এক সুন্দরীর খুনের পেছনের মর্মান্তিক সত্য কাহিনি

অবসেশন: মার্ডার অব আ বিউটি কুইন’-এর দৃশ্য। এইচবিও

৭ ডিসেম্বর এইচবিও ম্যাক্সে মুক্তি পেয়েছে তথ্যচিত্র ‘অবসেশন: মার্ডার অব আ বিউটি কুইন’। তথ্যচিত্রটিতে নব্বইয়ের দশকের শুরুতে পোল্যান্ডের অন্যতম প্রতিভাবান তরুণ মডেল অগ্নিয়েস্কা কোটলার্সকার জীবন ও মৃত্যুর গল্প নতুন করে তুলে ধরা হয়েছে। স্থানীয় সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার বিজয়ী থেকে আন্তর্জাতিক ফ্যাশনজগতের সম্ভাবনাময় মুখ হয়ে ওঠার যাত্রা কীভাবে এক ব্যক্তির বিকৃত আসক্তিতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়—সেই ভয়াবহ সত্যই এ তথ্যচিত্রের কেন্দ্রবিন্দু।

মঞ্চের আলো ও অগ্নিয়েস্কা কোটলার্সকার যাত্রা
১৯৭২ সালে পোল্যান্ডের ভ্রোৎসওয়াফ শহরে জন্ম অগ্নিয়েস্কা কোটলার্সকার। কিশোরী বয়সেই স্থানীয় মডেলিং জগতে তিনি নজর কাড়েন। ১৭ বছর বয়সে একটি স্থানীয় এজেন্সির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন এবং অল্প সময়ের মধ্যেই জাতীয় পর্যায়ে পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন।

তাঁর সাফল্যের গতি ছিল বিস্ময়কর। ১৯৯০ সালে মিস ভ্রোৎসওয়াফ, ১৯৯১ সালে মিস পোল্যান্ড এবং একই বছর টোকিওতে মিস ইন্টারন্যাশনাল খেতাব জিতে প্রথম পোলিশ হিসেবে বিশ্বমঞ্চে ইতিহাস গড়েন।

এই জয়ের পর নিউইয়র্ক, মিলান ও প্যারিসে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরু করেন তিনি। রালফ লরেন ও ক্যালভিন ক্লাইনের সঙ্গে কাজ করেন; ভোগ কসমোপলিটনে প্রচ্ছদ হন।

বিয়ে ও সন্তান
এই সময়েই তিনি জারোস্লাভ শ্ভিয়ঁটেককে বিয়ে করেন, যাঁর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে। দম্পতি কিছুদিন নিউইয়র্কে থাকেন, পরে ১৯৯৩ সালে ভ্রোৎসওয়াফে ফিরে এসে সংসার শুরু করেন। তাঁদের একটি কন্যাসন্তান জন্ম নেয়।

কী আছে তথ্যচিত্রে
পোল্যান্ডের মডেল অগ্নিয়েস্কা কোটলার্সকার উত্থান, জীবন এবং মর্মান্তিক মৃত্যুর গল্প তুলে ধরা হয়েছে তিন পর্বের এই তথ্যচিত্রে। এইচবিও ম্যাক্সে প্রচারিত এই সিরিজে দেখানো হয়েছে—পোল্যান্ডে স্থানীয় সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা থেকে শুরু করে কীভাবে তিনি মিস পোল্যান্ড জয় করেন এবং প্রথম পোলিশ নারী হিসেবে মিস ইন্টারন্যাশনাল খেতাব অর্জন করে বিশ্বমঞ্চে পরিচিত হয়ে ওঠেন। সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সামনে খুলে যায় আন্তর্জাতিক ফ্যাশন হাউসগুলোর দরজা এবং আসে বৈশ্বিক খ্যাতি। কিন্তু পর্দার আড়ালে তিনি যে ভয়াবহ বিপদের মুখোমুখি ছিলেন, সেই অন্ধকার দিকটিও উন্মোচন করে সিরিজটি। বছরের পর বছর ধরে চলা এক উত্ত্যক্তকারী কীভাবে ধীরে ধীরে প্রাণঘাতী সহিংসতায় রূপ নেয়—তারই বিস্তারিত বিবরণ উঠে এসেছে এই তথ্যচিত্রে। স্বামী ও ঘনিষ্ঠ প্রিয়জনদের আবেগঘন সাক্ষাৎকার, সংরক্ষিত আর্কাইভ ফুটেজ এবং ঘটনার পুনর্নির্মাণের মাধ্যমে তথ্যচিত্রটি একদিকে যেমন অবসেশন বা বিকৃত আসক্তির বিধ্বংসী প্রভাব তুলে ধরে, তেমনি উত্যক্ত করাকে একটি চলমান ও অত্যন্ত গুরুতর সামাজিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে।

১৯৯৬ সালে কোটলার্সকা মাতৃত্ব ও ক্যারিয়ার একসঙ্গে সামলাচ্ছিলেন। পাশাপাশি চলচ্চিত্রে কাজ করার পরিকল্পনাও করছিলেন। সে সময় তাঁকে পোল্যান্ডের অন্যতম সম্ভাবনাময় সাংস্কৃতিক রপ্তানি হিসেবেই দেখা হচ্ছিল।

এক বিকৃত আসক্তির শুরু
কোটলার্সকা জনপ্রিয় হওয়ার অনেক আগেই জেরজি লিসিয়েভস্কি নামের এক ব্যক্তি তাঁর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন। তদন্তকারীদের মতে, দোকানের জানালায় তাঁর একটি ছবি দেখে প্রথম নজর পড়ে তাঁর।

নব্বইয়ের দশকের শুরুতে এই আগ্রহ ধীরে ধীরে বিপজ্জনক আসক্তিতে রূপ নেয়। তিনি তাঁকে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে অনুসরণ করতেন, কথা বলার চেষ্টা করতেন, বাড়ির সামনে অপেক্ষা করতেন। কোটলার্সকা বারবার প্রত্যাখ্যান করলেও তাঁর পিছু নেওয়া থামেনি।

বিদেশে কাজ করতে যাওয়ার পরও লিসিয়েভস্কি তাঁকে চিঠি পাঠাতে থাকেন। একপর্যায়ে তিনি বিয়ের প্রস্তাবও পাঠান—চিঠিটি আদৌ তিনি পড়েছিলেন কি না, তা নিশ্চিত নয়।

অবসেশন: মার্ডার অব আ বিউটি কুইন’-এর দৃশ্য। এইচবিও

অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া: টিডব্লিউএ ফ্লাইট ৮০০
১৯৯৬ সালের জুলাইয়ে কোটলার্সকার প্যারিসে একটি আন্তর্জাতিক ফটোশুটে যাওয়ার কথা ছিল। শুরুতে তিনি নিউইয়র্ক হয়ে প্যারিসে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু স্বামীর পরামর্শে তিনি সরাসরি ওয়ারশ থেকে প্যারিসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, যা তাঁর জীবন বাঁচায়।

কারণ, নিউইয়র্ক থেকে প্যারিসগামী টিডব্লিউএ ফ্লাইট ৮০০ উড্ডয়নের পরপরই লং আইল্যান্ডের কাছে বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত হয়। সব যাত্রী নিহত হন, যাঁদের মধ্যে ছিলেন সেই আলোকচিত্রীরাও, যাঁদের সঙ্গে কোটলার্সকার কাজ করার কথা ছিল।

আরও পড়ুন

এ ঘটনা সংবাদমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। সেই খবর নজরে আসে লিসিয়েভস্কিরও। তিনি তখন পাবলিক টেলিফোন ডিরেক্টরি ব্যবহার করে ভ্রোৎসওয়াফে কোটলার্সকার নতুন ঠিকানা খুঁজে বের করেন। সে সময় পোল্যান্ডে উত্ত্যক্তকারীদের মোকাবিলার মতো কার্যকর আইন ছিল না।

খুনের দিন
১৯৯৬ সালের ২৭ আগস্ট, বেলা ২টা ৩০ মিনিটে লিসিয়েভস্কি কোটলার্সকার বাড়ির সামনে হাজির হন। তিনি তখন স্বামী ও আড়াই বছরের কন্যাসন্তানকে নিয়ে গাড়িতে বের হচ্ছিলেন।

অবসেশন: মার্ডার অব আ বিউটি কুইন’-এর পোস্টার। এইচবিও

লিসিয়েভস্কি জোর করে কথা বলতে চাইলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। বিপদ বুঝে শ্ভিয়ঁটেক পুলিশে ফোন করতে গেলে লিসিয়েভস্কি ছুরি বের করে তাঁর পায়ে আঘাত করেন। স্বামীকে বাঁচাতে এগিয়ে গেলে কোটলার্সকার ওপরই ছুরি চালান তিনি। একাধিক আঘাতে ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়।

খুনের পর লিসিয়েভস্কি ঘটনাস্থল ছেড়ে যান এবং পথচারীদের জানান যে তিনি একজনকে হত্যা করেছেন। এরপর শান্তভাবে পুলিশের অপেক্ষা করে। আদালতে তাঁর ১৫ বছরের কারাদণ্ড হয়। ২০১২ সালে মুক্তির পর ২০১৪ সালে আবার একটি সহিংস অপরাধে গ্রেপ্তার হন। বর্তমানে তিনি কারাগারের বাইরে।

বিচারের পর কোটলার্সকার স্বামী ও মেয়ে দেশ ছেড়ে চলে যান। এরপর আর তাঁদের প্রকাশ্যে দেখা যায়নি।

কোটলার্সকার উত্তরাধিকার
কোটলার্সকার মৃত্যুর পর পোল্যান্ডে তারকাদের উত্ত৵ক্ত করা ও নারী-নির্যাতন নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়।

পরে ২০১১ সালে পোল্যান্ডের দণ্ডবিধিতে ধারা ১৯০এ যুক্ত হয়, যেখানে উত্ত৵ক্ত করাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সর্বোচ্চ শাস্তি ৮ বছর কারাদণ্ড, আর ভুক্তভোগীর আত্মহত্যার ক্ষেত্রে তা বেড়ে ১৫ বছর হতে পারে।

২০২২ সালে কোটলার্সকার স্মরণে গড়ে ওঠে অগ্নিয়েস্কা কোটলার্সকা ফাউন্ডেশন, যারা ভুক্তভোগীদের কাউন্সেলিং, মানসিক সহায়তা ও আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছে।
প্রায় তিন দশক পর এই তথ্যচিত্র কোটলার্সকার গল্প নতুন করে সামনে নিয়ে এসেছে।

টাইম অবলম্বনে