নাদীমের কাওয়ালিতে মজলেন শ্রোতারা

গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় ঢাকার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ইসফেন্দিয়ার জাহেদ হাসান মিলনায়তনে কাওয়ালি পরিবেশন করেছেন নাদীম কাওয়াল ও তাঁর দলছবি: আয়োজকদের সৌজন্যে

কাওয়ালি সংগীতের সুরে মাদকতা আছে। বিদগ্ধ শ্রোতাদের মতো আরবি, ফার্সি কিংবা উর্দু ভাষায় দখল না থাকলেও চলবে। সুরের শক্তি অসীম, কাওয়ালির সুরের ইন্দ্রজাল শ্রোতাদের আন্দোলিত করে।

গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় ঢাকার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ইসফেন্দিয়ার জাহেদ হাসান মিলনায়তনে কাওয়ালি পরিবেশন করেছেন নাদীম কাওয়াল ও তাঁর দল। ‘দমা দম মাস্ত কালান্দার’, ‘তাজেদারে হারাম’, ‘ভর দো ঝোলি মেরি ইয়া মুহাম্মাদ’, ‘নয়নে নয়নে রাখিব’—এর মতো গান কাওয়ালি গানের অনুরাগীদের পাগলপারা করেছে।

শহুরে এই কাওয়ালির আসরে বহু তরুণ–তরুণীকে পাওয়া গেছে, যাঁরা জীবনে প্রথমবারের মতো কোনো কাওয়ালি গানের আসরে এসেছিলেন। তাঁরাও কাওয়ালির সুরে মজেছেন, আরও কাওয়ালি শোনার তৃষ্ণা বাড়িয়েছেন নাদীম কাওয়াল।

বাংলাদেশে কাওয়ালি মূলত খানকাহনির্ভর; ফলে কাওয়ালির সঙ্গে শহুরে তরুণদের যোগাযোগ খুব একটা নেই। পরিবেশনা শেষে ঢাকার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের নিচে এক চায়ের দোকানে প্রথম আলোর মুখোমুখি হলেন নাদীম কাওয়াল। চায়ে চুমুক দেওয়ার ফাঁকে বললেন, ‘শ্রোতাদের অনেকে বলেছেন, জীবনে প্রথমবার কাওয়ালি শুনলাম। একজনও নিজের ভেতরে ছিলেন না, সবাই আনন্দ অনুভব করেছেন।’

মোহাম্মদ নাদীম এহতেশাম রেজা খাঁ। তিনি শ্রোতাদের কাছে নাদীম কাওয়াল নামে পরিচিতি
ছবি: শিল্পীর সৌজন্যে

নাদীম কাওয়ালের পূর্বপুরুষেরা সাড়ে ৭০০ থেকে ৮০০ বছর ধরে বংশপরম্পরায় কাওয়ালি করছেন। তাঁর পূর্বপুরুষদের হাত ধরেই বাংলাদেশে কাওয়ালি সংগীত প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশে সেই পরম্পরার একমাত্র প্রতিনিধি নাদীম কাওয়াল। হালের সবচেয়ে জনপ্রিয় কাওয়ালদের একজন তিনি; কাওয়ালির অনুরাগীদের কাছে তাঁর জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী।

তাঁকে নিয়ে ‘সুফি রাবত’ শীর্ষক আয়োজন করেছেন মীর হুযাইফা আল-মামদূহ ও সাইয়েদ শাহবাজী। এই আয়োজনে দিনভর সুফিবিষয়ক আলাপ শেষে বৈঠকি ঢঙে কাওয়ালি পরিবেশন করেন নাদীম কাওয়াল।

সব শ্রেণির শ্রোতাদের মাঝে কাওয়ালি গানের সুবাস ছড়িয়ে দিতে ‘সুফি রাবত’–এর মতো আয়োজন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন নাদীম। তিনি বলেন, ‘আমার বিশ্বাস, তরুণেরা এই ধরনের প্রোগ্রামে একবার এলে কাওয়ালি গান নিয়ে আগ্রহ ও ভালোবাসা বেড়ে যাবে।’

আর্মি স্টেডিয়ামসহ ঢাকার বিভিন্ন ভেন্যুতে নিয়মিত কনসার্টে তরুণদের জোয়ার দেখা যায়। এই ধরনের বড় ভেন্যুতে কাওয়ালি গানের আয়োজন হলে তরুণদের মাঝে কাওয়ালি ছড়িয়ে পড়বে বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আর্মি স্টেডিয়ামে যেমন কনসার্ট হয়, ওই ধরনের গ্রোগ্রাম হলে আরও মানুষ আসবে। গানের প্রতি অনেকের ভালোবাসা তৈরি হবে। একবার একজন এলে তিনি আরও ১০ জনকে নিয়ে আসবে।’

‘সুফি রাবত’–এর অন্যতম আয়োজক মীর হুযাইফা আল-মামদূহও জানালেন, কাওয়ালির সঙ্গে তরুণদের মেলবন্ধন ঘটাতেই কাওয়ালির আসর রেখেছেন তাঁরা।

কাওয়ালি পরিবেশন করেছেন নাদীম কাওয়াল ও তাঁর দল
ছবি: আয়োজকদের সৌজন্যে

হজরত নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার শিষ্য ত্রয়োদশ শতকের ভারতে কবি ও সংগীতজ্ঞ হজরত আমির খসরুকে কাওয়ালি গানের প্রবর্তক হিসেবে ধরা হয়। ১২৫৩ সালে জন্ম আমির খসরুর, জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার খানকাহতে।

কাওয়ালি হলো এই উপমহাদেশের সংগীতের একটি ধারা। কাওয়ালি সংগীতে মূলত স্রষ্টার পাশাপাশি সুফি তরিকার সাধকদের গুণগান করা হয়। ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে কাওয়ালির চর্চা হয়; সবখানেই নাদীম কাওয়ালের বংশধরেরা আছেন।

তিনি বলেন, ‘ভারতে আমার দুই মামা ও খালাতো ভাইয়েরা গাইছেন। পাকিস্তানে চাচাতো ভাইয়েরা গান করেন। নুসরাত ফতেহ আলী খানও আমাদের বংশের।’

নাদীম কাওয়াল
ছবি: নাদীমের সৌজন্যে
আরও পড়ুন

কাওয়ালির সঙ্গে সুফিবাদের সম্পর্ক রয়েছে। বেশির ভাগ কাওয়ালি ফারসি, আরবি, উর্দুতে লেখা। বাংলায়ও কিছু কাওয়ালি রয়েছে; বাংলাসহ সব ভাষায় কাওয়ালি করেন নাদীম কাওয়াল। বাংলায় কাওয়ালির হদিস দিয়ে বললেন, ‘কাজী নজরুল ইসলাম দয়াল নবীর শানে কত প্রশংসার গান উনি লিখেছেন। “ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ এল রে দুনিয়ায়” লিখেছেন। লালনও লিখেছেন, “পারে কে যাবি নবীর নৌকাতে আয়”।’

ঢাকার হাইকোর্ট মাজারে খাজা শরফুদ্দিন চিশতী (রহ.)-এর দরগা, মিরপুরে হজরত শাহ আলী বোগদাদী (রহ. )-এর দরগাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কাওয়ালি করেছেন তিনি। নাদীম কাওয়ালের ভাষ্যে, রজব মাসে কোনো কাওয়ালই (শিল্পী) বসে থাকেননি। প্রতিদিনই গান করেছেন তাঁরা।