রুনা লায়লাকে নিয়ে আফজাল হোসেনের আবেগঘন পোস্ট
কোক স্টুডিও বাংলার তৃতীয় মৌসুমে জনপ্রিয় সুফিগান ‘মাস্ত কালান্দার’গেয়েছেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী রুনা লায়লা। ১৭ নভেম্বর রুনা লায়লার জন্মদিন সামনে রেখে গানটি প্রকাশ পেয়েছে। এটি দিয়ে তৃতীয় মৌসুম শেষ হয়েছে। গানপ্রেমীদের পাশাপাশি বিনোদন অঙ্গনের মানুষদেরও মন কেড়েছে এই গান। অভিনয়শিল্পী, চিত্রকর ও নির্মাতা আফজাল হোসেন নতুন সংগীতায়োজনে ‘মাস্ত কালান্দার’ শুনে মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন। নিজের ফেসবুকে এ নিয়ে একটি পোস্ট দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, কোক স্টুডিও বাংলাতে “মাস্ত কালান্দার”শুনে সকালটা সুন্দর হয়ে গেল।
‘মাস্ত কালান্দার’ গানটি নিয়ে রুনা লায়লা বলেন, ‘এটি সব সময় আমার হৃদয়ের খুব কাছের একটি গান। নতুনভাবে, তরুণ শিল্পীদের সঙ্গে আবার গানটি গাইতে পেরে আমি আনন্দিত। প্রজন্ম-পরম্পরায় গানটির নতুনভাবে ফিরে আসা আমাকে আনন্দ দিয়েছে।’
রুনা লায়লার গাওয়া ‘মাস্ত কালান্দার’ শুনে এক আবেগঘন লেখায় শিল্প-সংস্কৃতি, সমাজে সৌন্দর্যবোধের সংকট ও সৃজনশীল মানুষের মূল্যায়ন নিয়েও নিজের ভাবনা তুলে ধরেছেন আফজাল হোসেন। পোস্টের শুরুতেই আফজাল হোসেন উল্লেখ করেন, নিয়মিত জীবনযাপনে আমরা কত অনর্থক, অসুন্দর ও অপ্রয়োজনীয় চিন্তায় দিন কাটাই। মানুষের জীবনে অর্থবোধ, প্রেরণা ও সঠিক দিশা খুঁজে পেতে কত কম সময় আমরা ব্যয় করি—সেই প্রশ্নও তোলেন তিনি। নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের বিখ্যাত সংলাপ—‘বেঁচে থাকাটা বড় কথা নয়, কীভাবে বেঁচে আছি সেটাই বড়’—উদাহরণ হিসেবে টেনে আনেন তিনি।
এরপর আফজাল হোসেন লিখেছেন সৃজনশীল মানুষের বাস্তবতা, সমাজের উপেক্ষা ও একই সঙ্গে সৃষ্টিশীলতার শক্তি নিয়ে। তাঁর ভাষায়, চিত্রকর জানেন দেশে ছবি আঁকা কতটা গুরুত্ব পায়; তবু তিনি দুঃখিত হন না; কারণ, শিল্পী আঁকতে পারার মধ্যেই নিজের সৌভাগ্য খুঁজে পান। লেখক জানেন, সাহিত্য নিয়ে মানুষের আগ্রহ কম; তবু নিজের অনুভব, ভাবনা ও বিশ্বাসের প্রকাশ ঘটিয়ে লেখেন। লেখক যদি না লিখতে পারেন, তিনি বেঁচে থেকেও মৃত।
দেশে সৃজনশীল মানুষের অবদান ও ভূমিকার প্রতি সমাজের অনীহা নিয়ে আফজাল হোসেন তাঁর লেখায় আক্ষেপ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘তবু শিল্পীরা নিবিষ্ট মনে কাজ করে যান—কণ্ঠশিল্পী গানেই খুঁজে পান সুখ, লেখক অর্থবিত্তের আশা না করে লিখে যান মনের আনন্দে। এই নিবেদন তিনি দেখেন সমাজকে বাঁচিয়ে রাখা একটি নীরব শক্তি হিসেবে।’
রুনা লায়লাকে নিয়ে লেখায় আফজাল হোসেনের আবেগ ফুটে ওঠে। তিনি লিখেছেন, ‘রুনা লায়লা অসাধারণ একজন শিল্পী, অল্প কথায় এটাই তাঁর পুরো পরিচয়। সে পরিচয় এতটা বড়, শিল্পী পরিচয়ের আলোতে আলোকিত হতে পারে একটা পুরো দেশ। দেশের একমাত্র শিল্পী, যিনি পাকিস্তান এবং ভারতের শ্রোতাদের কাছেও তুমুল জনপ্রিয়, সম্মানীয়। এমন শিল্পীর বিষয়ে আমরা কতটুকু মনোযোগী?’
রুনা লায়লার জন্মদিন উপলক্ষে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের বিশেষ আয়োজন তাঁকে আশাবাদী করেছে। বিশেষ করে মাছরাঙা টিভির অনুষ্ঠানে পাকিস্তান ও ভারতের শিল্পীদের আন্তরিক মন্তব্যে তিনি বিস্ময় ও আনন্দ খুঁজে পেয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘মাছরাঙা টেলিভিশন চ্যানেলের একটা অনুষ্ঠানে অন্য দেশের শিল্পী কলাকুশলীরা আমাদের রুনা লায়লাকে নিয়ে যেসব হৃদয়খোলা মন্তব্য করেছেন, সাধ্য অনুযায়ী যেভাবে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন—কোনো শিল্পী, সৃজনশীল মানুষের প্রতি অত উদারভাবে শ্রদ্ধা ভালোবাসা জানানোর অভ্যাস আমরা কি গড়ে তুলতে পেরেছি?’
সমাজের সামগ্রিক অসংলগ্নতা ও বিভেদ প্রসঙ্গেও লিখেছেন আফজাল হোসেন। তিনি লিখেছেন, ‘আমরা বলি দেশ ভালোবাসি, কিন্তু দেশের জন্য ক্ষতিকর ভাবনায় শামিল হয়ে যাই। যারা মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে, ঘৃণা ছড়িয়ে বেড়ায়, সভ্যতার ক্ষতি করে তাদের অনুসারী হয়ে, তাদেরকে মান্য করে অনেক অনেক গর্ববোধ করি। জেগে থাকার অধিকাংশ সময়ই আমরা কাটিয়ে দিই অদরকারি কথা, কুতর্ক ও মানুষকে অসম্মান অমর্যাদা করার চেষ্টায়। গুরুত্ব পাওয়ার মতো বহু বিষয়ের প্রতি অমনোযোগী হওয়ার কারণে অসংখ্য প্রদীপ তেলহীন, নিভু নিভু। নিজ নিজ ঘরে আলো থাকলেই আমরা জীবন মুখর আছে ভাবি। এমন অসচতেনতায় জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে সৌন্দর্যবোধ।’
এসব অন্ধকারের মধ্যেও কোক স্টুডিও বাংলার ‘মাস্ত কালান্দার’ তাঁর মনে আলো জ্বেলেছে। তিনি লিখেছেন, ‘কোক স্টুডিওতে যেভাবে রুনা লায়লাকে উপস্থাপন করা হয়েছে, তা শুধু তাঁর গান শোনা ও দেখার অভিজ্ঞতা নয়, মনে হয়েছে সমগ্র আয়োজন যেন এ অসাধারণ শিল্পীর প্রতি বিশেষভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন করা। ভালোবাসা, শ্রদ্ধাজ্ঞাপন ও চমৎকার যত্নের জন্য কোক স্টুডিও বাংলাকে ধন্যবাদ। শিল্পী ও দর্শক শ্রোতার প্রতি সম্মান প্রদানের এমন আন্তরিক চেষ্টা আনন্দিত করে, আশা জাগায়। মাঝে মাঝে অনুভব করা দরকার, আলো নিভতে না দেওয়া মানুষ দেশে আছে, আছে বলেই মাঝে মাঝে আচমকা বিস্ময়, আনন্দ ও প্রাণের উষ্ণতা এসে এভাবে জীবনকে বুঝিয়ে দেবে, বেঁচে থাকা আসলেই সুন্দর। নতুন করে প্রাণ পাওয়া রুনা লায়লা ও “মাস্ত কালান্দার”জীবনে যোগ করেছে নতুন বিস্ময়, আলাদা রঙের আনন্দ। আমাদের প্রেমে, শ্রদ্ধায় আপনি দীর্ঘায়ু হোন রুনা লায়লা।’