বাংলাদেশ ও ভারতে একসঙ্গে শীর্ষে, কী আছে ধানুশের এই সিনেমায়

‘ইডলি কাড়াই’–এ ধানুশ ও নিত্যা মেনন। আইএমডিবি

নব্বইয়ের দশকের পারিবারিক আবহের সিনেমাগুলো যাঁরা মিস করেন, তাঁদের জন্য একটি উপভোগ্য সিনেমা ‘ইডলি কাড়াই’। এখনকার সিনেমা মানেই বিশাল বাজেট, চোখধাঁধানো অ্যাকশন আর ভিএফএক্সের বাড়াবাড়ি। এসব সিনেমার সঙ্গে অনেক দর্শকই নিজেকে মেলাতে পারেন না। সাধারণ গল্পের ড্রামা সিনেমা যেন আজকাল আর হয়–ই না। সেদিক থেকে আবেগ আর নস্টালজিয়ার মিশেলে ধানুশের এ সিনেমা যে একটু হলেও আপনাকে ছুঁয়ে যাবে, তা বলাই যায়। ১ অক্টোবর প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাওয়া সিনেমাটি এক মাস পেরোনোর আগেই দেখা যাচ্ছে স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম নেটফ্লিক্সে। ১০০ কোটি রুপি বাজেটের এ সিনেমা প্রত্যাশা অনুযায়ী দর্শক টানতে পারেনি। ভারতে ও দেশের বাইরে প্রায় ৭১ কোটি রুপি ব্যবসা করতে পেরেছে সিনেমাটি। তবে গত ২৯ অক্টোবর নেটফ্লিক্সে মুক্তির পর থেকেই সিনেমাটি নিয়ে আলোচনা চলছে অন্তর্জালে। নেটফ্লিক্স ইন্ডিয়া ও বাংলাদেশের তালিকার শীর্ষে রয়েছে সিনেমাটি। বক্স অফিসে ঝড় তুলতে না পারলেও এ সিনেমা যে দর্শকের মন ছুঁয়ে যাচ্ছে, তা বলাই যায়।

একনজরে
সিনেমা: ‘ইডলি কাড়াই’
নির্মাতা ও চিত্রনাট্যকার: ধানুশ
অভিনয়: ধানুশ, অরুণ বিজয়, সত্যরাজ, রাজকিরণ, নিত্যা মেনন, আর পার্থিবন, শালিনী পান্ডে, সামুথিরাকানি
স্ট্রিমিং: নেটফ্লিক্স
ধরন: ফ্যামিলি ড্রামা
রানটাইম: ২ ঘণ্টা ২৭ মিনিট

তামিল শব্দ ‘ইডলি কাড়াই’ মানে ইডলির দোকান। তাই গল্প যে একটি ইডলির দোকান ঘিরে, তা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। মুরুগানের (ধানুশ) বাবা শিবানেসান (রাজকিরণ) গ্রামের একটি ছোট ইডলির দোকান চালান। কিন্তু মুরুগানের স্বপ্ন বড় কিছু করার। সে তাঁর গণ্ডিকে এই ছোট্ট গ্রামে আটকে রাখতে চায় না। বড় চাকরি করার স্বপ্ন দেখে সে। শিবানেসান ছেলেকে গ্রামে রাখতে চাইলেও তার ইচ্ছার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ান না। কয়েক বছর এক ঝাঁ চকচকে অফিসে চাকরি পায় মুরুগান। নিজের চেষ্টায় এত দূরে এলেও প্রায়ই সহ্য করে যেতে হয় বস বিষ্ণু বর্ধনের (সত্যরাজ) ছেলে অশ্বিনের (অরুণ বিজয়) তুচ্ছতাচ্ছিল্য। এদিকে বিষ্ণু বর্ধনের মেয়ে মীরার (শালিনী পান্ডে) সঙ্গে তাঁর বাগ্‌দান হতে চলেছে। সফলতার চূড়ায় অবস্থান করলেও একটা ছোট্ট ঘটনা বদলে দেয় তাঁকে। নিজের অহংবোধ আর শিকড়—দুইয়ের মধ্যে সংঘাতে ভুগতে থাকে সে। শুরু হয় অন্তর্দ্বন্দ্ব! মুরুগান কি নিজের বর্তমান জীবন মেনে নেয়? নাকি শিকড়ের টানে ফিরে যায় গ্রামে? এই গল্পই দেখানো হয়েছে ‘ইডলি কাড়াই’ সিনেমায়।

‘ইডলি কড়াই’ সিনেমার দৃশ্য। আইএমডিবি

অভিনয়ের দিক থেকে ছবিটি দারুণ। পরিচালক হিসেবে আবেগকে কোথায় ধরতে হবে এ কথা ধানুশ জানেন। মুরুগানের চরিত্রে ধনুশ তাঁর সহজাত আকর্ষণ, সংবেদনশীলতা ও হাস্যরসকে একসঙ্গে মিশিয়ে চরিত্রকে বাস্তব রূপ দিয়েছেন। নিত্যা মেনন কায়াল চরিত্রে খুব ভালো করেছেন। তাঁর সংলাপ ও আবেগ এ সিনেমায় গতি আনে। ধনুশের সঙ্গে তাঁর রসায়নও উপভোগ্য ছিল। এর আগে ২০২২ সালে ‘থিরুচিত্রামবালম’ ছবিতে নিত্যা আর ধানুশকে একসঙ্গে দেখা গিয়েছিল। সে সিনেমার জন্য ভারতের জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছিলেন নিত্যা; এ ছবিতেও পর্দায় তাঁদের উপস্থিতি দেখতে ভালো লাগে।

বেপরোয়া অশ্বিন চরিত্রে অরুণ বিজয় ভালো। কিছু জায়গায় তাঁর প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছা বেশ বাড়াবাড়ি লাগে, তবে এই চরিত্রই গল্পে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে, গভীরতা আনে।
মুরুগানের বাবার চরিত্রে রাজকিরণ পুরো সিনেমার একটা নির্দেশক হিসেবে কাজ করেন। চরিত্র ছোট হলেও রাজকিরণ একজন মায়াবী পিতা ও গ্রামের মান্য ব্যক্তি হিসেবে সুন্দর অভিনয় করেছেন। পুলিশ আরিভুর চরিত্রে ছিলেন আর পার্থিবন। ছোট চরিত্র হলেও তাঁর উপস্থিতি ছিল হাস্যরসে ভরপুর। মীরা চরিত্রে শালিনী পান্ডের অভিনয় অতিনাটকীয়, ‘অর্জুন রেড্ডি’র ভক্তরা নিশ্চয়ই পুরোনো শালিনীকে মিস করবেন। ধানুশের সঙ্গের তাঁর সম্পর্কের দিকটা আরেকটু দেখাতে চরিত্রটি পূর্ণতা পেত। এ ছাড়া বিষ্ণু বর্ধন চরিত্রে সত্যরাজ ও মারিসামি চরিত্রে সামুথিরাকানি সাবলীল অভিনয় করেছেন।

‘ইডলি কড়াই’ সিনেমার দৃশ্য। আইএমডিবি

‘ইডলি কাড়াই’–এর টাইটেল ক্রেডিটে ধানুশ উল্লেখ করেছেন এই গল্প তাঁর শৈশবের জায়গা ও আশপাশের মানুষের দ্বারা অনুপ্রাণিত। ছবির শুরুর কাহিনি কিছুটা গৎবাঁধা লাগে। শুরু থেকেই বোঝা যায় একসময় মুরুগান ফিরে আসবে নিজের শিকড়ে। কিন্তু ধানুশের লেখনী ও অভিনয়ের দৃঢ়তা এই পুরোনো গল্পকেও নতুন আবেগে রাঙিয়ে তোলে। গল্পটি বাইরে থেকে সহজ মনে হলেও ধানুশ চিত্রনাট্য লেখায় নিজের মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। আবেগ, হাস্যরস, পারিবারিক বন্ধন, সংস্কৃতি ও সমাজের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বিষয়গুলো তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন সুন্দরভাবে। এখানে যেমন প্রাণ খুলে হাসার মতো দৃশ্য আছে, তেমনি কিছু দৃশ্য দেখে আপনার চোখের কোণে জল জমবে।

আরও পড়ুন

সিনেমায় নির্মাতা প্রশ্ন তুলেছেন, যারা বয়স্ক মা-বাবার কাছ থেকে দূরে সরে গিয়ে নিজের জীবন খুঁজে নিতে চাই, আমরা কি খারাপ? এই নৈতিক প্রশ্নের উত্তর যেন নির্মাতা ছবির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত খোঁজার চেষ্টা করেছেন। তবে সিনেমার এই জায়গা ঘিরেই হচ্ছে নানা আলোচনা-সমালোচনা।জীবনের গতিতেই যখন পরিবারকে পিছে ফেলে আসতে হয়, জীবিকার প্রয়োজনে যখন দেশান্তরি হতে হয়, এমন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে এ সিনেমা কিছুটা রক্ষণশীল বার্তা দেয়।

‘ইডলি কড়াই’ সিনেমায় ধানুশ। আইএমডিবি

কারিগরি দিক থেকেও ছবিটি ভালো। জি ভি প্রকাশ কুমারের আবহ সংগীত গল্পের আবেগকে আরও ভালোভাবে ফুটিয়ে তোলে। আবহ সংগীতে কোনো বাড়াবাড়ি নয়, বরং গল্পের সঙ্গে মানানসই। সিনেমার চিত্রগ্রহণ করেছেন কিরণ কৌশিক, সম্পাদনায় ছিলেন প্রসন্ন জিকে। তাঁদের কাজে গ্রামীণ সম্পর্কের উষ্ণতা আর সহজাত সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে।

সিনেমার কিছু দৃশ্য শেষ করার পরও মনে থাকে। একটি দৃশ্যে আমরা মুরুগানকে ভোরবেলা তার ঘরের দরজায় বসে বাইরে তাকিয়ে থাকতে দেখি। তার মুখ আমরা দেখি না, কিন্তু কায়াল (নিত্যা মেনন) যখন বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে, কেবল ফ্রেমিংয়ের মাধ্যমে দর্শক অনুভব করতে পারে মুরুগানের মনের ভার। কোনো আবহ সংগীত ছাড়াই ধানুশ দৃশ্যটি তৈরি করেছেন, যা ছাপ রেখে যায়।

‘ইডলি কড়াই’ সিনেমায় শালিনী পাণ্ডে। আইএমডিবি

‘ইডলি কাড়াই’ সিনেমার গল্প সাধারণ হলেও আপনি এ গল্পের সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারবেন। এ সিনেমা আপনাকে পুরোনো দিনের সেই সহজ, সুন্দর, উষ্ণ সম্পর্কের কথা মনে করিয়ে দেবে, পারিবারিক সম্পর্ক নিয়ে আরেকবার ভাবতে বাধ্য করবে। একটা সময় আপনি নিজেও হয়তো ভাববেন, আমরা কিসের পেছনে ছুটছি, কেন ছুটছি? এর অনুভূতিগুলো যেহেতু সর্বজনীন, তাই সব শ্রেণির দর্শকই সিনেমাটিতে দেখতে দেখতে নস্টালজিক হয়ে পড়বেন।  

‘ইডলি কাড়াই’–এ ধানুশ ও নিত্যা মেনন। আইএমডিবি