিনয় করেছেন রুনা খান
ছবি: সংগৃহীত

চরিত্রের খোঁজে


‘মমিনুল চরিত্রে শাকিব খান কিংবা প্রতিষ্ঠিত কোনো নায়ক উপযুক্ত নন। আমি এমন একজনকে খুঁজছিলাম, যিনি নিজেকে ভাঙতে পারবেন; একই সঙ্গে তরুণ ও প্রৌঢ় চরিত্র ধারণ করতে পারবেন। সেটা রওনক হাসানের মধ্যে পেয়েছিলাম। আরিফা চরিত্রে রুনা খান খুব ভালো করেছেন, নিজেকে ভেঙেছেন,’ বলছিলেন নির্মাতা পংকজ পালিত।


‘মমিনুল চরিত্র ধারণ করলেন কীভাবে?’ রওনক হাসান জানান, ‘এ পর্যন্ত আমার অভিনীত সিনেমার মধ্যে এটিই সবচেয়ে কঠিন চরিত্র ছিল। ’৭১ ও ’৮৮ সালের আলাদা আলাদা চরিত্রে অভিনয় করা খুব চ্যালেঞ্জিং ছিল, বেশ কয়েক রাত ঘুমাইনি। চরিত্রটি নিয়ে পরিচালকের সঙ্গে আলাপ করেছি, তৌকীর (আহমেদ) ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ করেছি। চরিত্রের প্রতি সুবিচারের চেষ্টা করেছি।’


২০১৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত প্রয়াত নির্মাতা সাজেদুল আউয়ালের ‘ছিটকিনি’ সিনেমার চিত্রগ্রহণ করেছেন পংকজ পালিত। সেই সিনেমায় অভিনয়ের সুবাদে রুনার সঙ্গে তাঁর পরিচয়। প্রথম নির্মাণেই রুনাকে নির্বাচন করেছেন পংকজ।


রুনা খান বলেন, ‘পরিচালক, সহশিল্পী রওনক ভাই, শিল্পনির্দেশক উত্তম গুহ দাদার সহযোগিতা পেয়েছি, পাশাপাশি অভিনয়শিল্পী হিসেবে নিজের চেষ্টা ছিল। যতটা সম্ভব আরিফাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করেছি।’

সিনেমার পোস্টার
ছবি: সংগৃহীত

বাজেটে টান, ধারকর্জে রক্ষা


জীবনের প্রথম সিনেমা নির্মাণ করতে গিয়ে ঘাটে ঘাটে হোঁচট খেয়েছেন পংকজ পালিত। ঐতিহাসিক ঘটনা নিয়ে নির্মিত সিনেমা খুব অল্প বাজেটে হয় না। সিনেমার দৃশ্যধারণ শেষ হওয়ার আগেই অনুদানের অর্থ ফুরিয়ে যায়। আর্থিক সংকটের মুখেও হাল ছাড়েননি। পংকজ পালিতের ভাষ্যে, ‘স্ত্রীর কাছে ঋণ করেছি, ছেলের কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে সিনেমা করেছি। পোস্টার থেকে ব্যানার—সব নিজের পয়সায় করেছি। কারও কাছে স্পন্সর নিইনি।’

সিনেমার দৃশ্যধারণের মুহূর্ত
ছবি: সংগৃহীত

একটি না বলা গল্প

মমিনুল ও আরিফার বয়ানে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনকে তুলে এনেছেন নির্মাতা। সিনেমার গল্পে দেখা যাবে, একাত্তরে ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিতে ব্যর্থ হয়ে দেশে ফিরে আসে মমিনুল; এর ভেতর মমিনুলের জীবনে বহু গল্পের অবতারণা হয়। মমিনুলের বন্ধু ইকবাল মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়। তার স্ত্রী আরিফার জীবনেও ছাইচাপা আগুনের মতো অনেক ‘না বলা’ গল্প আছে। সিনেমার একপর্যায়ে এক ফ্রেমে আসে মমিনুল ও আরিফা।


একাত্তর ও আটাশিকে এই সময়ে তুলে আনাটা সহজ ছিল না। পংকজ পালিত বলেন, ‘এত বছর পর একাত্তরের দৃশ্য ধারণ করা খুব কঠিন, এমনকি ১৯৮৮ সালকেও ঠিকঠাকভাবে আনা যাচ্ছিল না। চট্টগ্রাম শহরের মধ্যে সেসব জায়গা খুঁজে বের করা কষ্টসাধ্য ছিল। ক্যামেরা ধরলেই এই সময়ের বিলবোর্ড সামনে আসে।’

দৃশ্যধারণের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সংগ্রহে থাকা একাত্তরের ফুটেজ সিনেমায় ব্যবহার করেছেন নির্মাতা। মুক্তি দেওয়ার আগেই বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র উৎসব থেকে আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন নির্মাতা; তবে দেশে মুক্তির আগে অন্য কোথাও পাঠানোর বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন না। এখন বাইরের উৎসবেও সিনেমাটি দেখাতে চান তিনি। সিনেমায় রওনক হাসান ও রুনা খান ছাড়া অভিনয় করেছেন প্রাণ রায়, নরেশ ভূঁইয়া, মোমেনা চৌধুরী।


ভারতের পুনের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউিটে চিত্রগ্রহণে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে ঢাকায় এসে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চিত্রগ্রহণের ওপর শিক্ষকতা করেছেন পংকজ। চিত্রগ্রাহক হিসেবে দুই শতাধিক চলচ্চিত্র ও তথ্যচিত্রে কাজ করেছেন তিনি।

আরও পড়ুন