‘আমি এখনো কালোতালিকায় আছি’

২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন চলার সময় ফেসবুকে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে আটক হন কাজী নওশাবা আহমেদ। তার পর থেকে তাঁর কাজ কমে যায়। সে সময় আশপাশের মানুষগুলোও অচেনা হয়ে যান। আঁকড়ে ধরেন মঞ্চ। চরকিতে মুক্তি পাওয়া নুহাশ হুমায়ূনের ২ষ-এর ‘অন্তরা’ পর্ব দিয়ে বলা যায় তাঁর দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তন হয়েছে। তাঁর এই প্রত্যাবর্তন নিয়ে লিখেছেন মনজুরুল আলম

নুহাশ হুমায়ূনের ‘পেট কাটা ষ’-তেও ছিলেন নওশাবা। আছেন দ্বিতীয় মৌসুম ২ষ-এর ‘অন্তরা’ পর্বেও। এ সিরিজে সুযোগ দেওয়ার জন্য নির্মাতা নুহাশের কাছে কৃতজ্ঞ নওশাবা। ‘২০১৮ সালের পর আমার জীবনে সেরা কোনো কিছু পেলে সেটা আমি নুহাশ হুমায়ূনের কাছ থেকে পেয়েছি। আমাকে যখন কেউ ডাকে না, ডাকলেও নামমাত্র চরিত্রে ডাকে, সেখানে আমাকে এ উপহার দেয় নুহাশ। নামভূমিকায় আমি! মনে হলো, নিশ্বাস নেওয়ার সুযোগ মিলল। মনে হয়েছিল, অভিনেত্রী হিসেবে আমার স্বীকৃতি মিলল। এটাই ছিল অপেক্ষার উপহার,’ বলেন নওশাবা।

কাজী নওশাবা আহমেদ
খালেদ সরকার

শিল্পীসত্তার স্বীকৃতিতে বাধা
একাধিক সিনেমায় অভিনয় করলেও দীর্ঘদিন ধরে চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সদস্য হতে পারেননি। বাংলাদেশ টেলিভিশনের অডিশনেও তাঁকে ডাকা হয়নি। এই অভিনেত্রী বলেন, ‘শিল্পী সমিতিতে আবেদন করে লাভ হয়নি। আমার সিনেমাই যেখানে আটকে দেয়, সেখানে স্বীকৃতি তো বিলাসিতা। বিটিভিতেও আবেদন করেছিলাম কিন্তু অডিশনে বাদ দিয়েছে। বিটিভি থেকে একসময় এটাও বলা হয়েছে, আমাকে নিলে সেই নাটক প্রচারিত হবে না।’ তিনি জানান, কালেভাদ্রে কিছু কাজ করেছেন। সেসব শুটিংয়ে গিয়ে হতাশ হয়েছেন। একসময় আঁকড়ে ধরে বিষণ্নতা। ‘আমাকে বারবার রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে দেশের বাইরে চলে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু দেশ থেকে আমি পালিয়ে যাইনি। অভিনয় করব বলে অপেক্ষায় ছিলাম। আমার শিল্পীসত্তার স্বীকৃতির জন্য আমি আরও অপেক্ষা করে যাব।’

টিকটকার বনাম শিল্পী
শিল্পীদের যোগ্যতা দিয়ে বিচার করা হচ্ছে না। পুরোটাই ফেস ভ্যালু আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অনুসারী বিচারে কাজ পাচ্ছেন, মনে করেন নওশাবা। তিনি জানান, একজন পরীক্ষিত শিল্পীর চেয়ে টিকটকারের পারিশ্রমিক বেশি। এগুলো কীভাবে নির্ধারিত হয়, প্রশ্ন তোলেন তিনি। পারিশ্রমিকের এই বৈষম্য দিন দিন প্রকট হয়ে যাচ্ছে।

কাজী নওশাবা আহমেদ
প্রথম আলো

‘এভাবে শিল্পীরা অসহায়ত্বের মধ্যে পড়বেন, বলা ভালো পড়ছেন। একজন শিল্পী দিনের পর দিন পড়াশোনা করে, থিয়েটার করে, শিল্পীসত্তাকে ভালোবেসে নিজেকে তৈরি করেন। কিন্তু তাঁকে মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। এখন আমি যে নুহাশের “অন্তরা”–তে অভিনয় করেছি, একবারও কি আফজাল হোসেন বলেছেন, কেন নওশাবা? ওর তো অনুসারী নেই। এটা গল্পে, চরিত্রে মানানসই হয় বলে পরিচালক নির্বাচন করেন। সহশিল্পী কিন্তু চরিত্র ঠিক করে দেন না।’ হতাশ হয়ে তিনি আরও বলেন, ‘ভিউ দেখে কাস্টিং নির্বাচনের প্রক্রিয়াটা শিল্পীদের নিরুৎসাহিত করবে। তরুণেরা তখন চাইবে টিকটকার হতে।’

সার্টিফিকেশন বোর্ডের সদস্য
নওশাবা বর্তমানে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর সার্টিফিকেশন বোর্ডের সদস্য। জানালেন, বিচার শব্দটা তাঁর পছন্দ নয়। আর্টের কখনোই বিচার হয় না। তিনি বলেন, ‘আমি শুধু সিনেমা নিয়ে আমার মতামত দিতে পারি। এখানে সৃজনশীল কিছু করার নেই। তবে দেশের তরুণেরা যে চিন্তাচেতনা নিয়ে সিনেমা বানাচ্ছেন, সেটা মুগ্ধ করে।’

‘অন্তরা’য় নওশাবা। চরকির সৌজন্যে

একই সঙ্গে শিল্পী কল্যাণ ট্রাস্টের সদস্য হিসেবে কাজ করছেন নওশাবা। অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, ‘অভিনয়শিল্পীদের জায়গা থেকে আমার মনে হয়, সিনেমার শিল্পী–কলাকুশলীদের পারিশ্রমিক বকেয়া থাকে। প্রায়ই অভিযোগ পাওয়া যায়। সে ক্ষেত্রে সেন্সর সার্টিফিকেশন বোর্ড প্রাপ্য সম্মানী নিশ্চিতকরণে ভূমিকা রাখতে পারে। সবার পারিশ্রমিক দেওয়া হয়েছে, সেই মর্মে চুক্তিপত্র দেখিয়ে সিনেমা সেন্সরে জমা দেবেন প্রযোজক। তাহলে পেশাগত জায়গাটা বজায় থাকবে।’

ছিলেন রিমান্ডে
২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় ফেসবুকে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে আটক হন নওশাবা। গ্রেপ্তারের পর তাঁকে রিমান্ডে নেওয়া হয়। তার পর থেকে তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। জানালেন, ২১ দিন আটক ছিলেন। জীবনে আতঙ্কের সেই অধ্যায়ের কথা ভুলে এখন অভিনয় নিয়েই ব্যস্ত হতে চান।

আরও পড়ুন

নওশাবা বলেন, ‘আমার কোনো কিছু নিয়েই আক্ষেপ নেই। তাহলে শৈশব থেকেই এ আক্ষেপের শুরু হবে। ভালো স্কুলে পড়িনি। প্রতি স্তরে এমন বহু আক্ষেপ রয়েছে। শিল্পীদের কোনো আক্ষেপ থাকতে হয় না। আমার বাবা বলতেন, “সবকিছু থেকে নতুন অভিজ্ঞতা নিতে।” আমি সেই অভিজ্ঞতার মধ্যেই ছিলাম। ২০১৮ সাল থেকে জীবন আমাকে প্রতিটি ঘটনা থেকে অভিজ্ঞতা নিতে শিখিয়েছে।’

বর্তমান ব্যস্ততা
দীর্ঘ আট বছর ‘ব্যস্ত’ শব্দ থেকেই দূরে নওশাবা। জানালেন, সরকার পতনের পর ধরে নিয়েছিলেন তিনি নিয়মিত হতে পারবেন। কিন্তু ৫ আগস্টের পরও অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। ‘অন্তরা’ মুক্তির পর কাজটি নিয়ে অনেকেই প্রশংসা করেছেন।

কাজী নওশাবা আহমেদ
প্রথম আলো

কিন্তু নতুন কাজের জন্য এখনো ডাক পাননি। এই অভিনেত্রী মনে করেন, আগের সরকারের ভয়ে এখনো অনেকেই তাঁকে কাজে ডাকেন না। তাঁর ভাষ্যে, ‘আমি এখনো কালোতালিকায় আছি। কারণ, কেউ আমাকে কাজে নিচ্ছেন না। এত কাজ হচ্ছে কিন্তু আমাকে নিতে চান না ভয়ে। অডিশন দিয়েই কাজ করতে চাই। তা–ও হচ্ছে না। অভিনয় শিখেপড়ে আর কত পরীক্ষা দেব জানি না।’ নওশাবা এখন নিজের প্ল্যাটফর্ম ‘টুগেদার উই ক্যান’ নিয়ে ব্যস্ত। এই প্ল্যাটফর্ম থেকে শিশু, প্রতিবন্ধী ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে নানা সচেতনতামূলক বক্তব্য শিল্পের মাধ্যমে তুলে ধরেন।