বছরের অন্যতম সেরা সিনেমাটি দেখেছেন কি

‘ট্রেন ড্রিমস’–এর দৃশ্য। আইএমডিবি

এই গল্পে জীবন ও মৃত্যু পাশাপাশি হাঁটে—ঠিক যেমন রেললাইন। যা একদিকে উন্নয়নের প্রতীক, অন্যদিকে ধ্বংসের চিহ্নও বটে। বিশ শতকে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বিস্তৃত হওয়া রেললাইন যেমন মানুষকে কাছাকাছি এনেছে, তেমনি শতাব্দীপ্রাচীন বন কেটে প্রকৃতির চেহারাও বদলে দিয়েছে।

একনজরে
সিনেমা: ‘ট্রেন ড্রিমস’
ধরন: ড্রামা
পরিচালক: ক্লিন্ট বেন্টলি
অভিনয়: জোয়েল এজারটন, ফেলিসিটি জোন্স, কেরি কন্ডন, উইলিয়াম এইচ মেসি
স্ট্রিমিং: নেটফ্লিক্স
দৈর্ঘ্য: ১ ঘণ্টা ৪২ মিনিট

‘ট্রেন ড্রিমস’ তৈরি হয়েছে ডেনিস জনসনের একই নামের উপন্যাসিকা অবলম্বনে। পরিচালক ক্লিন্ট বেন্টলি ও সহচিত্রনাট্যকার গ্রেগ কুয়েদার এক সাধারণ মানুষের জীবনকে তুলে ধরেছেন অসাধারণ ভঙ্গিতে। এমন এক মানুষ, যে মনে করে তার অস্তিত্ব অপরাধবোধ আর অতীতের আঘাতে আবদ্ধ। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বিস্তৃত এই চরিত্রের চিত্রায়ণ আসলে মানুষ ও প্রকৃতির সৌন্দর্য নিয়ে এক গভীর অনুসন্ধান। নির্মাতা বলতে চেয়েছেন, ‘আমরা যেমন মাটির সঙ্গে যুক্ত, তেমনি যুক্ত তাঁদের সঙ্গেও, যাঁরা আমাদের আগে এই পৃথিবীতে হেঁটে গেছেন।’

সিনেমার শুরুর দৃশ্যগুলো স্বপ্ন আর স্মৃতির মতো—আগুনের গন্ধ, বাতাসের স্যাঁতসেঁতে ভাব যেন দর্শকেরা নিজের শরীরেই টের পান। ট্র্যাকের পাশে দেখা যায় নানা মানুষের গল্প। প্রধান চরিত্র কাঠুরে রবার্ট গ্রেইনিয়ার (জোয়েল এজারটন)। নীরব, সংযত মানুষটি রেলশ্রমিক—গাছ কাটে, রেলপথ বসায়, সেতু তৈরি করে; মাসের পর মাস ঘরছাড়া হয়ে কাজ করে যায়। তার গল্পের বড় অংশই শোনা যায় বর্ণনার মাধ্যমে, যাতে কণ্ঠ দিয়েছেন উইল প্যাটন। তাঁর কণ্ঠ একই সঙ্গে শান্ত ও গভীর, যেন নীরব রবার্টের মনের ভাষা দর্শকের কানে পৌঁছে দেয়।

‘ট্রেন ড্রিমস’ সিনেমার দৃশ্য। আইএমডিবি

রবার্ট গ্রেইনিয়ার দৃঢ়চেতা শ্রমিক। পরিযায়ী জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটে রেলশ্রমিক দলের বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ আর্নের (উইলিয়াম এইচ মেসি) সঙ্গে। রবার্টের জীবনও রেলপথ নির্মাণের মতোই জটিল। এক চীনা শ্রমিক তার চোখের সামনেই বর্ণবৈষম্যের শিকান হয়। ব্রিজের ওপর থেকে তাকে ফেলে দেওয়া হয় গিরিখাতে। এই ঘটনা রবার্টকে সারা জীবন তাড়া করে; বারবার দুঃস্বপ্নে ফিরে আসে সেই চীনা শ্রমিকের মুখ। রবার্ট আজীবন ভেবে যায়, চীনা শ্রমিকের মৃত্যুর সময় সে কিছুই করেনি। এই নিষ্ক্রিয়তাই কি পরবর্তী জীবনে তার ট্র্যাজেডির কারণ?

কাজের জায়গায় রবার্টের সঙ্গী হয় কিছু নির্লিপ্ত মানুষ, যাদের জীবনের ইতিহাস গাছের কাণ্ডের মতোই দুর্বোধ্য। তবু রবার্ট কখনো বিস্মিত হয়, কখনো আতঙ্কিত হয়, তাদের ব্যক্তিত্বের নানা দিক আবিষ্কার করে।

রবার্টের পরিচয় হয় গ্ল্যাডিসের (ফেলিসিটি জোন্স) সঙ্গে। দুজনের প্রেম ধীরে ধীরে গভীর হয়। এই অংশগুলোতে টেরেন্স ম্যালিকের সিনেমা বিশেষ করে ‘ডেজ অব হেভেন’-এর ছায়া স্পস্ট। গোধূলির আলোয় নদীর ধারে দাঁড়িয়ে তারা পাথর সাজিয়ে ভবিষ্যতের ঘরের নকশা আঁকে—যেটা পুরো সিনেমারই অন্যতম সেরা দৃশ্য।

‘ট্রেন ড্রিমস’ সিনেমার দৃশ্য। আইএমডিবি

রবার্ট আর গ্ল্যাডিস বিয়ে করে, লেকের পাশে সেই স্বপ্নের ঘর ওঠে তারা। ঘর আলো করে আসে কন্যাসন্তান। কিন্তু পরিবারের সুখ রবার্টের কপালে বেশিক্ষণ সয় না, আবার ছুটতে হয় কাজের খোঁজে। স্ত্রী, সন্তানের পাশে থাকতে কাছেপিঠে কোথাও কাজ করতে চায় রবার্ট। কিন্তু মনমতো কাজ মেলে না, যাও মেলে পয়সা কম। গ্ল্যাডিস প্রস্তাব দেয় তার সঙ্গে কাজের জায়গায় নিয়ে যেতে।

তবে সেবার যাওয়া হয় না, রবার্ট আবার ফিরে যায় তার পরিযায়ী জীবনে। এর মধ্যেই ঘটে যায় তার জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজিডি, শুরু হয় অবাস্তব অপেক্ষা। যে অপেক্ষার আর ফুরায় না।

সিনেমায় অসাধারণ পারফরম্যান্স দিয়েছেন অভিনয়শিল্পীরা। কাঠুরে রবার্টের চরিত্রে ক্যারিয়ারসেরা অভিনয় করেছেন জোয়েল এজারটন। নিঃশব্দ, সংযত এক মানুষ, যাকে অসাধারণ গভীরতায় ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। প্রায় ভবঘুরে জীবনে অভ্যস্ত মানুষটির ভেতরে লুকিয়ে থাকে এক তীব্র অথচ অব্যক্ত আবেগ, যা চরিত্রটিকে নিঃশব্দে প্রকাশ করে। তাঁর অনুভূতি যেন সেই গাছ, যা জঙ্গলে পড়ে যায় কিন্তু শব্দ হয় না।

‘ট্রেন ড্রিমস’ সিনেমার দৃশ্য। আইএমডিবি

বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞের ভূমিকায় উইলিয়াম এইচ মেসি অল্প সময়ের উপস্থিতিতেই চরিত্রটিকে এত গভীর করে তোলেন যে এই ছোট ভূমিকাই ছবির ভিত্তি শক্ত করে দেয়। রবার্টের স্ত্রী গ্ল্যাডিসের চরিত্রে মনে থাকে ফেলিসিটি জোন্সের কথা। রবার্টের সঙ্গে তাঁর রসায়ন, জঙ্গলময় ফুলের রাজ্যে ঘুরে বেড়ানোর দৃশ্যগুলো সিনেমা শেষ হওয়ার পরও গভীর ছাপ রেখে যায়।

‘ট্রেন ড্রিমস’ কেবল সিনেমা নয়, ক্রমাগত বাণিজ্যিক সিনেমা আর অ্যালগরিদমময় ওটিটি দেখতে দেখতে হাঁপিয়ে ওঠা দর্শকের জন্য যেন এক ভিজ্যুয়াল উপহার। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সিনেমাটি আপনাকে মুগ্ধ করে রাখবে, প্রকৃতি আর মানুষের আশ্চর্য মেলবন্ধন ছুঁয়ে যাবে বারবার।

লো অ্যাঙ্গেলের ক্যামেরা, সূর্যাস্তের আলোয় ভেজা দৃশ্য, ভয়েসওভার আর প্রাকৃতিক দৃশ্যের হঠাৎ উদ্ভাসিত সৌন্দর্য চমকে দেবে। চিত্রগ্রাহক আদলফো ভেলোসো ও সুরকার ব্রাইস ডেসনারের সঙ্গে কাজ করে বেন্টলি ছবিটিকে স্মৃতি ও স্বপ্নের আবহ দিয়েছেন।

তবে এই ছবি এত শক্তিশালী হয়েছে, কারণ এটি নির্মম বাস্তবতা আর কবিতার সৌন্দর্যের মাঝখানে ভারসাম্য রক্ষা করতে পেরেছে। আদলফো জানিয়েছেন, সিনেমাটির ৯৮ শতাংশই প্রাকৃতিক আলোয় শুট করেছেন তাঁরা।

আরও পড়ুন

ছবির একেবারে শুরুতেই দেখা যায়—এক জোড়া বুট গাছে পেরেক মারা, বছরের পর বছর ধরে ঝুলে আছে। এমন কিছু দেখলে যেমন থমকে গিয়ে প্রশ্ন জাগে—কার ছিল? কী গল্প? ঠিক এই অনুভূতিটাই ছবির আত্মা। সাধারণ শ্রমিকের জীবনও এখানে পৌরাণিক সৌন্দর্য পায়। জীবন সাধারণ, আবার সেই জীবন সাধারণ হয়েও সুন্দর।

অভিনয় পরিচালনায়ও বেন্টলি অসাধারণ দক্ষ। কবিতার মতো ছবিতে অনেক সময় চরিত্র হারিয়ে যায়, কিন্তু এখানে অভিনেতারা তাঁদের চরিত্রের বাস্তবতাই ফুটিয়ে তুলেছেন। বিশেষ করে এজারটনের অভিনয়—কম কথা, বেশি দেখা, চোখ আর শরীরী ভাষায় গড়ে ওঠা এক চরিত্র। উইল প্যাটনের কণ্ঠে ভয়েসওভার এখানে গল্পকে নিয়ে গেছে অন্য আবহে।

‘ট্রেন ড্রিমস’ সিনেমার দৃশ্য। আইএমডিবি

এই ছবি দেখিয়েছে, পৃথিবী একই সঙ্গে সুন্দর ও নির্মম হতে পারে। আমরা আনন্দ আর যন্ত্রণা সমানভাবে বহন করি। ছবির শেষ দিকে কেরি কন্ডনের বলা একটি সংলাপ যেন পুরো ছবির সারকথা, ‘মরা গাছও জীবিত গাছের মতোই গুরুত্বপূর্ণ।’

এককথায় সিনেমাটি বিষণ্ন সুন্দর। দেখতে দেখতে মন খারাপ হবে, শেষ হওয়ার পর হয়তো সেই অনুভূতি আরও তীব্র হবে। তবু চলতি বছরের অন্যতম সেরা সিনেমাটি না দেখে উপায় কী?

‘ট্রেন ড্রিমস’ মনে করায়, আমরা একে অপরের সঙ্গে, আর মাটির সঙ্গে জড়িয়ে আছি—রেললাইনের মতো। এগিয়ে যাই, আবার এমন দাগ রেখে যাই, যা মুছতে প্রজন্ম লাগে। ভাগ্য ভালো হলে হয়তো কেউ কোনো দিন আমাদের গল্প বলবে।