তুই আর আমি কোচবিহার চলে যাই, টুক করে...
পল্লিগীতির অগ্রপথিক আব্বাসউদ্দীন আহমদ ও তাঁর মা লুৎফুন্নেসা আব্বাসের তিন সন্তান। দুই ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল ১০ বছর আগে মারা যান। দেশবরেণ্য সংগীতশিল্পী দুই ভাই–বোন মুস্তাফা জামান আব্বাসী ও ফেরদৌসী রহমান বেঁচে ছিলেন। কয়েক বছর ধরে দুই ভাই–বোন নানা ধরনের শারীরিক জটিলতায় দিন পার করছিলেন। এর মধ্যে গতকাল শনিবার ভোরে মারা যান মুস্তাফা জামান আব্বাসী। বড় ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শুনেছেন ছোট বোন ফেরদৌসী রহমান।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী বেশ কিছুদিন কথাবার্তা বলতে পারতেন না। বাসায় কেউ গেলে তাকিয়ে থাকতেন। গত বৃহস্পতিবার মুস্তাফা জামান আব্বাসীকে তাঁর গুলশানের বাসায় দেখতে গিয়েছিলেন ছোট বোন বরেণ্য সংগীতশিল্পী ফেরদৌসী রহমান। এদিন তিনি ভাইয়ের পাশে অনেকক্ষণ বসে ছিলেন। মাথায় হাত বুলিয়েছেন। হাত ধরেছেন। কিন্তু তাঁদের দুজনের মধ্যে কোনো ধরনের কথাবার্তা হয়নি। বৃহস্পতিবারের দেখাটাই দুই ভাই–বোনের জীবিত অবস্থায় শেষ দেখা হয়ে রইল।
সেদিনের স্মৃতি প্রথম আলোর কাছে এভাবেই তুলে ধরলেন ফেরদৌসী রহমান, ‘সেদিন ভাইয়ের পাশে অনেকক্ষণ বসে ছিলাম। মনটা খুব খারাপ করে বসে ছিলাম। কোনো কথা বলছিল না। তারপর আমি বললাম, বউ (আব্বাসীর স্ত্রীকে বউ বলে ডাকতেন ফেরদৌসী রহমান) চলে গেল। রেজাও (ফেরদৌসী রহমানের স্বামী রেজাউর রহমানের ডাকনাম) চলে গেল আমাকে না বলে। তোর কী ইচ্ছা, আমাকে বল? চল, আমরা একটা কাজ করতে পারি—তুই আর আমি হাত ধরাধরি করে বলরামপুর, কোচবিহার চলে যাই, টুক করে। দার্জিলিং চলে যাই। আমরা কাউকে কিছু বলব না। আমাদের কেউ খুঁজেও পাবে না। এ কথা শোনার পর নড়লচড়ল। মনে হচ্ছিল, কথাটা ওকে স্পর্শ করেছে। এরপর হাত দুটি ওপরের দিকে তুলল। আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমার মুখটা ধরার চেষ্টা করল। পরে আমি ওর একটা হাত ধরলাম। এটাই ছিল ওর সঙ্গে শেষ কথা। বৃহস্পতিবার জীবিত ভাইয়ের সঙ্গে শেষ দেখা।’ বলেই কাঁদতে লাগলেন ফেরদৌসী রহমান।
এদিকে ভাই মুস্তাফা জামান আব্বাসীর মৃত্যুসংবাদে শোকাহত ফেরদৌসী রহমান ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘খুবই দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে আমার ভাই মুস্তাফা জামান আব্বাসী, যাঁকে আপনারা একজন মহান শিল্পী, গায়ক এবং লেখক হিসেবে জানেন, তিনি আজ সকালে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তিনি তাঁর দুই কন্যা সামিরা ও শারমিনী এবং আত্মীয়স্বজন ও ভক্তদের একটি বড় দল রেখে গেছেন, যাঁরা তাঁর মৃত্যুতে শোকাহত। অনুগ্রহ করে তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করবেন।’
ঢাকার আজিমপুরে একই কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন মুস্তাফা জামান আব্বাসীর বাবা আব্বাসউদ্দীন আহমদ ও তাঁর মা লুৎফুন্নেসা আব্বাস। মা–বাবার কবরে দাফন করা হয়েছে তাঁদের সন্তান দেশের বরেণ্য সংগীতশিল্পী, গবেষক ও লেখক মুস্তাফা জামান আব্বাসীকে। তার আগে বাদ জোহর গুলশান আজাদ মসজিদে মুস্তাফা জামান আব্বাসীর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা উপস্থিত ছিলেন। পরিবারের পক্ষ থেকে প্রথম আলোকে খবরটি জানিয়েছেন মুস্তাফা জামান আব্বাসীর নাতি আলভী আশরাফ।
বনানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান মুস্তাফা জামান আব্বাসী। প্রথম আলোকে মুস্তাফা জামান আব্বাসীর ছোট মেয়ে শারমিনী আব্বাসী জানান, তাঁর বাবার বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। তিনি দুই মেয়ে এবং বহু ভক্ত–অনুরাগী রেখে গেছেন।
মেয়ে শারমিনী আব্বাসী জানান, বেশ কিছুদিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন মুস্তাফা জামান আব্বাসী। সর্বশেষ গত শুক্রবার শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। গতকাল ভোর সাড়ে পাঁচটায় তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন।
বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী মুস্তাফা জামান আব্বাসী উপমহাদেশের খ্যাতনামা সংগীত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বাবা আব্বাসউদ্দীন ছিলেন পল্লিগীতির অগ্রপথিক। এ দেশের পল্লিগীতিকে তিনিই প্রথম বিশ্বের সব দেশে জনপ্রিয় করেছেন। চাচা আবদুল করিম ছিলেন পল্লিগীতি ও ভাওয়াইয়া-ভাটিয়ালির জনপ্রিয় শিল্পী। মুস্তাফা জামান আব্বাসীর বড় ভাই মোস্তফা কামাল ছিলেন প্রধান বিচারপতি। বোন ফেরদৌসী রহমান ও ভাতিজি নাশিদ কামালও সংগীতাঙ্গনে সুপ্রতিষ্ঠিত। তাঁর স্ত্রী আসমা আব্বাসী একজন প্রথিতযশা শিক্ষক ও লেখিকা। তিনি গত বছর মারা গেছেন।