তরুণদের স্বপ্ন দেখানোই শাওকীর স্বপ্ন

সৈয়দ আহমেদ শাওকীপ্রথম আলো

একদিন একটা তাকদীর বানাবেন অথবা বানাবেন ‘কারাগার’, এমন স্বপ্ন নিয়েই কি নির্মাতা হয়েছেন শাওকী সৈয়দ? উত্তরে যখন না বললেন, আমাদের গল্পটা তখনই জমে উঠল। এ সময়ের তরুণ ও মেধাবী নির্মাতা শাওকী বললেন, কিছু ছোট ছোট স্বপ্নের কথা, যা শুনে বোঝা গেল বড় বড় অর্জনের জন্য, ছোট ছোট চেষ্টা আর পাগলামির কোনো বিকল্প নেই।

আরও পড়ুন

ওয়েব সিরিজ ‘তাকদীর’ আর ‘কারাগার’ দেখা অনেক তরুণেরই হয়তো মনে নতুন স্বপ্ন দানা বেঁধেছে। একটা ছক ভাঙা সিনেমা বা ওয়েব সিরিজ বানানোর। কিন্তু মজার বিষয় কি জানেন? যাঁর সৃষ্টি দেখে নতুন স্বপ্ন বিভোর হচ্ছেন একদল তরুণ, সেই নির্মাতার নাকি ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত কোনো স্বপ্নই ছিল না। সত্যিই তাই!

‘তাকদীর’–এর দৃশ্য। আইএমডিবি

গান, সিনেমা, নাটক দেখতেন বড় ভাইয়ের পছন্দে। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হলেন, সেটাও চাচাতো ভাই সালেহ সোবহান অনীম একই বিষয়ে পড়েন বলে। মোদ্দাকথা, অনেক কিছুর ভিড়ে নিজের জন্য স্বপ্ন দেখা তাঁর অনেক বছর পর্যন্তই হয়ে ওঠেনি। নিজের কোনো শক্তপোক্ত স্বপ্নের কথা বলতে না পারলেও, একটা তীব্র ভালো লাগার ব্যাপারে বরাবরই স্পষ্ট শাওকী। সেটা হলো, সিনেমা দেখার প্রতি ভালো লাগা। শুরুতে ভাইয়ের পছন্দেই সব দেখা হতো। এরপর ছেলেবেলা সৌদি আরবের দাম্মামে কাটিয়ে যখন উচ্চতর শিক্ষার জন্য ঢাকায় এলেন, তখন পড়াশোনাটা চলে গেল ব্যাকসিটে (অবশ্য দিন শেষে সাফল্যের সঙ্গেই পাস করেছেন)।

আর ভালো লাগার পুরোটা দখল করে নিল সিনেমা। শাওকীর সামনে ওই সময়টায় সিনেমার এক বিরাট জগতের উন্মোচন হলো। অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হলেও, ক্লাসের চেয়ে বেশি তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম ক্লাবটাই টানত। এই যে ফিল্ম ক্লাবের প্রতি এত টান, এটা অবশ্য বৃথা যায়নি। টানের প্রতিদান শাওকী পেয়েছেন। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই ফিল্ম ক্লাবই শাওকীর প্রথম নির্বাক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের অর্থায়ন করেছিল। এরপর ঘটা করে আবার সেই সিনেমার প্রদর্শনীও করেছিল।

‘কারাগার’ সিরিজের পোস্টার। আইএমডিবি

প্রথম সিনেমা বানানোর এই গল্পের আরেকটু আগে ফেরত যাই। সিনেমা দেখা যখন শাওকীর নেশায় রূপ নেয়, তখন একটু একটু মনে কৌতূহল দানা বাঁধতে থাকে ‘সিনেমা কীভাবে বানায়!’ এই কৌতূহলের আগুন নেভাতেই চাচাতো ভাই অনীমের সঙ্গে আরেক পরিচিতি বড় ভাই তানিম নূর ফিরে এসো বেহুলার শুটিং সেটে যান শাওকী। এত আয়োজন, এত মহাযজ্ঞ দেখে মন থেকে তৃপ্ত হয়ে যান, ‘যাক বাবা! স্বপ্ন পূরণ হলো।’ কিন্তু সেদিন শাওকী নিজেও জানতেন না, স্বপ্নের সবে তো শুরু হলো সেখানে।
‘ফিরে এসো বেহুলা’ সিনেমায় সৈয়দ শাওকী কাজ করেছিলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর বা সহকারী পরিচালক হিসেবে। সবচেয়ে নবিশ সহকারী। হালকা দৌড়াদৌড়ি আর মুগ্ধ চোখে শুটিং দেখা ছাড়া আর তেমন কোনো কাজ নেই। সিনেমার সঙ্গে এভাবেই বিস্ময় নিয়ে তাঁর জড়িয়ে যাওয়া। এরপর তাঁর সিনেমা দেখার নেশা বদলে যায় শুটিংয়ের নেশায়। সহকারী হিসেবে কাজ করতে করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম ক্লাবের জন্য সিনেমা বানিয়ে ফেলেন। ঘোরে ঘোরে এসব করে ফেললেও শাওকী তখনো নিজের লক্ষ্য ঠিক করে উঠতে পারেননি।

যেদিন প্রথম নির্মাতা হিসেবে একটি বিজ্ঞাপনচিত্রের কাজ পান, সেদিনও জানতেন না কীভাবে একটা বিজ্ঞাপন বানাতে হয়, কীভাবে প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নির্মাণের জন্য টাকা নিতে হয় ইত্যাদি ইত্যাদি। তিনি ও তাঁর দলের বাকিরা তো কাজ শুরু করার আগেও জানতেন না কী হবে তাদের প্রতিষ্ঠানের নাম! এমনই হুটহাট পাগলামির মধ্য দিয়েই প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ফিল্মনোয়ার জন্ম। এখন সেই ফিল্মনোয়াই কনটেন্টের দুনিয়ায় এক নতুন জোয়ার নিয়ে এসেছে!

‘কারাগার’ সিরিজের শুটিংয়ের দৃশ্য। আইএমডিবি

সহকারী পরিচালক হিসেবে নির্বাক স্বল্পদৈর্ঘ্যের পর টেলিভিশনে সৈয়দ শাওকীর অভিষেক হয় ‘অস্থির সময়ে স্বস্তির গল্প’ প্রকল্পের কথা হবে তো নাটকের মধ্য দিয়ে। এরপর একদল তরুণকে এক করে শাওকী ও তাঁর ফিল্মনোয়া ‘প্রজন্ম টকিজ’ নিয়ে আসে, যা কোভিডকালের আগে বিপুল প্রশংসিত হয়। আর কোভিডকালে নিজের প্রথম নির্মাণ ‘তাকদীর’কে নিজের শেষ নির্মাণ বলে ঘোষণা দিয়ে আবারও শাওকী শুরু করেন নতুন পথে হাঁটা। তারপর তো ‘কারাগার’ এলো, ‘কারগার পার্ট টু’ এল।

শোনা যাচ্ছে, এরপর শাওকী স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম চরকির হয়ে নির্মাণ করতে যাচ্ছেন নতুন কিছু। এই নতুন কিছু কী? সেই উত্তর আমরা তাঁর কাছ থেকে পাইনি। শুধু জেনেছি, এবারের স্বপ্নটাও তিনি নিজের জন্য দেখছেন না। তিনি এমন কিছু কাজ, এমন কিছু পাগলামি করতে চান, যা তাঁর পরবর্তী তরুণ দলের জন্য নির্মাণের পথকে মসৃণ করবে। তাঁর পরের প্রজন্মের তরুণদের যেন কোনো মেপে মেপে হিসাব কষে স্বপ্ন দেখতে না হয়। শেষটা সৈয়দ শাওকীর বয়ানেই করা যাক, ‘স্বপ্ন দেখা আর পূরণ করাটাই সব না। মাঝেমধ্যে এমন কিছু করতে হয়, যা অন্যকে স্বপ্ন দেখার সাহস জোগায়। এখন তেমন কিছুই করতে চাই।’