লাকী আখান্দ্‌কে নিয়ে জানা–অজানা কিছু কথা

লাকী আখান্দ্‌ (১৮ জুন ১৯৫৬ – ২১ এপ্রিল ২০১৭)

আজ সকাল থেকেই ফেসবুকে নানাজনের ওয়ালে তাঁর ছবি। লাকী আখান্দ্‌কে নিয়ে নানা কথা লিখেছেন অনেকে। আজ রোববার বহুজনের স্মৃতিতে তিনি ফিরে এসেছেন। তাঁর অনেক অনুরাগী মনে করেন, বাংলা গানের নতুন পথের দিশারি তিনি। সেই দিশারি শিল্পী, সুরকার ও মুক্তিযোদ্ধা লাকী আখান্দের চলে যাওয়ার দিন আজ। ২০১৭ সালের ২১ এপ্রিল জাগতিক ভ্রমণ শেষ হয় বাংলা গানের কিংবদন্তি সুরকার শিল্পী লাকী আখান্দের। যে যাত্রা শুরু হয়েছিল এই ঢাকায়, ১৯৫৬ সালের ৭ জুন ঢাকায়।

আরও পড়ুন

তিনবার নাম বদলেছেন লাকী আখান্দ্‌

জন্মের পর তাঁর নাম রাখা হয়েছিল এ টি আমিনুল হক। পরে মা নাম বদলে এ টি এম আমিনুল হাসান করেছিলেন। ম্যাট্রিকের সার্টিফিকেটেও এই নাম আছে। তবে যুদ্ধের সময় ভারতে গিয়ে তিনি ছদ্মনাম রাখেন—লাকী আনাম। এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, নাম পাল্টানোর কারণ হিসেবে তিনি দেশে পরিবারের নিরাপত্তার বিষয়টি ভেবেছিলেন। কারণ, মা-বাবা দেশে থাকেন। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে তাঁর গান বাজে। পাকিস্তানি আর্মিরা কোনোভাবে আসল পরিচয় জানলে দেশে পরিবারের সদস্যদের মেরে ফেলতে পারে। পরে স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে পূর্বপুরুষের পদবি নিয়ে নিজের নাম রাখলেন লাকী আখান্দ্‌।

শৈশব থেকেই গানের ভুবনে
পুরান ঢাকার এক সংগীতানুরাগী পরিবারে জন্ম লাকী আখান্দের। তিন ভাই জলি, হ্যাপি ও লাকীর সংগীতের প্রতি অনুরাগ পারিবারিকভাবেই। পাঁচ বছর বয়সে বাবা আবদুল আলী আখান্দের হাত ধরে সংগীতশিক্ষায় হাতেখড়ি তাঁর। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘বাবার কাছ থেকে আমাদের গানের প্রতি ভালোবাসার শুরু। আমাদের বাবা এ কে আবদুল হক গ্রেট মিউজিশিয়ান ছিলেন। তিনি ব্রিটিশ আর্মিতে লেফটেন্যান্ট ছিলেন। আর্মি থেকে চলে আসার পর তাঁর গানের প্রতি ভালোবাসা জন্মে। তিনি গানের একেবারে পাগল ছিলেন। সন্ধ্যা সাতটায় হারমোনিয়াম নিয়ে বসতেন। ঠুমরি, এটা-ওটা গাইতে গাইতে রাত তিনটা বেজে যেত। এগুলো শুনেই তো আমরা বড় হয়েছি। তবে বাবার কাছ থেকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আমি কিছু শিখিনি। এভাবেই শিখেছি।’ ১৯৬৩-৬৭ সাল পর্যন্ত টেলিভিশন ও রেডিওতে শিশুশিল্পী হিসেবে সংগীতবিষয়ক অনুষ্ঠানে অংশ নেন। ১৩ বছর বয়সে আধুনিক সংগীতে পাকিস্তান আর্ট কাউন্সিলের পুরস্কার পান। ১৪ বছর বয়সে এইচএমভি পাকিস্তান কোম্পানির সুরকার হিসেবে লাকী আখান্দের নাম তালিকাভুক্ত হয়। ১৯৭১ সালে ১৬ বছর বয়সে এইচএমভি ইন্ডিয়ায় সুরকার হিসেবে নিযুক্ত হন তিনি।

ছেলেবেলার ছবিতে দুই ভাই হ্যাপী আখান্দ্‌ ও লাকী আখান্দ্‌। ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে নেওয়া

স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতারকেন্দ্রের সংগীতশিল্পীর ভূমিকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে যোগ দেন এই কণ্ঠযোদ্ধা। সেখানে তাঁর গানের মধ্যে ছিল ‘জন্মভূমি বাংলা মাগো একটি কথা শুধাই তোমারে’, ‘ওই চেয়ে দেখো পুব আকাশ ফিকে হলো, ভোর হলো, ভোর হলো পথের আঁধার আর নাই’, ‘আমরা গেরিলা, আমরা গেরিলা মুজিবর, মুজিবর, মুজিবর’ ইত্যাদি। ডিসেম্বরে বিজয়ের পর দেশে ফিরে বাংলাদেশ বেতারে যোগ দেন। পরিচালক (সংগীত) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন চাকরিজীবনের শেষ পর্বে।

শিল্পীর সহোদর ক্ষণজন্মা হ্যাপি আখান্দের সঙ্গে ছিল তাঁর আত্মার সম্পর্ক। ১৯৮৭ সালে ছোট ভাই হ্যাপি আখান্দের অকালমৃত্যু লাকীর সংগীতজীবনকেও থমকে দেয়। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে এক আলাপচারিতায় তিনি বলেছিলেন, ‘বাবার কাছ থেকে যা জেনেছি, হ্যাপিকে শিখিয়েছি। হ্যাপিকে আমি অনেক দুঃখ দিয়েছি। তখন আমাদের অনেক অভাব ছিল, দুঃখ-যন্ত্রণা ছিল। তবে সংসারে যদি অভাব না থাকত, আমাদের ভেতরে যদি কষ্ট না থাকত; তাহলে আমাদের ভেতরে মিউজিক ঢুকত না।’ ভাইয়ের মৃত্যুর পর দীর্ঘকাল তিনি নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিলেন। অনেক পরে আবার গানে ফেরেন তিনি।

১৯৮৪ সালে সারগামের ব্যানারে লাকী আখান্দের প্রথম একক অ্যালবাম ‘লাকী আখান্দ’ প্রকাশ পায়। তিনি ব্যান্ড দল হ্যাপি টাচের সদস্য ছিলেন। ওই সময়ে তাঁর উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে ছিল ‘এই নীল মণিহার’, ‘আমায় ডেকো না’, ‘কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে’, ‘যেখানে সীমান্ত তোমার’, ‘মামনিয়া, ‘বিতৃষ্ণা জীবনে আমার’, ‘কী করে বললে তুমি’, ‘লিখতে পারি না কোনো গান’, ‘ভালোবেসে চলে যেয়ো না’ প্রভৃতি।

লাকী আখান্দ্‌
সংগৃহীত

ব্যতিক্রম সুরকার লাকী আখান্দ্‌

তাঁর সময়ে তিনি ছিলেন অন্যদের চেয়ে আলাদা। সুরকার হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিলেন। গানের বাণীকে গুরুত্ব দিয়ে আবহ ও পারিপার্শ্বিকতা তৈরি করেছে সুর। অভিন্ন সুর অথচ ভিন্ন ভিন্ন সংগীত আয়োজনে গাওয়া হয়েছে একই গান। এই নিরীক্ষা মন জয় করেছে সবার, শ্রোতারা পেয়েছেন নতুনত্বের স্বাদ। সুরকে বৈচিত্র্যপূর্ণ করতে এ দেশে হামিংয়ের সফল ব্যবহারে সামনের সারির একজন লাকী আখান্দ্‌। পাশাপাশি পানির গ্লাস, চিরুনি, দেশলাইয়ের বাক্সের মতো নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যসামগ্রীর গায়ে টোকা দিয়ে অভিনব অথচ শ্রুতিমধুর ছন্দ সৃষ্টির কৌশলের (শেকার) সফল প্রয়োগের অগ্রপথিক তিনি। ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’, ‘এই নীল মণিহার’, ‘যেখানে সীমান্ত তোমার’, ‘কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে রাতের নির্জনে’, ‘তুমি কি দেখেছ পাহাড়ি ঝরনা’, ‘তুমি ডাকলে কাছে আসতাম সে তো জানতেই’—এমন সব গান শ্রোতাদের হৃদয়ে চিরদিনের জন্য ঠাঁই নিয়েছে বাণী ও আবহের সঙ্গে।

বাণী–সুরের বন্ধনকে বৈচিত্র্যময় ও সমৃদ্ধ করেছে হামিং ও শেকার। তাঁর সুর করা গানে ভিন্ন ধারার শ্রুতিমধুর বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার হয়েছে অনিবার্যভাবে, তবে গানের বাণী হারিয়ে যায়নি সুরের প্রাধান্যে।

দুটি গানের কথা আলাদাভাবে বলা যায়। ‘যেখানে সীমান্ত তোমার’ গানটি সুরকার লাকী আখান্দ্‌ যেভাবে গেয়েছেন, সেই একই গান কণ্ঠশিল্পী কুমার বিশ্বজিতের কণ্ঠে ধরা দিয়েছে ভিন্নভাবে, ভিন্ন সংগীত পরিচালনায়। দুভাবেই পরিবেশিত গানটি শ্রোতাদের হৃদয়ে চিরদিনের জন্য গেঁথে আছে। একই ঘটনা ‘মামুনিয়া’ ও ‘বিড়ালের ছানা’ গান দুটিতে। সুরকার নিজের কণ্ঠে গেয়েছেন যেই সংগীত আয়োজনে, সুর অবিকৃত রেখে গায়ক ফেরদৌস ওয়াহিদকে দিয়ে গানটি গাইয়েছেন ভিন্ন আঙ্গিকে। সামিনা চৌধুরীর কণ্ঠে ‘কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে রাতের নির্জনে’, জেমসের কণ্ঠে ‘লিখতে পারি না কোনো গান আজ তুমি ছাড়া’, আইয়ুব বাচ্চুর ‘কী করে বললে তুমি’, লাকী আখন্দের নিজের কণ্ঠে ‘আমায় ডেকো না ফেরানো যাবে না’ কিংবা ছোট ভাই হ্যাপি আখান্দ্‌কে নিয়ে দ্বৈত কণ্ঠে গাওয়া ‘স্বাধীনতা তোমাকে নিয়ে গান লিখেছি’ বাংলাদেশের আধুনিক গানের ইতিহাসে ভিন্ন এক ধারার মাইলফলক হয়ে আছে।

লাকী আখান্দ্‌
সংগৃহীত

ফোক ফিউশনের সঙ্গে পাশ্চাত্য সুরের মেলবন্ধন তাঁর সৃষ্টির মূল অবলম্বন। বিশেষ করে স্প্যানিশ সুর মূর্ছনার প্রতি লাকী আখন্দের আগ্রহ দেখা গেছে। তিনি বলেছিলেন, ‘শুরু থেকেই স্পেন ও গ্রিসের মিউজিক আমাকে স্পর্শ করে। এগুলোই আমার গানে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। কোনো শিক্ষক পাইনি। তবে নিজে নিজে শেখার চেষ্টা করেছি।’

তবে পাশ্চাত্য ও আধুনিক সুরের প্রভাবে লাকী আখান্দের মৌলিক প্রতিভাকে ম্লান করতে পারেনি কখনো। বরং দেশীয় ধ্রুপদি ও ঠুমরির সুরে তৈরি করেছেন অন্তত দুটি গান, যা মন কেড়েছে সংগীতবোদ্ধাদের। কাওসার আহমেদ চৌধুরীর কথায় গজল ও ক্ল্যাসিক্যাল সুরের ওপর তৈরি করা ‘আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে মনে পড়ল তোমায়’ গানটি নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরীর কণ্ঠে যে সুরে তুলে দিয়েছেন, তাতে প্রমাণিত হয়, লাকী আখান্দ্‌ বহুমাত্রিক সুর ও সংগীতের মানুষ।

ঠুমরির ওপর ছেলের কোনো কাজ নেই, এমন অনুযোগ ছিল মা নুরজাহান বেগমের। মায়ের ইচ্ছায় নিজেরই লেখা ‘ভুলতে পারিনি তোমায়, তুমি কে বলো না’ গীতিকবিতাটিকে ঠুমরি ধাঁচে সুর করে নিজেই গাইলেন লাকী। চমৎকার সুরারোপের জন্য মুগ্ধ হয়ে মা নুরজাহান বেগম পুরস্কার হিসেবে ছেলের হাতে তুলে দেন ১০ হাজার টাকা।

লাকী আখান্দ্‌
সংগৃহীত

ভিন্ন ধারার সুরে নিরীক্ষাধর্মী সংগীতায়োজনে আগ্রহী বলে লাকী আখান্দ্‌ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছেন এস এম হেদায়েত, গোলাম মোরশেদ কিংবা কাওসার আহমেদ চৌধুরীর মতো ভিন্ন ধারার গীতিকারদের সঙ্গে কাজ করতে। এর মধ্যে কাওসার আহমেদ চৌধুরীর কলমে উঠে আসা ঝরঝরে সহজবোধ্য আধুনিক রোমান্টিক গীতিকবিতা লাকীর সুরে পেয়েছে তুমুল জনপ্রিয়তা।

সংগীতের রাজপুত্রখ্যাত লাকী আখান্দ্‌ আমাদের মাঝে নেই। আছে তাঁর সৃষ্টি করা অদ্ভুত সব সুর। আজও এমন কোনো অনুষ্ঠান হয় না, যেখানে তাঁর গান গাওয়া হয় না, তাঁর সুর বাজে না। বেশির ভাগ ঘরোয়া সংগীতের আসর শুরু হয় ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’ গান দিয়ে। এভাবে ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’, ‘নীল মণিহারে’, ‘ফেরারি পাখি’র মধ্যে কিংবা ‘কবিতা পড়ার প্রহর’–এ লাকী আখান্দ্‌ বেঁচে থাকবেন যুগের পর যুগ।

(লেখাটি লাকী আখান্দের জন্মদিনে প্রথম আলো বিনোদনে প্রকাশিত ফিচার থেকে সংকলিত)