লতা মঙ্গেশকরের অজানা কথা

আজ লতা মঙ্গেশকরের জন্মদিনকোলাজ

আজ ২৮ সেপ্টেম্বর। বেঁচে থাকলে ৯৬ বছরে পা দিতেন ভারতীয় সংগীতের কিংবদন্তি শিল্পী লতা মঙ্গেশকর। সাত দশক ধরে তিনি মুগ্ধ করে গেছেন সারা বিশ্বের শ্রোতাকে। ১৯২৯ সালের এই দিনে ভারতের মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে জন্মেছিলেন তিনি। ভারতীয় সংগীতের সীমানা পেরিয়ে তাঁর কণ্ঠ ছুঁয়েছিল আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল। জনপ্রিয় এই শিল্পীকে ঘিরে রয়েছে অসংখ্য জানা–অজানা গল্প। জন্মদিনে তাঁকে স্মরণ করে থাকল তাঁর জীবন থেকে কিছু অজানা কাহিনি—

হেমা থেকে লতা
লতা মঙ্গেশকরের নাম শুরুতে ‘লতা’ ছিল না। জন্মের পর তাঁর নাম দেওয়া হয়েছিল হেমা। বাবা পণ্ডিত দীননাথ মঙ্গেশকরের ‘ভাও বন্ধন’ নাটকে লতিকা নামের একটি বিখ্যাত চরিত্রের নাম অনুসারে তিনি হয়ে যান লতা। আর মঙ্গেশকর পরিবারের পদবি ছিল হার্দিকর। দীননাথ এই হার্দিকর পরিবর্তন করে করেন মঙ্গেশকর।

শৈশবের লতা মঙ্গেশকর
ফেসবুক থেকে

২৫ টাকার প্রথম উপার্জন
মাত্র ১৩ বছর বয়সে একটি অনুষ্ঠানে গান গেয়ে লতা প্রথম পারিশ্রমিক পান। টাকার অঙ্ক ছিল মাত্র ২৫। সেই সামান্য অঙ্ক থেকেই শুরু হয় মহাকাব্যিক এক যাত্রা।

স্কুলে গিয়ে বিপত্তি
জীবনে মাত্র এক দিন স্কুলে গিয়েছিলেন লতা। সেদিনই সহপাঠীদের গান শেখাতে শুরু করেছিলেন। শিক্ষক এতে ক্ষুব্ধ হন। এরপর আর স্কুলে যাননি তিনি। আনুষ্ঠানিক শিক্ষার পথ সেখানেই থেমে যায়।

চা–বিস্কুটেই দিন কাটত
যতীন মিশ্রর বই ‘লতা সুর গাঁথা’য় আছে, রেকর্ডিংয়ের দিন তিনি প্রায়ই শুধু এক কাপ চা আর কয়েকটি বিস্কুট খেয়ে দিন কাটাতেন। কখনো কেবল পানি খেয়েই ঘণ্টার পর ঘণ্টা রেকর্ডিং করেছেন।

আরও পড়ুন
লতা মঙ্গেশকর
এক্স থেকে

ক্রিকেটপ্রেমী লতা
লতা ছিলেন ক্রিকেটের একনিষ্ঠ ভক্ত। রাজ সিং দুঙ্গারপুরের ঘনিষ্ঠতার সুবাদে ক্রিকেটে আরও আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি। শচীন টেন্ডুলকারের প্রতি তাঁর ছিল বিশেষ স্নেহ। শচীনকে তিনি উপহার দিয়েছিলেন নিজের হাতে লেখা দুটি গানের কপি।

প্রিয় আইসক্রিম খেতেন না
গলার যত্নে ছিলেন অতি সচেতন। তাই আজীবন আইসক্রিম খাননি তিনি। রাজ সিং দুঙ্গারপুর একবার বলেছিলেন, ভালোবাসলেও আইসক্রিম ছুঁয়ে দেখেন না লতা।

ছদ্মনামে সুরকার
লতা শুধু গেয়েছেন তা–ই নয়, সুরও করেছেন। তবে ছদ্মনামে—আনন্দ ঘন নামে। এক পুরস্কার অনুষ্ঠানে এই নামে বিজয়ী ঘোষণা করা হলে কেউ মঞ্চে উঠছিলেন না। শেষে নিজেই উঠে পুরস্কার নেন লতা, তখনই প্রকাশিত হয় রহস্য।

টানা ৮ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে গান
২০০৬ সালে ‘রং দে বসন্তী’ ছবির জন্য এ আর রহমানের সুরে ‘লুকাছুপি’ গানটি রেকর্ড করেন তিনি। পরিচালক রাকেশ ওমপ্রকাশ মেহরা জানিয়েছেন, লতা আট ঘণ্টা দাঁড়িয়ে গানটি রেকর্ড করেছিলেন। পাশে চেয়ার থাকলেও একবারও বসেননি।

লতা মঙ্গেশকর
ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে নেওয়া

যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম কনসার্ট
১৯৭৫ সালে লস অ্যাঞ্জেলেসে প্রথম আন্তর্জাতিক কনসার্ট করেন তিনি। ছয় হাজার দর্শকের সামনে হাজির হয়েছিলেন খালি পায়ে, সাদামাটা সাদা–বেগুনি পাড়ের শাড়ি পরে, আর হাতে ছিল নিজের লেখা গানের খাতা। তারকাখ্যাতি থাকা সত্ত্বেও নিজেকে রাখতেন একেবারেই সাধারণ।

মৃত্যুর সামনে দুর্বল মন
মঞ্চে ছিলেন দুর্ধর্ষ, কিন্তু মৃত্যুর সামনে ভীষণ দুর্বল। মায়ের মৃত্যুর সময় মায়ের পা জড়িয়ে কেঁদে ফেলেছিলেন, চোখের দিকে তাকাতে পারেননি। কিশোর কুমারের মৃত্যুর সংবাদে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।

অভিনয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া
শৈশবে অর্থকষ্টে কিছু ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। কিন্তু আলো, ক্যামেরা, মেকআপে তাঁর মন বসেনি। তাই গানের বাইরে আর কিছুতে নিজেকে জড়াননি। রাজ কাপুর তাঁকে নিয়ে ছবি করতে চাইলেও তিনি কেবল গেয়েছিলেন ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’ ছবিতে।

৩৬ ভাষায় গান
লতা প্রায় ৩৬টি ভাষায় গান গেয়েছেন। এর মধ্যে বাংলায় অসংখ্য কালজয়ী গান আছে—‘প্রেম একবার এসেছিল নীরবে’, ‘ও মোর ময়না গো’, ‘ও পলাশ ও শিমুল’ ইত্যাদি।

আরও পড়ুন
পোষ্য ভালোবাসতেন লতা মঙ্গেশকর। তাঁর দুই পুরোনো সঙ্গী গুড্ডু আর বুড্ডু
ইনস্টাগ্রাম

রাজ্যসভার সদস্য
১৯৯৯ সালে ভারতের সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার সদস্য মনোনীত হয়েছিলেন তিনি। তবে অসুস্থতার কারণে সংসদ অধিবেশনে খুব বেশি অংশ নিতে পারেননি।

আশার সঙ্গে বিবাদ
বোন আশা ভোঁসলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক একসময় খারাপ হয়ে যায়। কারণ ছিল আশার প্রথম স্বামী গণপতরাও ভোঁসলে। তিনি আশাকে লতার বাড়িতে যাওয়া বন্ধ করতে বাধ্য করেছিলেন। তবে পরে আশার দ্বিতীয় স্বামী আরডি বর্মন দুই বোনকে আবার কাছে আনেন।

রফির সঙ্গে বিবাদ
রয়্যালটি নিয়ে মতবিরোধের কারণে প্রায় তিন বছর মোহাম্মদ রফির সঙ্গে কোনো গান করেননি লতা। পরে অবশ্য আবার একসঙ্গে কাজ করেছেন। তবে এ ঘটনা নিয়ে এখনো নানা বিতর্ক আছে।

পাঁচ বছর বয়সে অভিনয়
মাত্র পাঁচ বছর বয়সে অভিনয়ে নামেন লতা। বাবার সংগীতনাট্যে তিনি মঞ্চে ওঠেন। সেখান থেকেই শুরু হয় তাঁর ক্যামেরার সামনে যাত্রা।

আরও পড়ুন
মুক্তিযুদ্ধ শেষে বাংলাদেশে এসে বিভিন্ন স্থানে গান পরিবেশন করেছিলেন লতা মঙ্গেশকর
এক্স থেকে

বাংলাদেশের স্মৃতি
মুক্তিযুদ্ধ শেষে বাংলাদেশে এসে বিভিন্ন স্থানে গান পরিবেশন করেছিলেন কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী লতা মঙ্গেশকর। সে ঘটনা নিয়ে লতা মঙ্গেশকর টুইটারেও একটি বার্তা প্রকাশ করেছিলেন। সে বার্তায় তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে এসে সংগীত পরিবেশনের স্মৃতিচারণা করেছিলেন। টুইটটি করেছিলেন ২০১৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর। টুইটারে লতা মঙ্গেশকর ১৯৭১ সালে অজন্তা শিল্পীগোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁর বাংলাদেশ সফরের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বিখ্যাত অভিনেতা সুনীল দত্তের গ্রুপের সঙ্গে এসেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘নমস্কার। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শেষ হতেই আমি সুনীল দত্তের গ্রুপের সঙ্গে বাংলাদেশ গিয়ে অনেক কার্যক্রমে অংশ নিয়েছিলাম। সে সময়ে সেনাবাহিনীর উড়োজাহাজে করে সব জায়গায় গিয়েছিলাম।’

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে গান
লতা মঙ্গেশকর পরে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে গানও গেয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে মমতাজ আলী ‘রক্তাক্ত বাংলা’ নামে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। ওই চলচ্চিত্রে সলিল চৌধুরীর সুরে ‘ও দাদাভাই’ জনপ্রিয় এই গান গেয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর। এটিই বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে গাওয়া লতা মঙ্গেশকরের একমাত্র গান।

৫০ কোটি টাকায়ও বিয়ের অনুষ্ঠানে না
একবার বিয়ের অনুষ্ঠানে গাওয়ার জন্য ১ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ১১ কোটি টাকার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন এই গায়িকা। লতা মঙ্গেশকরের এ ঘটনা জানিয়েছেন তাঁর বোন আরেক গায়িকা আশা ভোঁসলে। ভারতের একটি নাচের রিয়েলিটি শোতে আশা বলেন, ‘তাঁকে (লতা) একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে গাওয়ার জন্য এক মিলিয়ন ডলারের প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি বলেছিলেন, “আমাকে ৫ মিলিয়ন (প্রায় ৫৪ কোটি টাকা) দেওয়া হলেও গাইব না।”’

দেশের বাইরে
কিংবদন্তি এই গায়িকার খ্যাতি ভারতীয় সীমান্তের চেয়েও অনেক বেশি। ১৯৭৪ সালে তিনি প্রথম ভারতীয় হিসেবে লন্ডনের রয়্যাল অ্যালবার্ট হলে পারফর্ম করেন। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়সহ ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টরেট উপাধিতে ভূষিত করেছে। ফ্রান্স ২০০৭ সালে তাঁকে সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার (অফিসার অব দ্য লিজিওন অব অনার) প্রদান করে।

সুগন্ধি পণ্য
১৯৯৯ সালে চলচ্চিত্র প্রযোজক ভরত শাহ কিংবদন্তি এই গায়িকার নামে সুগন্ধি পণ্য চালু করেন। যার নাম ছিল ‘লতা ইউ ডে পারফিউম’। এটি ছিল লতা মঙ্গেশকর অনুমোদিত প্রথম পণ্য।

লতা মঙ্গেশকর
ইনস্টাগ্রাম

এবং এক জীবনে লতা মঙ্গেশকর
কিংবদন্তি লতা মঙ্গেশকর অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে ৩৬টির বেশি ভাষায় গান গেয়েছিলেন। লতা মঙ্গেশকর ১৯২৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে শাস্ত্রীয় সংগীত ব্যক্তিত্ব ও থিয়েটারশিল্পী পণ্ডিত দীননাথ মঙ্গেশকর ও শেবান্তির ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। বাবার সাহচার্যে খুব অল্প বয়সেই গান শেখা শুরু করেন লতা মঙ্গেশকর। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে বাবার লেখা নাটকে অভিনেত্রী হিসেবে অংশ নেন তিনি। তাঁর ভাই-বোন—মিনা, আশা, ঊষা ও হৃদয়নাথ। তাঁদের সবাই দক্ষ গায়ক ও সংগীতজ্ঞ।

১৯৪২ সালে একটি মারাঠি সিনেমায় ‘মাতা এক সাপুত কি দুনিয়া বাদল দে তু’ গান দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। তবে তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে যায় ১৯৪৮ সালে হিন্দি চলচ্চিত্র ‘মাজবুর’–এর ‘দিল মেরা ঠোডা, মুজে কাহিন কা না ছোড়া’ গানের মাধ্যমে। সেখান থেকে তাঁকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

প্রায় আট দশকের ক্যারিয়ারে লতা মঙ্গেশকর বলিউডের লিড নারী কণ্ঠশিল্পী ছিলেন। তিনি ১ হাজারের বেশি হিন্দি ও ৩৬টি আঞ্চলিক চলচ্চিত্রে ২৫ হাজারের বেশি গান গেয়েছেন। বছরের পর বছর ধরে মধুবালা থেকে শুরু করে এই প্রজন্মের প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার ছবিতে গান গেয়েছেন। তিনি বহুমুখী ভয়েস কোয়ালিটির জন্য সর্বাধিক পরিচিত ছিলেন।

লতা মঙ্গেশকর
ফাইল ছবি: রয়টার্স

১৯৮৯ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারে ভূষিত হন লতা মঙ্গেশকর। ২০০১ সালে ভারতরত্ন (ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার), ১৯৬৯ সালে পদ্মভূষণ (ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার) ও ১৯৯৯ সালে পদ্মবিভূষণ (ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার) পান।

২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ৯০তম জন্মদিনে ভারত সরকার তাকে ‘ডটার অব দ্য নেশন’ পুরস্কারে ভূষিত করে।

১৯৪২ সালে বাবার মৃত্যুর পর ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত অভিনেত্রী হওয়ার চেষ্টা করেন এবং আটটি চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন। তবে চলচ্চিত্রগুলো কোনো সাফল্য না পেলে তিনি মারাঠি চলচ্চিত্র ‘কিটি হাসাল’–এর (১৯৪২) জন্য প্লেব্যাক গানের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। তবে গানটি আলো দেখেনি। কারণ, এটি চলচ্চিত্র থেকে সম্পাদনা করা হয়েছিল।