মনে করেছি, আমার স্বামী আমারই: লায়লা হাসান

সৈয়দ হাসান ইমাম ও লায়লা হাসান
সৈয়দ হাসান ইমাম ও লায়লা হাসান

চলচ্চিত্র, নাটক আর গানের শিল্পীদের ঘর ভাঙার খবর এখন হরহামেশাই শোনা যায়। ভাঙনের এই খবর যেমন তাঁদের ভক্তদের কষ্ট দেয়, তেমনি সৈয়দ হাসান ইমাম ও লায়লা হাসানদের মতো গুণী অভিনয়শিল্পীদের বিবাহিত জীবনের ৫৩ বছর উদ্‌যাপনের খবরে আবার আনন্দিত করে। আজ ৩০ জুন বাংলাদেশের সংস্কৃতি অঙ্গনের এই দুই গুণীজন বিবাহিত জীবনের ৫৩ বছর পার করছেন। গতকাল শুক্রবার দিবাগত রাতে মেয়ে-মেয়েজামাই ও নাতি-নাতনিরা কেক কেটে আর ফুলের শুভেচ্ছায় সৈয়দ হাসান ইমাম ও লায়লা হাসানের বিবাহবার্ষিকী উদ্‌যাপন করেছেন।

বিবাহবার্ষিকী নিয়ে কখনোই আলাদা কোনো ভাবনা-চিন্তা কাজ করত না সৈয়দ হাসান ইমাম ও লায়লা হাসানের। এখনো এই বিষয়টা তাঁদের ভাবনার মধ্যে কাজ করে না। খুব একটা ভাবেন না। তবে তাঁরা না ভাবলেও কী হবে। সব সময়ের মতো এবারও মেয়ে আর মেয়েজামাইয়ের উৎসাহ ছিল বেশি। সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন নাতি ও নাতবউ। এবারের বিবাহবার্ষিকীর প্রথম প্রহরটাই তাঁরাই রঙিন করেছেন। লায়লা হাসান বললেন, ‘মেয়ে ও মেয়েজামাই। মেয়ের ঘরের নাতি ও নাতির বউ—ওরাই আয়োজন করেছে। কয়েক বছর ধরে ওরাই করছে। ২৯ জুন দিবাগত রাতে ১২টা ১ মিনিট হলেই, ওরা কোথা থেকে যেন সব আয়োজন করে ফেলে। কেক কাটা, এসব আমার ভালো লাগে না। আমরা যখন বিয়ে করি, তখন তো এসব ছিলও না। খাওয়াদাওয়া হতো। রান্নাবান্না করতাম। ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন কেউ এই দিনে আসবে এটা জানতাম।’

বিবাহবার্ষিকী নিজেরা উদ্‌যাপন না করলেও ৫৩ বছরের দাম্পত্য জীবনে কয়েকবারই চমকে গেছেন। এসবের নেপথ্যে সব সময় কাজ করেছেন তাঁদের ছেলে আর মেয়ে। সেই সময়কার স্মৃতি মনে করে লায়লা হাসান বলেন, ‘বিয়ের দশম বছরটা বেশ ঘটা করেই উদ্‌যাপন করা হয়েছিল। সেবার একটা সাংস্কৃতিক সফরে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে গিয়েছিলাম। সেখানেই চমৎকার একটা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিবাহবার্ষিকী উদ্‌যাপন করা হয়। এরপর নব্বইয়ের দশকে আমার মেয়ে সংগীতা আমাদের দিয়েছিল। সেবার বিবাহবার্ষিকীর আয়োজনের সবকিছুই আমার শাশুড়ি থেকে শুরু করে সবাই জানত। সন্ধ্যার পর গোলাম মোস্তফা, বুলবুল আহমেদ থেকে শুরু করে আমাদের সব বন্ধুবান্ধব বাসায় আসা শুরু করে। সবার আসা দেখে আমরা তো অবাক। পরে জানতে পারলাম, আমার মেয়ে সবাইকে দাওয়াত দিয়েছে। খাবার রান্না করে চুপচাপ নিচতলায় রেখেও দিয়েছিল।’

দশম বছরের পর বিবাহিত জীবনের ৫০ বছর যখন, তখনো সৈয়দ হাসান ইমাম ও লায়লা হাসান যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে ছিলেন। সেখানে তাঁর ছেলে থাকেন। একটি মিলনায়তন ভাড়া করে মা-বাবার বিবাহিত জীবনের ৫০ বছর উদ্‌যাপন করেছিলেন। লায়লা হাসান বলেন, ‘আমরা তো ভুলেই গিয়েছিলাম। ছেলে দেখি তাঁর বন্ধুবান্ধব সবাইকে দাওয়াত করল, আমরাও গেলাম। অন্য রকম একটা আনন্দ হয়েছিল।’

সম্পর্কের এই দীর্ঘ পথচলার রহস্য জানতে চাইলে এই গুণী অভিনেত্রী ও নৃত্যশিল্পী বলেন, ‘এখনকার ছেলেমেয়েদের ইগো সমস্যাটা বেশি। সহনশীলতা নাই, ধৈর্য নাই। আমরা তো ভাবতাম বিয়ের পর, এটাই আমার ঠিকানা, এটাই আমার ঘর। আমি আমার মেয়েদেরও তা-ই শিখিয়েছি। উনিশ-বিশ তো পৃথিবীর সব সংসারে থাকবে। যখন সংসারটাকে আমার নিজের মনে করব, তখন শান্তিও আসবেই।’

১৯৬৫ সালে সৈয়দ হাসান ইমামের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন লায়লা হাসান। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির পরিবারকে লায়লা হাসানের কখনো অচেনা মনে হয়নি। এই পরিবারও বাংলাদেশের এই গুণী শিল্পীর সংস্কৃতির্চচার ক্ষেত্রে সব সময় সমর্থন জুগিয়ে গেছেন। লায়লা হাসান বলেন, ‘আমরা দুজন দুই পরিবার থেকে এক পরিবার হয়েছি। আমরা শুনি, একটা পরিবারে স্বামী ঠিক থাকলে শ্বশুরবাড়ির অন্যরা ঠিক থাকে না। আমি বলব যে আমি এমন একজন শাশুড়িকে পেয়েছি, আমার শাশুড়ির মতো এমন শাশুড়ি অন্য কোনো মেয়ে পেয়েছে কি না জানি না। এত ভালো, এত নরম মনের মানুষ তিনি। আমার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের যত উৎসাহ, তিনি আমাকে দিতেন। বিয়ের পর আমার দুই সন্তানের জন্ম হয়। আমার শাশুড়ি আমার সঙ্গে যেতেন। বাচ্চাদের দেখাশোনাও করতেন—আমি নির্বিঘ্নে কাজ করতাম।’

শ্বশুরবাড়ির সবাই লায়লা হাসানের কাজ ভীষণ ভালোবাসত উল্লেখ করে বললেন, ‘আমার নাচ, আমার নাটক ভীষণ ভালোবাসতেন সবাই। আমার শাশুড়ি তো কক্সবাজারে কাজ থাকলে সেখানেও চলে যেতেন। খুব সকালে ঘুম থেকে আমাকে তুলে সূর্য ওঠা দেখাতেন।’

স্বামী সৈয়দ হাসান ইমামের চেয়ে লায়লা হাসান ১২ বছরের ছোট। তারপরও তাঁদের দুজনের সম্পর্কটা ছিল দারুণ শ্রদ্ধার আর বন্ধুত্বের। বললেন, ‘আমি বয়সে ছোট হলেও, ছোটর প্রতি যে আলাদা শ্রদ্ধা দেখানো উচিত, তা তিনি ভীষণভাবে দেখাতেন। পরিবার আর ক্যারিয়ারের কোনো কাজ আলোচনা না করে, তিনিও করেননি, আমিও না। সবকিছু নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেই করতাম। আমার স্বামী ছিল সবচেয়ে বেশি সাপোর্টিভ। শ্বশুরবাড়ি থেকেও কেউ আমাকে কোনো কাজে বাধা দেয়নি।’

সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার মূল ভিত কী? ‘সমঝোতা ও বিশ্বস্ততা হচ্ছে সম্পর্কের মূল ভিত। দুজন দুজনকে বিশ্বাস করতেই হবে। আমরা কাজের জন্য দেশের বহু জায়গায় গিয়েছি, দেশের বাইরে গিয়েছি। একা আমি গিয়েছি, একা উনিও গিয়েছেন—মনে করেছি, আমার স্বামী আমারই। যত মেয়ের সঙ্গে অভিনয় করুক, উনি আমারই আছেন—এটা সব সময় মনে করতাম। তাঁর কাছ থেকেও আমার কোনো কিছুতে কমতি পাইনি। বিশ্বাস করাটা, বিশ্বস্ততা খুব জরুরি। সংসারজীবনে কথা-কাটাকাটি হবেই। ঝগড়াঝাঁটিও হবেই। মতের অমিল হবেই। তারপরও একটা বোঝাপড়ায় চলে আসব।’