নতুন খসড়া প্রণয়নের দাবি টিআইবির

অংশীজন ও বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় নতুন খসড়া প্রণয়নের দাবি জানিয়েছে টিআইটিকোলাজ

‘দ্য বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন রেগুলেশন ফর ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যান্ড ওটিটি প্ল্যাটফর্মস ২০২১’ নীতিমালার খসড়ার কয়েকটি ধারাকে সংবিধান পরিপন্থী বলে দাবি করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটি জানিয়েছে, খসড়ার বেশ কয়েকটি ধারা বাক্স্বাধীনতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন করবে এবং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো স্বনিয়ন্ত্রণে বাধ্য হবে। পাশাপাশি কয়েকটি ধারায় আইনের ইচ্ছেমতো ব্যাখ্যা ও অপব্যবহারের সুযোগ আছে, যা জনগণের কণ্ঠরোধে ব্যবহৃত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই অংশীজন ও বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় নতুন খসড়া প্রণয়নের দাবি জানিয়েছে তারা।

বিটিআরসির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত খসড়া নীতিমালা নিয়ে গত রোববার আয়োজিত ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলনে নিজেদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে টিআইবি। খসড়াটিতে সংশ্লিষ্ট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অযৌক্তিক নীতি কাঠামোর আওতায় এনে বার্তার উত্স শনাক্তকরণের শর্ত প্রতিপালনে এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশনের শর্ত ভাঙার যে অন্যায় সুবিধা তৈরি করা হচ্ছে, তা ব্যক্তিগত যোগাযোগের গোপনীয়তার সংবিধান স্বীকৃত অধিকারকে খর্ব করবে বলেও মনে করছে তারা।

ধারা ৩-এ নীতিমালাটির উদ্দেশ্য যেভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, সেটা যতটা না ইন্টারনেট বা অনলাইন–সম্পর্কিত, তার চেয়ে বেশি টেলিকমিউনিকেশন ও সম্প্রচার–সম্পর্কিত। নীতিমালার ৪ ও ৫ ধারায় নীতিমালার উদ্দেশ্যগুলো ও ‘অনলাইন সেবা প্রদানকারী’ সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন সনদ বা অনুমতিপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে যেসব শর্ত আরোপ করা হয়েছে, তা মূলত প্রচলিত টেলিকমিউনিকেশন সেবা প্রদানকারী (ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী ও মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটর) প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এ ক্ষেত্রে আরও দূরদর্শী ও সাবধানতার সঙ্গে অগ্রসর হওয়া জরুরি বলে মত দিয়েছে টিআইবি।

টিআইবি মনে করে, অন্যের কনটেন্ট শুধু প্রচার ও প্রকাশে সহায়তা করার কারণে মধ্যস্থতাকারীদের জন্য শাস্তির যে বিধান রাখা হয়েছে এবং তা থেকে নিষ্কৃতি পেতে সুরক্ষাবলয়ের অনুপস্থিতি সংবিধান পরিপন্থী। মধ্যবর্তী সেবাদানকারী মাধ্যমের জন্য সুরক্ষার বিধান না করা হলে, জরিমানা এড়াতে তারা ‘আত্মনিয়ন্ত্রণের’ জায়গা থেকে কনটেন্ট পরিবেশনে অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করবে, এর ফলে স্বাধীন মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে অযাচিত প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হবে, যা সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে স্বীকৃত মৌলিক অধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

প্রজ্ঞাপন জারির কমপক্ষে দুই বছর অতিবাহিত হলে খসড়া নীতিমালাটি কার্যকর করা, অনলাইনের ক্ষতিকর দিক নিয়ন্ত্রণ, ক্ষতিকর কনটেন্ট থেকে ভোক্তা, নিত্য ঝুঁকির সম্মুখীন হওয়া জনগোষ্ঠীকে (নারী, শিশু, গণমাধ্যমকর্মী, সরকার বা কর্তৃপক্ষের সমালোচনাকারী) সুরক্ষা দেওয়া, সুবিন্যস্ত ও সুশৃঙ্খলভাবে কনটেন্ট পরিবেশনের স্বার্থে ‘সেবা প্রদানকারীর’ সৃজনশীলতাকে সুরক্ষা দেওয়া।

একই বিষয় নিয়ে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় এবং বিটিআরসি পৃথক নীতিমালা প্রণয়ন করছে। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় ‘ওভার দ্য টপ (ওটিটি) কনটেন্টভিত্তিক পরিষেবা প্রদান এবং পরিচালনা নীতিমালা-২০২১ (খসড়া)’ তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে। একই বিষয়ে বিটিআরসি এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় পৃথকভাবে কেন নীতিমালা প্রণয়ন করছে; একই ক্ষেত্রে দুটি পৃথক সংস্থা প্রণীত নীতিমালা কীভাবে বাস্তবায়ন ও কার্যকর করা হবে, সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোনো নির্দেশনাবলি উল্লেখ না থাকায় টিআইবি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সর্বোপরি তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের ইন্টারনেটভিত্তিক পরিষেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো যথেষ্ট আইনি সক্ষমতা আছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে সংস্থাটি।

তাদের মত, নীতিমালার মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত একদিকে যেমন ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া ও ওটিটি প্ল্যাটফর্মের ক্ষতিকর কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণ করা, অন্যদিকে জনগণ যাতে এই প্ল্যাটফর্ম নিরাপদে ব্যবহার করে সংবিধানসম্মতভাবে বাক্‌স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার প্রয়োগের নিশ্চয়তা পায়, তার বিধান করা। কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণের নামে ভারসাম্যহীন প্রতিবন্ধকতা চাপিয়ে দিয়ে ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া ও ওটিটি প্ল্যাটফর্মে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য উপযোগী পরিবেশ নষ্ট করা হলে তা হবে ‘মাথাব্যথার কারণে মাথা কেটে ফেলা’র মতো।

আরও পড়ুন

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘নীতিমালায় শুধু নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়েছে এবং এর কোনো কোনো ধারা, যেমন ঢালাওভাবে কনটেন্ট অপসারণের বাধ্যবাধকতা, বহুমতভিত্তিক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নে ঝুঁকি সৃষ্টি করবে। এ ছাড়া পরস্পরবিরোধী ধারার পাশাপাশি অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহৃত শব্দপুঞ্জের সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা না থাকায় এই নীতিমালার অপব্যবহারেরও সুযোগ রয়েছে। খসড়া নীতিমালায় এমন কিছু ধারা রয়েছে, যা বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ একটি নজরদারিভিত্তিক রাষ্ট্রে পরিণত হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশের যে অঙ্গীকার ও সম্ভাবনা, তার সঙ্গে এই খসড়া নীতিমালা কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ, তা খতিয়ে দেখা জরুরি। আমাদের পরামর্শ হচ্ছে, অন্যান্য দেশের ইতিবাচক চর্চার অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা এবং বাংলাদেশের বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও অংশীজনকে সম্পৃক্ত করে খসড়া নীতিমালাটিকে ঢেলে সাজানো।’

নতুন খসড়ার দাবিতে বেশ কিছু সুপারিশ দিয়েছে টিআইবি। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে খসড়া নীতিমালাটির প্রয়োগ শুধু বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা এবং ‘ইন্টারনেটভিত্তিক সেবা প্রদানকারী’, ‘সেবা’ অথবা ‘অ্যাপ্লিকেশন’ ধারণাগুলোর সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা ও সংজ্ঞা নির্ধারণ করা। উচ্চ আদালতের সম্মতি, বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০১-এর ৯৯ ধারায় বর্ণিত প্রক্রিয়া যথাযথভাবে অনুসৃত হওয়া এবং প্রজ্ঞাপন জারির কমপক্ষে দুই বছর অতিবাহিত হলে খসড়া নীতিমালাটি কার্যকর করা, অনলাইনের ক্ষতিকর দিক নিয়ন্ত্রণ, ক্ষতিকর কনটেন্ট থেকে ভোক্তা, নিত্য ঝুঁকির সম্মুখীন হওয়া জনগোষ্ঠীকে (নারী, শিশু, গণমাধ্যমকর্মী, সরকার বা কর্তৃপক্ষের সমালোচনাকারী) সুরক্ষা দেওয়া, সুবিন্যস্ত ও সুশৃঙ্খলভাবে কনটেন্ট পরিবেশনের স্বার্থে ‘সেবা প্রদানকারীর’ সৃজনশীলতাকে সুরক্ষা দেওয়া, ব্যক্তি অধিকার, বাক্ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার মতো মৌলিক অধিকারগুলোর সুরক্ষা দেওয়া, বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানার ভেতরে ও বাইরে অবস্থানকারী উভয় ধরনের সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানকে সমভাবে সুযোগ দেওয়া ও মূল্যায়ন, সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ক্ষতিপূরণ বা প্রতিকারের বিধান নিশ্চিত করা, অপ্রাপ্তবয়স্ক ব্যবহারকারীদের স্বার্থ রক্ষায় অনলাইন কনটেন্টের ক্ষেত্রে অভিভাবকদের নিয়ন্ত্রণের সুযোগ নিশ্চিত করা, মেধাস্বত্ব মালিকানার সুরক্ষা দেওয়া ইত্যাদি।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান ছাড়াও সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সংস্থাটির উপদেষ্টা (নির্বাহী ব্যবস্থাপনা) সুমাইয়া খায়ের। খসড়া নীতিমালা নিয়ে টিআইবির অবস্থান উপস্থাপন করেন সংস্থাটির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মন্‌জুর-ই-আলম।